Advertisement
E-Paper

ক্যাশ ওঠেনি তো কী, সুপারমুন উঠেছে

দিচ্ছে! আবার দিচ্ছে!’ জয়ধ্বনি উঠল সামনে থেকে। তার পর আবার শোনা গেল ‘বেরচ্ছে, বেরচ্ছে।’ কেঁচোর মতো কুঁকড়ে থাকা অনেকগুলো লোকের লাইনটা একটু যেন নড়েচড়ে উঠল।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

দিচ্ছে! আবার দিচ্ছে!’ জয়ধ্বনি উঠল সামনে থেকে। তার পর আবার শোনা গেল ‘বেরচ্ছে, বেরচ্ছে।’ কেঁচোর মতো কুঁকড়ে থাকা অনেকগুলো লোকের লাইনটা একটু যেন নড়েচড়ে উঠল। গাঁইয়া টাইপ দু’-এক জন উবু হয়ে বসেছিল, তারা উঠে দাঁড়াল। এরই মধ্যে আমার সামনের বেঁটে লোকটা স্বগতোক্তি করল, ‘কত আর দেবে, এক্ষুনি তো ফুরিয়ে যাবে।’ এক পা এক পা করে যারা একেবারে সামনের দিকে পৌঁছেছে তাদের চোখেমুখে একটা হিংস্র তৃপ্তি। তারা পাবেই। তার পরে যারা, তাদের হাফ আশা, হাফ হতাশা। আরও পরে গুণিতক হারে বেড়ে যাওয়া শূন্যতা। আমি সেইখানে সবার মতো নির্বিকার মুখেই দাঁড়িয়ে আছি। চটি পরা পা উসখুস করলেও শরীর থেমে আছে। কারণ সামনে আরও অনেক শরীর থমকে আছে। সবাই ধৈর্য ধরে আছে। গন্ডগোল করছে না। সবাই টেনশনে। অথচ কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে না। সাম্প্রতিক কালে মানুষের লাইনে এটা অভিনব ঘটনা। ম্যাজিকবলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হঠাৎ ছাড়া পেয়ে গেলে যেমন দেখায়, তেমনই এক জন বেরিয়ে এল এটিএম থেকে। হিরো। অনেকগুলো ময়লা একশো টাকার নোট ভরা হাতের দুটো আঙুল ‘ভি’-র মতো করে সবাইকে দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। পরের লোক অদৃশ্য কাউকে ষাঁড়ের মতো গুঁতিয়ে ঢুকে গেল কাচের দরজা ঠেলে।

খুব দূর কোথাও যাই না। কলকাতাতেই ঘোরাঘুরি করি, অল্প টাকায় মেট্রোতে, অটোতে দিব্যি হয়ে যায়। বাকিটা হেঁটে। এখন সেটাও করছি না বিশেষ। কারণ ওই একটাই। ক্যাশ নেই মোটে। যেখানে যেতে, যা দেখতে কোনও খরচ হয় না, সাধারণত সেখানেই যাই। তা-ই দেখি। এই সে দিন উত্তর কলকাতার নতুন বাজারে ঢুকে একটা মস্ত থামওয়ালা লাল বাড়ির আধখোলা গেটের মধ্যে সাদা হাঁস ঘুরছে, দেখছিলাম। আজ এটিএম-এর লাইন দেখছিলাম। অচেনা এক জন আমার কাছে এসে নিচু গলায় প্রস্তাব দিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আমার হাতে অনেক সময়। তার দুটো কার্ড। একটা দিয়ে সে টাকা তুলবে। একটা দিয়ে আমি। দু’হাজার দিচ্ছে। আমি একশো পাব। স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। পকেটে হাত দিয়ে তার কার্ডটা এক বার ছুঁয়ে দেখে নিলাম। হালকা পাপবোধ কাজ করছিল। আমার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে সেই লোক। মাঝে মাঝে তার নিশ্বাস পড়ছে আমার ঘাড়ে। সামনের লোক আবার এগিয়েছে। অমনি আমিও। এই এগোনোটার বিশেষত্ব আছে। পুজোয় ট্রাফিক জ্যামে ফেঁসে গেলেও আশা করা যায় এক সময় বাস এগোবে। দেরি হবে, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে। এখানে তা নয়। ক্যাশবাক্সের দোরগোড়ায় পৌঁছেও এতটা অপেক্ষা করাটা বেকার হয়ে যেতে পারে। খচখচানিটা সবার মধ্যেই রয়েছে নিশ্চয়ই। মনে মনে একটা হিসেব করছিলাম। শুনেছিলাম কিছু দিন আগে মথুরায় কী একটা ট্রেনের ট্রায়াল রান হয়েছে। স্পিডে সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। তা হলে এখন আমাদের স্পিড কত? উঁকি মেরে এটিএমটা দেখলাম। তিরিশ গজ দূরত্ব হবে। এক ঘণ্টা এমনি দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন মিনিটে এক ইঞ্চিও নয়। খুব শক্ত অঙ্ক। ভাবা ছেড়ে দিলাম। টাকা পেলে তার পর করা যাবে।

যত ক্ষণ রোদ ছিল, বসন্তের মতো আবহাওয়া ছিল। এখন একটু শীত শীত। আগে চার পাশটা চুপচাপ ছিল, লোকজন কথাবার্তা বলছিল না। এখন বলছে। টাকা নিয়ে সরকারের সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়েই হচ্ছে। মতের অমিলও কানে আসছিল। কিন্তু ঝগড়াঝাঁটি, গলা চড়ানো— এ সব নয়। সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সবাই অমর্ত্য সেন, সবাই কিরীটী রায়। ঠিক না ভুল, উচিত হয়েছে না হয়নি, তা নিয়ে নিজস্ব বক্তব্য কারুর নেই। অন্য চ্যানেল, খবরের কাগজ বা সোশাল হনু কী বলেছে তার দেদার সাপ্লাই আসছে ক্রমাগত। যারা সেফ তারা অম্লানবদনে বোকা বোকা রসিকতা করছে। মুশকিলে পড়া লোকজন চটে গিয়ে পালটা গালাগাল দিচ্ছে। ক্যাশ পাক না পাক, শত্রু জুটেছে অনেকের। আমাদের লাইনে এ সব হচ্ছে না। সবাই ইন দ্য সেম বোট। একটু পরে টাকা ফুরিয়ে গেলে শেষ ভাগ্যবানের পরের সবাই তাঁকে দোষ দেবেন না, বোঝাই যাচ্ছে। এক বিজয়ী যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘আছে, আছে। অনেক আছে।’ কী করে জানলেন কেউ জানে না। কিন্তু সবাই আশ্বস্ত।

এক জনকে পাওয়া গেল, যিনি উত্তেজনা ছড়িয়ে চলেছেন। স্ক্রিনে। পাশেই দেওয়ালের ফোকরে একটা ছোট দোকান। কিছুই প্রায় নেই। একটা টিভি চলছে। চড়া সাজগোজ করে অ্যাংকর কথা বলে যাচ্ছেন গলার শির ফুলিয়ে। ‘মানুষ, আমাদের সমস্ত মানুষ, যাঁদের টাকা আছে কিন্তু সেই টাকা পাচ্ছেন না মানুষ, সেই সব লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ— আমাদের প্রতিনিধি মানস সঙ্গে আছেন। মানস তুমি বলো ওখানে মানুষের কী অবস্থা, মানস।’ মাইক হাতে প্রতিনিধিকে দেখা গেল, অ্যাংকরের প্রশ্ন তাঁর কানে পৌঁছনোর আগেই স্ক্রিন ঝাপসা ঝিরিঝিরি। ওই দিকে মুখ ঘুরিয়ে সবাই তাকিয়েছিল, একসঙ্গে সবাই আবার সামনে তাকাল। আমার ঠিক পিছনেই শুনলাম, ‘যত্ত সব ফালতু বকওয়াস।’ লাইন এগোতেই টিভি পিছনে। দোকানদার এসেছে। তাকে বলা হচ্ছে, ‘জ্যোতিষের চ্যানেলটা দিন তো দেখি মাল কী বলে।’

‘অ্যামেরিকায় আজ বিরাট চাঁদ উঠেছে, এত বড় নাকি কখনও ওঠেনি, এখানেও দেখা যাবে।’ কে যেন বলল। অমনি সবাই আকাশে চাঁদ খুঁজতে লাগলাম। একটু পরেই ‘ওই তো ওই তো’ বলতেই তাকে দেখা গেল একটা বাড়ির মাথায়। ঝাপসা, লাল, ধোঁয়াটে চেহারা। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সুপার মুন!’ কেউ বলল, কিন্তু অন্যেরা সেটা পাত্তা দিল না। ক্যাশ না তুলতে পারলেও, চাঁদ তো উঠবেই। এ দিকে এক খুব বয়স্ক, অসুস্থ চেহারার মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন, হাতে পাসবই। ‘টাকা দিচ্ছে কি? দেবে?’ দুর্বল গলায় বললেন। জিজ্ঞেস করতেই বুঝলাম যা ভেবেছি ঠিক তা-ই। ওঁর কোনও এটিএম কার্ডই নেই, বোঝেনও না কিছু। লাইনে অপেক্ষা করা অনেকেই ব্যাপারটা দেখছে। কী করা উচিত কেউ জানে না। একটা বেশ স্মার্ট ঝকঝকে মেয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘দাদু, আপনি দাঁড়ান তো, আর পাসবইটা পকেটে ঢোকান।’ নিজে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে মেয়েটা বলল, ‘যে যা পারেন দিন না, পকেটে পাঁচ-দশ কিছু তো আছেই। এই আমি কুড়ি টাকা দিলাম।’ বলতেই সবাই পকেটে হাত দিল, ব্যাগ খুলে দেখতে লাগল আচমকা ভীষণই দামি ময়লা কাগজগুলোকে। ‘অসুবিধে করে দেবেন না, প্লিজ।’ হাসিমুখে বলল মেয়েটা। দু’হাতের তালুতে একটা রুমাল পেতে ধরে সবার কাছে যাচ্ছে সে। সবাই দিচ্ছে। আনন্দ করে। দেখে মনেই হচ্ছে না একটু পরেই নেমে আসতে পারে আতঙ্কের শাটারটা। সদ্য টাকা পাওয়া এক জন দিল একশো টাকা। মেয়েটা চিৎকার করে উঠল, ‘সুপার সুপার দাদা, ব্রিলিয়ান্ট!’ আমার সামনে রুমাল পাতল আজকের পরি। আমি করুণ মুখে হাসলাম। কিছুই নেই। ‘আমি দিচ্ছি, এটা ওঁর আর এটা আমার।’ বলল আমার পকেটের এটিএম কার্ডের মালিক। দুটো পঞ্চাশের নোট। ব্যালে ডান্সারের মতো দৃপ্ত অথচ নরম পদক্ষেপে মেয়েটা এগোতে লাগল লাইন ধরে, ক্যাটারাক্ট-ক্লান্ত বৃদ্ধ কী দেখলেন জানি না। আমি স্পষ্ট দেখলাম, চাঁদের সুপার আভার জন্য অপেক্ষা না করে সদ্য জ্বলে ওঠা রাস্তার আলো জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল ছয় ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি সাইজের, মামুলি কাপড়ে তৈরি, ক্যাশ রিচ এক ম্যাজিক কার্পেট।

suvolama@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy