জোহানেস কেপলার। ছবি: গেটি ইমেজেস
স্কুলের খরচ জোগাতে না পেরে মা কেপলারের পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। চাকরি করতে পাঠিয়ে দেন সরাইখানায়। ওয়েটারের কাজ। সে চাকরি যে কেপলারের পছন্দ নয়, তা বলাই বাহুল্য। তাঁর মন পড়ে থাকত স্কুলের ক্লাসঘরে। সেখানে শিক্ষকেরা কত কী যে পড়ান! কত কিছু যে জানার এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে! স্কুলের বাইরে কেপলার এ বার পড়া শুরু করেন নিজে। গোগ্রাসে নিতে থাকেন ধর্মতত্ত্ব আর বিজ্ঞানের পাঠ। ধর্মতত্ত্ব তেমন টানল না মন। বরং বিজ্ঞান অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। ও বিষয়ের মধ্যে গণিতের সুবাতাস স্পষ্ট। আর গণিতে কেপলার দারুণ পটু। কেপলারের বিশ্বাস, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্ত পরম করুণাময় ঈশ্বরের প্ল্যান। আর সে প্ল্যানের হদিশ দিতে পারে গণিত। গণিতের মাধ্যমে ঈশ্বরের মনের খবর জানবেন কেপলার।
শুধু খিটখিটে মেজাজের জন্যই নয়, বাল্যে স্কুল ছাড়িয়ে মদের দোকানে চাকরি করতে পাঠানোয়— তা সে দারিদ্রের কারণে হলেও— মা’কে ক্ষমা করতে পারেননি কেপলার। মা-ছেলের সম্পর্কে চিড় ধরে অল্প বয়স থেকেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাশাপাশি জ্যোতির্বিদ্যাতেও হাত পাকিয়েছিলেন কেপলার। জন্মতারিখ এবং জন্মসময় থেকে হিসেব কষে বের করেছিলেন কোন তারিখে এবং কোন সময়ে মায়ের গর্ভে ভ্রূণ হিসেবে এসেছিলেন তিনি। এবং তখন আকাশে রাশি-নক্ষত্রের দশা ছিল কী রকম। সময়টা, তাঁর মতে, ভাল ছিল না খুব একটা। কেপলারের বিচারে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে রাশি-নক্ষত্রের দশা নির্ধারণ করে তার জীবন। তাঁর এবং তাঁর মায়ের জন্মমুহূর্তে রাশি-নক্ষত্র নাকি ছিল এক রকম। তা হলে তাঁদের জীবন আলাদা কেন? কেপলারের ব্যাখ্যা: শিক্ষা-দীক্ষা। প্রায় নিরক্ষর মা এবং তাঁর শিক্ষিত ছেলের মধ্যে যে তফাত অনুমান করা সহজ, ঠিক ততটা ফারাকই ছিল ক্যাথরিনা এবং কেপলারের মধ্যে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য এই যে, ক্যাথরিনার ডাইনি অপবাদ পাওয়ার মূলে পরোক্ষে দায়ী ছিল কেপলারের এক কাজও। কী কাজ? ‘সমনিয়াম’ (স্বপ্ন) নামে একখানি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। অনেকের মতে, ওটি প্রথম সায়েন্স ফিকশন। চাঁদে বসবাসকারী জীবের কথা ছিল সেই উপন্যাসে। আর ছিল পৃথিবীতে এক ডাইনি মহিলার কাহিনি। যার ছেলে আবার জ্যোতির্বিজ্ঞানী। লিওনবার্গ শহরে সেনেট সদস্যদের অনেকে ‘সমনিয়াম’ পড়ে মনে করেছিলেন, ওই উপন্যাসে বর্ণিত মা-ছেলের গল্প কেপলারের নিজের জীবনের প্রতিফলন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আর এক তথ্য। ছোটবেলায় মাতৃহীনা ক্যাথরিনাকে মানুষ করে তুলেছিলেন যে মহিলা, ডাইনি হওয়ার অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল তাঁকেও। ডাইনির পালিতা-কন্যা নিজে ডাইনি হতেও পারে। সেনেট সদস্যদের এ হেন যুক্তি মানলেন না কেপলার। বাস্তবে মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর না হলেও, কেপলার যখন দেখলেন বৃদ্ধাকে হাতে-পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, যখন শুনলেন তাঁকে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত কিছু মানুষ, তখন আর ঠিক থাকতে পারলেন না। তাঁকে বাঁচাতে যথাশক্তি নিয়ে নামলেন।
ক্যাথরিনাকে ডাইনি প্রমাণে লিওনবার্গ সেনেটের সামনে অভিযোগের পাহাড়। অধিকাংশই অবশ্য তাঁর দেওয়া ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হওয়ার কথা বলেছেন। ও সব নাকি জাদু সালসা। ক্যাথরিনা পিশাচদের পরামর্শ মেনে নাকি ও সব বানান। তার পর সে সব রুগিদের খেতে বলেন রোগ সারানোর অজুহাতে। আসলে তাঁর অভিসন্ধি মানুষকে মেরে ফেলা। সব কিছু পিশাচদের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে। কারও অভিযোগ, অন্ধকার রাতে একা একা পথ চলতে নাকি দেখা যায় ক্যাথরিনাকে।
মুখে বিড়বিড় করে কী বলতে বলতে চলেন, তা কেউ বুঝতে পারেন না। এক মহিলার দাবি, দশ বছর আগে কোনও এক দিন নাকি ক্যাথরিনা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি কি মনে করেন না এই পৃথিবীতে জীবন বড় কষ্টের? তার চেয়ে অনেক ভাল নয় কি ডাইনি বনে যাওয়া? ওই মহিলা চাইলে ওঁকে ডাইনি বানিয়ে দিতে পারেন ক্যাথরিনা। চমকপ্রদ অভিযোগ এক স্কুলশিক্ষকের। এক রাতে ডিনারের সময় নাকি ক্যাথরিনা তাঁর বাড়িতে হঠাৎ হাজির। অদ্ভুত ভাবে। বাড়ির দরজা ছিল বন্ধ। তা সত্ত্বেও নাকি ক্যাথরিনা সে বাড়িতে ঢুকে পড়েন, তাঁর আর্জি জানাতে। তিনি খুব অর্থকষ্টে আছেন। তক্ষুনি ক্যাথরিনার হয়ে স্কুলশিক্ষককে একখানি চিঠি লিখে দিতে হবে পুত্র কেপলারকে। যাতে সে দ্রুত অর্থ পাঠায় বাড়ির ঠিকানায়। এ কথা জানিয়ে নাকি চিঠি লেখার অপেক্ষায় বসে না থেকে তৎক্ষণাৎ উধাও ক্যাথরিনা। স্কুলশিক্ষকের বাড়ির দরজা তখনও বন্ধ!
আগেই বলেছি, বিচার চলল ছ’বছর ধরে। এত কাল দীর্ঘ হওয়ার কথা নয় বিচারপর্ব। কাউকে ডাইনি সাব্যস্ত করতে অত দিন লাগত না তখন। বিচার শেষ হত এক কিংবা দু’বছরের মধ্যে। ক্যাথরিনার বেলায় ব্যতিক্রমের মূলে তাঁর ছেলে। হ্যাঁ, কেপলার তখন রীতিমত বিখ্যাত। তিনি প্রাহা শহরে সম্রাটের গণিতজ্ঞ। আসলে তাঁর জ্যোতিষী। তখন রাজারা ও রকম মাইনে-করা জ্যোতিষী রাখতেন কোনও কাজে নামার আগে পরামর্শ পেতে। কেপলারের কাজও ছিল সে রকম। রাজকর্মচারী হিসেবে তিনি খ্যাতিমান। এ হেন ব্যক্তির মা কাঠগড়ায়। বিচার তাই রয়ে-সয়ে।
নিজের খ্যাতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন কেপলার। মা’র বিচারপর্বকে পরিণত করলেন প্রায় রাজনৈতিক ‘ইভেন্ট’-এ। একে-তাকে চিঠি লিখে জানাতে লাগলেন শুনানির অগ্রগতি। আর মা’র হয়ে সওয়াল করতে নিজেকে তৈরি করলেন নিপুণ ভাবে। পড়লেন চিকিৎসাশাস্ত্র। শিখলেন আইনের কচকচি। জানলেন ‘প্রমাণ’ কাকে বলে। অথবা সাক্ষীর মতলব শনাক্ত করা যায় কী করে। এক কথায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানী থেকে কেপলার বনে গেলেন দুঁদে উকিল।
জাদু সালসা? কত জন অসুস্থ হয়েছেন ক্যাথরিনার ওষুধ খেয়ে, আর কত জনের সেরেছে রোগ? জড়িবুটির রস তো রাসায়নিক পদার্থ, তাতে কার দেহে কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে, তা কি সব সময় নির্ভুল বলা যায়? ডাইনি হতে প্ররোচনা? কী প্রমাণ আছে তার? কে ঠিক করবে, অভিযোগ অভিসন্ধিমূলক কি না? বন্ধ দরজা ভেদ করে যাতায়াত? ওটা স্কুলশিক্ষকের খোয়াব। ডজন ডজন অভিযোগ আইনের অলিগলিতে টেনে এনে নস্যাৎ করলেন কেপলার। কাটল দীর্ঘ সময়।
ছ’বছরের আইনি লড়াইয়ে জিতলেন কেপলার। তিনি ক্লান্ত। অবসন্ন। এতটাই যে, জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চাতেও বিরতি দিলেন অনেক মাস। আর ক্যাথরিনা? হ্যাঁ, তিনি এ বার মুক্ত। তা হলে কী হবে? ছ’বছর কারাবাসের অত্যাচারে তিনি বিধ্বস্ত। মারা গেলেন মাত্র কয়েক মাসের মাথায়।