Advertisement
E-Paper

আমেরিকায় তিনিই বাংলা বইয়ের মুখ

নিউইয়র্কে খুলেছেন বাংলা বইয়ের দোকান ‘মুক্তধারা’। পঁচিশ বছর ধরে করে আসছেন বইমেলা। প্রবাসে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বিস্তারে বিশ্বজিৎ সাহা নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। অদ্রীশ বিশ্বাসনিউইয়র্কে খুলেছেন বাংলা বইয়ের দোকান ‘মুক্তধারা’। পঁচিশ বছর ধরে করে আসছেন বইমেলা। প্রবাসে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বিস্তারে বিশ্বজিৎ সাহা নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। অদ্রীশ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
আপনজন: নিউইয়র্কের বাংলা বইমেলায় ‘মুক্তধারা নিউইয়র্ক’-এর স্টল।

আপনজন: নিউইয়র্কের বাংলা বইমেলায় ‘মুক্তধারা নিউইয়র্ক’-এর স্টল।

লন্ডনের ব্রিক লেন-এ গিয়ে চমকেছি, সর্বত্র বাংলায় রাস্তার নাম লেখা। দোকানের নাম, বইয়ের, মিষ্টির, সব বাংলায়। বিশ শতকের শেষ দিকে এই দুর্দান্ত অনুপ্রবেশ একটা ‘মিনি বাংলাদেশ’ গড়ে তুলেছে। সব আছে, শুধু সেখানে বিশ্বজিৎ সাহা নেই। বিশ্বজিৎ সাহা আছেন আমেরিকার নিউইয়র্কে। সেখানেও একটা মিনি বাংলাদেশের সঙ্গে তিনি গড়ে তুলেছেন প্রবাসে সবচেয়ে বড় বাংলা বইয়ের দোকান ‘মুক্তধারা’, আর বহির্বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাংলা বইয়ের মেলা, যার বয়স পঁচিশ বছর হল। বাংলা ভাষা চর্চা ও রক্ষার কাজে তিনি এখন নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জন্ম নোয়াখালিতে। পড়াশোনার জন্য চলে আসেন ঢাকায়, ১৯৮৩ সালে। শুরু করেন সাংবাদিকতা। স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে তাঁর লেখা গণতন্ত্রকামী মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর বাবা চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রকাশনা ‘মুক্তধারা’-তে যুক্ত হয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। বিশ্বজিৎ ১৯৯১ সালে পাড়ি দেন নিউইয়র্কে। সেখানে সাংবাদিকতার পাশাপাশি ‘মুক্তধারা নিউইয়র্ক’ নামে নতুন প্রকাশনা গড়ে তোলেন। তার পর ‘মুক্তধারা’ নামে একটা বাংলা বইয়ের দোকান দেন জ্যাকসন হাইট্‌স-এ। ভারত-বাংলাদেশ সহ দুনিয়ার যেখানে যত বাঙালি থাকেন, তাঁদের বই রয়েছে বিশ্বজিতের দোকানে। এটাই প্রবাসের সবচেয়ে বড় বাংলা বইয়ের দোকান। নতুন প্রজন্মকে বাংলা বই পড়াতে বিশ্বজিৎ সাহা শুরু করেন বাংলা বইয়ের মেলা। মেলার প্রতি বাঙালির টান চিরকালীন। বিশ্বজিতের উদ্যোগে প্রথম মেলা পঁচিশ বছর আগে, নিউইয়র্কে, ফেব্রুয়ারির ঠান্ডায়। সেটা এখন সরতে-সরতে মে মাসের চমৎকার আবহাওয়াতে হয়। বহির্বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা এটা। এখন সেটা দুই বাংলার নয়, পৃথিবীর নানা জায়গার লেখক ও পাঠকদের একটা আশ্চর্য মিলন-মেলায় পরিণত হয়েছে। এমনও হয়েছে, লন্ডন থেকে গোলাম মুরশিদ, বাংলাদেশ থেকে হুমায়ুন আহমেদ, আর ভারত থেকে সমরেশ মজুমদার একসঙ্গে সই দিয়েছেন পাঠকদের। ঠিক এ জিনিসটাই প্রতি বছর ঘটে বিশ্বজিৎ সাহার উদ্যোগে।

বিশ্বজিৎ সাহা নিউইয়র্ক যাওয়ার পরের বছর, ১৯৯২ সালে ‘মুক্তধারা নিউইয়র্ক’ ও ‘বাঙালি চেতনা মঞ্চ’-এর ব্যানারে রাষ্ট্রপুঞ্জের সামনে অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনাকে শ্রদ্ধা জানান। যেটা বেশ কষ্টকর একটা ব্যাপার। কারণ তখন নিউইয়র্ক থাকে বরফে ঢাকা। সেই বরফ ভেঙে প্রতি বছর মাঝরাতে বিশ্বজিৎ সাহা যান বন্ধুদের নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন করতে। বাঙালি যখন কুঁড়ে, শীতকাতুরে, উদ্যোগহীন, ঘুমন্ত ইত্যাদি নানা অপবাদে আক্রান্ত, তখন বিশ্বজিৎ সাহা সেই অপবাদের এক জীবন্ত জবাব, তিনি বাংলা ভাষার জন্য হার না-মানা এক বাঙালি।

প্রবাসে বাংলা ভাষা ও বাংলা বইকে এ ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বজিৎ সাহা

বিশ্বজিতের হাতে তৈরি ‘মুক্তধারা ফাউন্ডেশন’ এখন নিউইয়র্ক স্টেট গভর্নর-এর স্বীকৃতি অর্জন করে সে দেশে ‘আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব সপ্তাহ’ নামে সম্মানিত হয়েছে। এই স্বীকৃতি অর্জনের ব্যাপারটা কিন্তু কম কালঘাম ছুটিয়ে হয়নি। এটা বাংলা ভাষার পক্ষে, বাঙালি জাতিসত্তার কাছে বিরাট অর্জন। মনে রাখতে হবে, দেশটা আমেরিকা, সহজে ছাড়পত্র মেলে না। বিশেষত এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হলে তো স্বীকৃতি পাওয়া আরও অনেক কঠিন।

বিশ্বজিৎ সাহার দোকান খোলা থাকে সকাল ন’টা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। যদি কেউ অফিস শেষ করে লং ড্রাইভে বই কিনতে আসে, তার তো আসতে রাত হবেই! সেই ভেবেই রাত সাড়ে এগারোটা অবধি খোলা। সমরেশ মজুমদার লিখেছেন, ‘৭৪ স্ট্রিটে একটা বাড়ির উপরে সাইনবোর্ডটা দেখতে পেয়েছিলাম, ‘মুক্তধারা’ বাংলায় লেখা। এটা বিশ্বজিতের বইয়ের দোকান।’ আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘এত দিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বাংলা বইয়ের মেলা করতে যে নিষ্ঠা ও শ্রম লাগে, তা সামান্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব, মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলের একাধিক শহরে তা আয়োজিত হয়। আমিও অন্তত চারটি শহরের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি এবং উপভোগ করেছি।’ গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, ‘বইমেলাকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক হবে বিশ্ববাঙালির প্রাণের মেলা। এই মেলায় যাঁরা যাবেন, তাঁরা রাজনৈতিক পরিচয়ের কথা ভাববেন না, ধর্মীয় পরিচয়ের কথাও না, কেবল ভাববেন তাঁরা বাঙালি। বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত, বিপন্ন বাঙালি এক হোক, এই মেলাকে কেন্দ্র করে।’

শেষ অবধি তাই একটা কথা মনে রাখতে হবে। বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা ফি বছর চায়ের কাপে তুফান তুলি, কিন্তু গায়ে গতরে খেটে তাকে প্রবাসে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় বিশ্বজিৎ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বজিৎ সাহা তাই বাংলা ভাষার স্বপ্ন, যে স্বপ্নের কোনও হেরে যাওয়া নেই।

Book Store
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy