Advertisement
E-Paper

তিনি এখন শুধু মুদ্রা, হোর্ডিং আর টি-শার্টে

বর্ণবৈষম্য নেই। কিন্তু শপিং মলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়লোক কৃষ্ণাঙ্গরাই সর্বাগ্রে। গরিবরা শহরের প্রান্তে, বেকারত্ব আর নেশাভাঙের অন্ধকারে। তাঁর দল, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতারা পকেট ভরতেই ব্যস্ত। এ সবের মধ্যেই গত মঙ্গলবার একশো বছরে পা দিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা।আফ্রিকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে গানে, কবিতায়, গল্পে-উপন্যাসে, থিয়েটার-সিনেমায়। অস্বীকার করা যাবে না, সেই পরিচয়ে একটু হলেও রোম্যান্টিক কল্পনা মিশে ছিল।

বোলান গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৭ ০১:০৮

কালো মানুষের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ‘আংকল টম’স কেবিন’-এর বাংলা অনুবাদে। অমলিন বাল্যের সেই দমচাপা কষ্টের প্রথম অনুভূতি ভুলে যাওয়ার নয়। আমাদের ইতিহাস পাঠ্যতালিকায় কোনও বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস ছিল না। ভূগোলে যেটুকু আফ্রিকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তার সবটাই জুড়ে ছিল বিষুবরেখা, অরণ্য, সমুদ্র, সিংহ, গন্ডার আর তিমি। মানুষ সেখানে ব্রাত্য ছিল। আর তাই রবেন আইল্যান্ড-এর নাম জানতে পারিনি।

আফ্রিকার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে গানে, কবিতায়, গল্পে-উপন্যাসে, থিয়েটার-সিনেমায়। অস্বীকার করা যাবে না, সেই পরিচয়ে একটু হলেও রোম্যান্টিক কল্পনা মিশে ছিল। কিন্তু বন্ধুরা মিলে যখন গলা খুলে গাইতাম ‘‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না/ পল রবসন নিগ্রো ভাই আমার...’’ বা আবৃত্তি করতাম ‘‘দাঁড়াও ঐ মানহারা মানবীর দ্বারে,/ বলো, ক্ষমা করো,—’’ সহমর্মিতায় খাদ থাকত না তখন। বাল্যের দমচাপা কষ্ট কখন যৌবনের সহমর্মিতায় রূপান্তরিত হয়েছে, টের পাইনি। সেই সহমর্মিতা একটা ঝড়ের প্রত্যাশা করত।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা তুমি...

২৭ বছর কারাবন্দিত্বের পরও, মেরুদণ্ড টানটান করে, এক কৃষ্ণবর্ণ মানুষ যখন বিশ্বের দরবারে নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বাধীনতার কথা, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলেন, তখন সমস্ত প্রত্যাশা যেন একটা রূপ পরিগ্রহ করে উঠে দাঁড়াল। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। সারা দুনিয়ার মানহারা মানুষের মানবাধিকারের কণ্ঠস্বর।

গত মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই শুরু হয়েছে ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষ। গত এক বছর ধরে গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়েই ছিল সেই স্মরণ-উৎসবের সূচনা। মৃত্যুর আগের ছয়-সাত বছর ধরে কেবল শারীরিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক ভাবেও তিনি হয়ে পড়েছিলেন অথর্ব। তাঁর নিজের দল ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ (এএনসি)-এর মধ্যেই নানা স্বার্থ-সংঘাত জেগে উঠছিল। কাকতালীয় ভাবেই হয়তো তাঁর মৃত্যুর (২০১৩) চার বছর আগে থেকেই ১৮ জুলাইকে জাতীয় ছুটির দিন ‘ম্যান্ডেলা ডে’ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পূর্বাপর রাজনৈতিক পর্যালোচনায় মনে হওয়া অসঙ্গত নয় যে এই ছুটির দিনের মধ্যে দিয়েই এএনসি তাঁকেই ছুটি দিতে চাইছিল। বানাতে চাইছিল ‘আইকন’। ক্রমশ আদর্শের ভারের বোঝা হয়ে উঠছিলেন তিনি। অথচ তাঁকে খাড়া করে না রাখলে দলের অস্তিত্বই বিপন্ন। কিন্তু খাড়া করে রেখেও কি সামাল দেওয়া যাচ্ছে? জন্মশতবর্ষে এ প্রশ্ন অনিবার্য।

তরুণীর টি-শার্টে ম্যান্ডেলা। ছবি: গেটি ইমেজেস

৭৭ বছর বয়সে যে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি হাল ধরেছিলেন, সেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে অভিবাসীদের দেশও বলা যায়। ১৬৫২ থেকে কেবল শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশ নয়, ‘সেটলার্স কলোনি’ বলে এর ঔপনিবেশিক চরিত্রে মিশে গিয়েছে বহু আপাত-স্ববিরোধী উপাদান। এক দিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে পশ্চিমি সমাজের অনেক গুণ, যেমন সময়ানুবর্তিতা, সাধারণ পরিচ্ছন্নতাবোধ, কোনও কাজকে ছোট মনে না করা— চোখে পড়ার মতো। অন্য দিকে, আজও সাদা-কালোর সামাজিক বিভাজন দৃশ্যত প্রকট। ধরা যাক কেপটাউন (অন্যতম রাজধানী)—ঔপনিবেশিক মিশ্র-সংস্কৃতির শহর। সেখানকার রাস্তাঘাট, বাড়ি, মানুষজন দেখলে, পশ্চিমি শহর বলে ভুল হতে পারে। এখানে ইউনিভার্সিটি অব কেপটাউন (ইউসিটি) ছিল সাদাদের জন্য নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, সেখানে সেই বৈষম্য খাতায়-কলমে ঘুচে গিয়েছে। কিন্তু সেখানে পড়তে হলে যে পরিমাণ অর্থ থাকা প্রয়োজন, তা কত জন কালো পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব? গত বছর এখানে সহিংস এক ছাত্র আন্দোলন হয়ে গেল। যে আন্দোলনের মূলে ছিল এই বিপুল খরচের বোঝা হালকা করার দাবি। সেই আন্দোলন গোটা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রভাব ফেলেছে। ওই দাবি সকলের।

কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্যই একমাত্র কারণ, তা-ও নয়। বহু গোষ্ঠী, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির দেশ। গাত্রবর্ণের বিভাজনই চার রকম: কালো, কালার্ড, ভারতীয় আর সাদা। এর মধ্যে প্রত্যেক বর্ণের মধ্যেও আছে নানা দেশগত, গোষ্ঠীগত, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র। বিদেশি শাসন আর অত্যাচারের সামনে সেই সব গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আর ভাষা-সংস্কৃতির বিভাজন তেমন প্রকট হয়ে ওঠে না। স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হলেই নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, গোষ্ঠী আধিপত্যের প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়।

প্রত্যেক সদ্য-স্বাধীন দেশের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধ দারিদ্রের সঙ্গে। সেই দারিদ্রের হাত ধরে আসা অন্যান্য সমস্যা। এরই মধ্যে পড়েছে বিশ্বায়িত অর্থনীতির চাপ। বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশি পণ্য পিছু হঠছে। শহরের সাজানো অঞ্চলে ঝাঁ-চকচকে মল-এ যা বিক্রি হয় তা হাতে করে বিক্রি করেন কালো মানুষেরা, তাঁদের ভূমিকা ওইটুকুই। কেনেন সমাজের ওপরতলার ভারতীয়, কালার্ড আর সাদারা। এঁরা সকলেই অভিবাসী।

এই বৈষম্যকে মূলধন করে জেগে উঠছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। ঔপনিবেশিকতাকে মুছে ফেলতে এমনকী কোন গাছ ভারতীয়রা বা ওলন্দাজরা বা ইংরেজরা এনেছিল, তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন দক্ষিণ আফ্রিকার লুপ্ত কোনও গাছের প্রজাতিকে গবেষণা করে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে। এই ভাবে পুরনো প্রাণী ফেরানোরও প্রচেষ্টা। উল্টো দিকে প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কাকে ‘সাউথ আফ্রিকান’ বলা হবে? কত পুরুষ এখানে থাকলে, তাকে ‘সাউথ আফ্রিকান’ ধরা যাবে? কোন ভাষাটিকে বলা হবে দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা?

মণিহারা: ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গ জনতার মিছিল।ছবি: গেটি ইমেজেস

কথা হয়েছিল বিউটি খোসা-র সঙ্গে। প্রায় ষাট বছর বয়স। কেপটাউনে বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করেন। মাসে রোজগার মেরেকেটে ৫০০০ র‌্যান্ড। সকাল ছ’টায় অন্ধকার থাকতে থাকতে বেরিয়ে সন্ধে পাঁচটার পর ফেরেন। শহরতলিতে ‘টাউনশিপ’-এ (কালো মানুষের বসতি অঞ্চল) থাকেন। প্রথমে শেয়ার ট্যাক্সি (মিনিবাস) ধরে রেলস্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে এসে বিভিন্ন বাড়ির কাজ সেরে, একই ভাবে ফিরতে হয়। এতে তাঁর দৈনিক খরচ পড়ে ৫০ র‌্যান্ড (১ র‌্যান্ড = প্রায় ৫ টাকা)। বিউটি ’৭২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। বাড়িতে বেকার গ্র্যাজুয়েট ছেলে, মেয়ে নিয়ে পাঁচটি খাই-মুখ। তিনি একাই রোজগেরে। পুত্রবধূ তার সন্তানটিকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে, বিউটি তা জানেন না। জলের ট্যাক্স, ইলেকট্রিসিটি বিল, গাড়িভাড়া দিয়ে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা খাবারের দাম জোগাড় করতে বিউটি নাজেহাল। তার ওপর আছে ডাক্তারের খরচ। নিজে নানা রকম ব্যাধিতে আক্রান্ত। মাসে-দু’মাসে এক বার ডাক্তারের কাছে যেতে গেলে ফি ৩০০ র‌্যান্ড। ওষুধের দাম আলাদা। বিউটি উত্তপ্ত স্বরে আমাকে বলেন, ‘‘তুমি এএনসি’র কাছে জিজ্ঞেস করো, ওরা বলবে, সব ফ্রি। লেখাপড়া ফ্রি। কিন্তু মাসে স্কুলের বাচ্চার জন্য আমার মেয়েকে ৩০০ র‌্যান্ড খরচ করতে হয়। ১১টা বিষয়। বই পাওয়া যায় দু’টো। তার ওপর খাতা, পেনসিল কিনতে হয়। টিফিনটাও নিজেদেরই নিয়ে যেতে হয়। একে নাকি ফ্রি বলে! তুমি ম্যান্ডেলার কথা বলছিলে না? ম্যান্ডেলাকে দেখেই তো আমরা সবাই এএনসি-কে ভোট দিয়েছি। ম্যান্ডেলা নেই। সেই এএনসি’ও নেই। নেতারা এখন যা গাড়ি চড়ে, যেমন ভাবে থাকে, দেখলে বিশ্বাস হয় না।’’

বললাম, কিন্তু ওরা তো তোমার মতো কালো মানুষ, সাদা তো নয়। এ কথায় একটু থমকান বিউটি। তার পর তীব্র স্বরে বলেন, ‘‘কালো তো বটেই। তবে কী জানো, ভারী ভারী নেতা, পয়সাওলা কালো মানুষ আর আমার মতো টাউনশিপের কালো মানুষে অনেক তফাত।’’

বিউটির কথাতে উঠে আসে টাউনশিপের জীবনযাপন। মূল কথা, কাজ নেই। যুবক ছেলেরা সারা দিন করবে কী? তারা নেশা করে, মারামারি করে, ঝগড়া করে আর কথায় কথায় রেপ করে। আরও আছে। ড্রাগ চালানে জড়িত হওয়া, জেল খাটা, অপরাধ-জগতে জড়ানোর জন্য নানা ধরনের দালালের খপ্পরে পড়া। অপ্রতুল জল, ঘেঁষাঘেঁষি বসবাস, ইলেকট্রিসিটির পয়সা দিতে না পারার জন্য কখনও অন্ধকারেও থাকা। বিউটি বলেছিলেন, ‘‘আমার মায়েরা যে জীবন কাটিয়েছেন, আমরা তার চেয়ে খারাপ জীবনে আছি। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য আরও খারাপ জীবন অপেক্ষা করছে।’’

গোটা দেশে গরিব কালো মানুষের জন্য যথাযথ কোনও গণপরিবহণ ব্যবস্থা নেই। নেই সুলভ স্বাস্থ্য পরিষেবা। স্বাধীন রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা আর বাস্তবে অনেক ফারাক। প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টাটা চোখে পড়া জরুরি ছিল।

কথা হয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত তিন পুরুষের অভিবাসী অধ্যাপক মহামেদ অধিকারীর সঙ্গে। এএনসি’র দুর্নীতি, চুরি, ঔদ্ধত্যে বিরক্ত অধ্যাপক লুকিয়ে রাখেননি তাঁর ক্ষোভ। ‘‘এরা নিজেদের পকেট ভরা ছাড়া আর কিছু করে না শুধু না, করতে চায়ও না। তুমি ম্যান্ডেলার কথা জিজ্ঞেস করছিলে। এখন দ্রুত কমে যাচ্ছে ম্যান্ডেলা-জাদু। এই প্রজন্মের মধ্যে কাজ করে না আর ওই জাদু। আমি নিশ্চিত, সামনের নির্বাচনে খুবই খারাপ করবে এএনসি।’’

ম্যান্ডেলার বন্দিত্ব এখনও ঘোচেনি। তিনি বন্দি আছেন ফাউন্ডেশনে, নোটের ছাপে, চায়ের কৌটোয়, আর অবশ্যই টি-শার্টের বুকে। কালো মানুষের নাগালের বাইরে।

আমাদের দীর্ঘ এক যাত্রায় গাড়ির চালক ছিলেন হেনরিক্স সুক্রি। কালার্ড। স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তাঁর বন্দিদশা, জেল পালিয়ে বর্ডার পেরিয়ে কী ভাবে আমেরিকায় পৌঁছন, সেখানে কিছু দিন পড়াশোনা করে আবার স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন, সেই সব কাহিনি বলছিলেন। শিক্ষিত, সমাজ-সচেতন মানুষ। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি। এই সুক্রি এক আশ্চর্য বর্ণবৈষম্যের গল্প বলেছিলেন। একটি সংস্থা পরীক্ষার জন্য কিছু সাদা ও কালো মানুষকে পথে নামিয়েছিল ভিক্ষা করতে। একই অঞ্চলে, কালোরা, সাদাদের অর্ধেকেরও কম ভিক্ষা পান।

কাহিনিটি দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজ-মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করে বলে আমার মনে হয়েছে। উল্টোটাও যে একেবারে দেখিনি, বলা যাবে না। এই প্রজন্মের বহু সাদা ছেলেমেয়ে নিজেদের ‘সাউথ আফ্রিকান’ মনে করে নানা রকম বৈষম্যবিরোধী সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত হয়।

কিন্তু এই ভাঙাগড়ার মধ্যে ম্যান্ডেলা কোথাও নেই। এটা বোধহয় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ছবি: কুনাল বর্মণ

South Africa Nelson Mandela নেলসন ম্যান্ডেলা Unrest T-Shirt
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy