মণিহারা: ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গ জনতার মিছিল।ছবি: গেটি ইমেজেস
কথা হয়েছিল বিউটি খোসা-র সঙ্গে। প্রায় ষাট বছর বয়স। কেপটাউনে বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করেন। মাসে রোজগার মেরেকেটে ৫০০০ র্যান্ড। সকাল ছ’টায় অন্ধকার থাকতে থাকতে বেরিয়ে সন্ধে পাঁচটার পর ফেরেন। শহরতলিতে ‘টাউনশিপ’-এ (কালো মানুষের বসতি অঞ্চল) থাকেন। প্রথমে শেয়ার ট্যাক্সি (মিনিবাস) ধরে রেলস্টেশন, সেখান থেকে ট্রেনে এসে বিভিন্ন বাড়ির কাজ সেরে, একই ভাবে ফিরতে হয়। এতে তাঁর দৈনিক খরচ পড়ে ৫০ র্যান্ড (১ র্যান্ড = প্রায় ৫ টাকা)। বিউটি ’৭২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। বাড়িতে বেকার গ্র্যাজুয়েট ছেলে, মেয়ে নিয়ে পাঁচটি খাই-মুখ। তিনি একাই রোজগেরে। পুত্রবধূ তার সন্তানটিকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে, বিউটি তা জানেন না। জলের ট্যাক্স, ইলেকট্রিসিটি বিল, গাড়িভাড়া দিয়ে প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা খাবারের দাম জোগাড় করতে বিউটি নাজেহাল। তার ওপর আছে ডাক্তারের খরচ। নিজে নানা রকম ব্যাধিতে আক্রান্ত। মাসে-দু’মাসে এক বার ডাক্তারের কাছে যেতে গেলে ফি ৩০০ র্যান্ড। ওষুধের দাম আলাদা। বিউটি উত্তপ্ত স্বরে আমাকে বলেন, ‘‘তুমি এএনসি’র কাছে জিজ্ঞেস করো, ওরা বলবে, সব ফ্রি। লেখাপড়া ফ্রি। কিন্তু মাসে স্কুলের বাচ্চার জন্য আমার মেয়েকে ৩০০ র্যান্ড খরচ করতে হয়। ১১টা বিষয়। বই পাওয়া যায় দু’টো। তার ওপর খাতা, পেনসিল কিনতে হয়। টিফিনটাও নিজেদেরই নিয়ে যেতে হয়। একে নাকি ফ্রি বলে! তুমি ম্যান্ডেলার কথা বলছিলে না? ম্যান্ডেলাকে দেখেই তো আমরা সবাই এএনসি-কে ভোট দিয়েছি। ম্যান্ডেলা নেই। সেই এএনসি’ও নেই। নেতারা এখন যা গাড়ি চড়ে, যেমন ভাবে থাকে, দেখলে বিশ্বাস হয় না।’’
বললাম, কিন্তু ওরা তো তোমার মতো কালো মানুষ, সাদা তো নয়। এ কথায় একটু থমকান বিউটি। তার পর তীব্র স্বরে বলেন, ‘‘কালো তো বটেই। তবে কী জানো, ভারী ভারী নেতা, পয়সাওলা কালো মানুষ আর আমার মতো টাউনশিপের কালো মানুষে অনেক তফাত।’’
বিউটির কথাতে উঠে আসে টাউনশিপের জীবনযাপন। মূল কথা, কাজ নেই। যুবক ছেলেরা সারা দিন করবে কী? তারা নেশা করে, মারামারি করে, ঝগড়া করে আর কথায় কথায় রেপ করে। আরও আছে। ড্রাগ চালানে জড়িত হওয়া, জেল খাটা, অপরাধ-জগতে জড়ানোর জন্য নানা ধরনের দালালের খপ্পরে পড়া। অপ্রতুল জল, ঘেঁষাঘেঁষি বসবাস, ইলেকট্রিসিটির পয়সা দিতে না পারার জন্য কখনও অন্ধকারেও থাকা। বিউটি বলেছিলেন, ‘‘আমার মায়েরা যে জীবন কাটিয়েছেন, আমরা তার চেয়ে খারাপ জীবনে আছি। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য আরও খারাপ জীবন অপেক্ষা করছে।’’
গোটা দেশে গরিব কালো মানুষের জন্য যথাযথ কোনও গণপরিবহণ ব্যবস্থা নেই। নেই সুলভ স্বাস্থ্য পরিষেবা। স্বাধীন রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা আর বাস্তবে অনেক ফারাক। প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টাটা চোখে পড়া জরুরি ছিল।
কথা হয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত তিন পুরুষের অভিবাসী অধ্যাপক মহামেদ অধিকারীর সঙ্গে। এএনসি’র দুর্নীতি, চুরি, ঔদ্ধত্যে বিরক্ত অধ্যাপক লুকিয়ে রাখেননি তাঁর ক্ষোভ। ‘‘এরা নিজেদের পকেট ভরা ছাড়া আর কিছু করে না শুধু না, করতে চায়ও না। তুমি ম্যান্ডেলার কথা জিজ্ঞেস করছিলে। এখন দ্রুত কমে যাচ্ছে ম্যান্ডেলা-জাদু। এই প্রজন্মের মধ্যে কাজ করে না আর ওই জাদু। আমি নিশ্চিত, সামনের নির্বাচনে খুবই খারাপ করবে এএনসি।’’
ম্যান্ডেলার বন্দিত্ব এখনও ঘোচেনি। তিনি বন্দি আছেন ফাউন্ডেশনে, নোটের ছাপে, চায়ের কৌটোয়, আর অবশ্যই টি-শার্টের বুকে। কালো মানুষের নাগালের বাইরে।
আমাদের দীর্ঘ এক যাত্রায় গাড়ির চালক ছিলেন হেনরিক্স সুক্রি। কালার্ড। স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তাঁর বন্দিদশা, জেল পালিয়ে বর্ডার পেরিয়ে কী ভাবে আমেরিকায় পৌঁছন, সেখানে কিছু দিন পড়াশোনা করে আবার স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন, সেই সব কাহিনি বলছিলেন। শিক্ষিত, সমাজ-সচেতন মানুষ। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি। এই সুক্রি এক আশ্চর্য বর্ণবৈষম্যের গল্প বলেছিলেন। একটি সংস্থা পরীক্ষার জন্য কিছু সাদা ও কালো মানুষকে পথে নামিয়েছিল ভিক্ষা করতে। একই অঞ্চলে, কালোরা, সাদাদের অর্ধেকেরও কম ভিক্ষা পান।
কাহিনিটি দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজ-মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করে বলে আমার মনে হয়েছে। উল্টোটাও যে একেবারে দেখিনি, বলা যাবে না। এই প্রজন্মের বহু সাদা ছেলেমেয়ে নিজেদের ‘সাউথ আফ্রিকান’ মনে করে নানা রকম বৈষম্যবিরোধী সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত হয়।
কিন্তু এই ভাঙাগড়ার মধ্যে ম্যান্ডেলা কোথাও নেই। এটা বোধহয় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ছবি: কুনাল বর্মণ