Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Novel

novel: মায়াডোর

ফোন রেখে ফের শুয়ে রইল উত্তীয়। ফোন রাখামাত্র ডাক থামিয়েছে বেয়াড়া ঘোড়াটা, একমনে ঘাস খাচ্ছে।

ছবি: বৈশালী সরকার।

ছবি: বৈশালী সরকার।

অভিনন্দন সরকার
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৭:২১
Share: Save:

মঞ্জীরা জলের গ্লাসের দিকে ফিরেও তাকাল না, “ওই যে, আপনাদের সার্ভিস ম্যানেজার, কী নাম... উত্তীয় মজুমদার! যা তা অপমান করেছেন আমাকে!”

গৌরগোপালও হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “হাউ ডেয়ার হি?”

মঞ্জীরা একটু থতমত খেয়ে গেল, তার পর বলল, “আপনি কী স্টেপ নেবেন নিন, আমি অপেক্ষা করছি।”

গৌরগোপাল অত্যন্ত সিরিয়াস স্বরে বলেছিলেন, “উনি কী করেছেন ডিটেলে বলুন। আমার বুঝতে সুবিধে হবে।”

“উনি এক জন অত্যন্ত অভদ্র লোক। আমাকে বলছেন যেন কালো টিপ পরি এ বার থেকে, যেন আমি চুল তেল দিয়ে টানটান করে বেঁধে না রাখি...” কথা শেষ করতে পারেনি মঞ্জীরা, সহজাত কুণ্ঠা তাকে থামিয়ে দিয়েছিল।

বিস্মিত গৌরগোপাল বললেন, “এ সব কী হচ্ছে আমার ব্রাঞ্চে? কাস্টমার কালো না লাল টিপ পরবে, সে কোমর ছাপানো চুল রাখবে না কি ববছাঁট, সেটা তো তার পার্সোনাল প্রেফারেন্স। ব্যাঙ্কের সার্ভিস ম্যানেজার সেটা ডিসাইড করে দেবেন? এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে?”

শেষ বাক্যটা বলার সময়ে টেবিল চাপড়ে উঠলেন গৌরগোপাল। তার ফরসা থলথলে গাল উত্তেজনায় থরথর কাঁপছে, তিনি ড্রয়ার থেকে রাইটিং প্যাড বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন, “আপনি রিটেন কমপ্লেন করুন, আমাকে আড্রেস করেই লিখুন। তার পর আমি ওই উত্তীয় মজুমদারকে দেখাচ্ছি কত ধানে কত চাল।”

মঞ্জীরা অবশ্য লিখিত অভিযোগ করেনি। মুহূর্তের উত্তেজনায় চেঁচামেচি করে ফেলেছিল বটে কিন্তু এটা তার আসল চরিত্র নয়, কারও বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কমপ্লেন করার কথা ভাবতেও পারে না সে।

মঞ্জীরা চলে আসার আগে ম্যানেজারকে বলে এসেছিল, “আমার মায়ের কেসটা অনেক দিন আটকে আছে, কাইন্ডলি এফিশিয়েন্ট কাউকে দায়িত্ব দিন। ওই উত্তীয় ভদ্রলোককে সামহাউ আমার খুব একটা ডিপেন্ডেবল মনে হয় না।”

মেলটা এসেছিল ঠিক পাঁচ দিনের মাথায়। স্নিগ্ধা চ্যাটার্জির পোস্ট রিটায়ারমেন্ট ক্লেমের আশি শতাংশ ফান্ড ব্যাঙ্ক মঞ্জুর করেছে। বাকিটুকুও হয়ে যাবে, বিনীত ভাবে মাস খানেক সময় চেয়ে
নিয়েছে ম্যানেজমেন্ট।

মঞ্জীরার পক্ষে এর থেকে বড় রিলিফ আর সম্ভব ছিল না। বাবার জমানো টাকা আর নিজের সামান্য মাইনে নিয়ে মাসকাবারি খরচা চালাতে সে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিল।

বিকেলের দিকে এক বার ব্যাঙ্কে গেল মঞ্জীরা। ছুটির হাওয়া শেষ বেলার ব্যাঙ্কে। স্টাফরা কাজ গোটাতে ব্যস্ত।

গৌরগোপাল নিরিবিলিতে বসে মোবাইল গেম খেলছিলেন। মঞ্জীরা দরজা ঠেলে উঁকি দিয়েছিল, “আসতে পারি স্যর?”

গেম পজ় করে অমায়িক হাসি হেসেছিলেন গৌরগোপাল, “আরে আসুন আসুন, কী সৌভাগ্য। বসুন। চা বলি একটু?”

“না না, তার দরকার নেই। এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনাকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে যাই। আমার মায়ের কেসটা...”

“ও ইয়েস। তবে আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। ওই সার্ভিস ম্যানেজারই যা করার করেছে। ছোকরার এলেম আছে। কাজটা সহজ ছিল না, ছুটোছুটি করতে হয়েছে, ইউনিয়ন সামলাতে হয়েছে, তাও নাকি সুবিধে হয়নি। শেষমেশ কার একটা সোর্সে সিজিএম-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে তবে কাজ হাসিল হয়েছে,” একটু থেমে গৌরগোপাল বললেন, “আপনি বুঝতে পারছেন তো কার কথা বলছি? সেই যে, যিনি আপনাকে লাল টিপ পরতে বলেছিলেন।”

মঞ্জীরা নতমুখে মৃদু হেসে বলেছিল, “লাল নয় স্যর, কালো।”

খালি হয়ে আসা ব্যাঙ্ক ক্যাম্পাসে দেরাজে চাবি দিয়ে ব্যাগ কাঁধে বেরোনোর উদ্যোগ নিচ্ছিল উত্তীয়।

মঞ্জীরা তার কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, “এই যে, শুনছেন?”

উত্তীয় চোখ তুলে তাকিয়েছিল। দারুণ উদাসীন ভাব, “বলুন।”

মঞ্জীরা ঠোঁট চেপে হাসল, “ধন্যবাদ।”

উত্তীয় বাইরে বেরিয়ে এল, “আরে না না, আপনার মা আমাদের ব্যাঙ্কের এক্স-এমপ্লয়ি, তার ওপর প্রথম দিন থেকে এই ব্রাঞ্চের কাস্টমার... এটুকু কমিটমেন্ট সব সময়েই এক্সপেক্ট করতে পারেন আমাদের কাছে।”

কথায় কথায় এক তলায় নেমে এসেছে দু’জনে। ব্যাঙ্ক এলাকাটা জমজমাট। মুহূর্তে এক নাগরিক সন্ধ্যা গিলে নিয়েছিল দু’জনকে।

মঞ্জীরা বলল, “আমি ভেবেছিলাম আপনি রেগে আছেন খুব।”

“ভুল কিছুই ভাবেননি। খুব রেগে আছি। আর এখুনি পেটে কিছু না পড়লে রাগের চোটে ডায়নামাইটের মতো ফেটে পড়ব আমি।”

উত্তীয়র কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল মঞ্জীরা। তার মনে পড়ল না, কত মাস পরে আজ তার হাসি পাচ্ছিল।

উত্তীয় সামনে ঝুঁকে নিচু গলায় বলেছিল, “আপনার তাড়া আছে?”

“ইয়ে, মানে...” দোনোমনা করছিল মঞ্জীরা।

উত্তীয় সেই দ্বিধা গায়ে না মেখেই বলেছিল, “বুঝেছি, তাড়া নেই, তাই তো? আমারও নেই,” তর্জনী তুলে রাস্তার অন্য পারে একটা কাফেটেরিয়ার দিকে দেখিয়েছিল উত্তীয়, “ওই কাফেটা দেখছেন, দারুণ কোল্ড কফি বানায়। এক বার খেলে ভুলতে পারবেন না। নেশা হয়ে যাবে। আরে বাবা, থ্যাঙ্কস হোক বা সরি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর বলতে
আছে ম্যাডাম?”

“ও দিদি, ও দিদি, ল্যান্সডাউন পেরিয়ে গেল তো!” কন্ডাক্টরের চিৎকারে সংবিৎ ফিরে পেল মঞ্জীরা। ইশ! এক বাস লোক তার দিকে তাকিয়ে। অপ্রস্তুতের একশেষ। মঞ্জীরা প্রায় লাফিয়ে নামল বাস থেকে। দুটো স্টপেজ উল্টো হেঁটে তাকে অফিস ফিরতে হবে। সামনের বড় মাল্টিপ্লেক্সে নায়কের প্রমাণাকৃতি কাটআউটের পাশে সূর্য ডুবছে।

উত্তীয়কে নিজের হাতে জীবন থেকে ছেঁটে ফেলেছে মঞ্জীরা, তবুও কেন প্রতি মুহূর্তে তার স্মৃতিরাই ঘিরে থাকে তাকে! একলা হাঁটার এই দশটা মিনিটেও কেন এই আশ্চর্য অভাববোধ!

হঠাৎই ভীষণ ক্লান্ত লাগে মঞ্জীরার। পা টেনে টেনে হাঁটছে সে, যেন দশমনি ওজন চাপিয়ে দিয়েছে কেউ তার কাঁধে। তার মনে পড়ে গেছে, আজ একুশ দিন হয়ে গেল এক বারের জন্যও উত্তীয়কে দেখেনি সে।

কেমন আছে ছেলেটা? কী করে আজকাল?

উত্তীয় আর অভিরাজ মুখোমুখি বসে আছে। অভিরাজের এই বসার ঘরটা জুঁই খুব যত্ন করে সাজিয়েছিল এক সময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়ি পুরনো হলে মানুষের ঘর সাজানোর উৎসাহে ভাটা পড়ে, ধুলো জমে যায় শখের আসবাবে।

জুঁইয়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার ঘর সাজানোর তাগিদ। ঘর সাজানোর উপকরণ জোগাড় করতে শহরের শপিং মলগুলো চষে বেড়ায় জুঁই। তা ছাড়াও শীতকালের নানা মেলা থেকেও জুঁই প্রচুর শো পিস কেনে। বসার ঘর বোঝাই হয়ে যায়। আর আছে হাজারো অর্কিড আর বাহারি অ্যাকুয়ারিয়াম।

বসার ঘরের ফল্‌স সিলিং থেকে শৌখিন আলো জ্বলছে কম পাওয়ারের। উত্তীয় একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে।

একটা কালো মাছ প্রচণ্ড রেগে আছে, তার দাপটে বাকি লাল নীল সোনালি মাছেরা তটস্থ হয়ে আছে এক কোণে। কেউ কাছে যেতে চাইলেই জল তোলপাড় করে ছুটে আসছে কালো শরীর আর রুপোলি পাখনার রাক্ষুসে মাছ।

অভিরাজ একটা ম্যাগাজ়িন হাতে সোফায় বসে ছিল। সে মুখ তুলে উত্তীয়কে জিজ্ঞেস করল, “তুই ময়দানে কী করছিলি সেটা কিন্তু বললি না।”

হতাশায় উত্তীয় দু’হাতে মুখ ঢাকল। প্রশ্নটা অভিরাজ এই নিয়ে তৃতীয় বার করল। আগের দু’বার উত্তর দিয়েছে উত্তীয়। অভিরাজ তৎক্ষণাৎ ভুলে গেছে। নিউরোলজিস্ট বলেছিলেন, ইমিডিয়েট আর শর্ট টার্ম মেমারি লস হচ্ছে অভিরাজের, অ্যাক্সিডেন্টের ফলে ঘটে যাওয়া হেড ইনজুরির প্রভাব। তাকে সামলে-সুমলে রাখা বড় সমস্যা। কাহাঁতক একই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়?

উত্তীয় আজ অফিস যায়নি। এ রকম মাঝে মাঝেই করছে সে। সকালে উঠে উৎসাহ পায় না কিছুতেই। ব্যাঙ্কের কাজ, একটু এ দিক-ও দিক হলেই সমস্যা, পুরো অফিসের হিসেব মিলবে না। তাই
এই মানসিক অবস্থায় অফিস যাওয়া সঙ্গত মনে হয়নি তার। দীর্ঘ সময় বিছানায় গড়াগড়ি দিয়েছিল উত্তীয়, তার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেট্রো ধরে ময়দানে এসেছিল।

সপ্তাহের মাঝামাঝি, ময়দান বেশ খালি খালি। সকাল থাকতেই ক্লাবগুলো নিজেদের প্র্যাকটিস সেরে নিয়েছে, ঘরে ফিরে গেছে উঠতি খেলোয়াড়ের দল।

এই সময় ময়দানের আসল রূপ বুঝতে পারা যায়। মস্ত এলাকা জুড়ে সবুজ গালিচা বিছানো, দু’-এক জন ভবঘুরে ইতিউতি ঘুরে বেড়ায়। কয়েকটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে চোখ বুজে বিশ্রাম নেয় হাড় জিরজিরে ঘোড়ারা।

উত্তীয়র চেহারায় গত দু’সপ্তাহে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এসেছে। দাড়গোঁফ বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নিজের প্রতি অযত্ন। রাতে ঘুম নেই, খাওয়াদাওয়াও প্রায় বন্ধ। সব মিলিয়ে তাকে আজকাল বিরহী প্রেমিকের মতো দেখায়।

‘বিরহী’ শব্দের অর্থ প্রিয় মানুষের সংস্রব বর্জিত পুরুষ, সেই অর্থে তাই উত্তীয়কে বিরহী বলা যায় না। সে প্রিয়জন দ্বারা পরিত্যক্ত পুরুষ, তাকে ব্যর্থ প্রেমিক বলা যেতে পারে।

উত্তীয় সেই অবেলায় ময়দানের ঘাসে চিৎপাত হয়ে শুয়েছিল। আজ আকাশ যেন বড় বেশি নীল, জগৎ আলোয় আলো। সূর্য দেখা যাচ্ছে না। প্রখর নীলের কিছুটা জায়গা উজ্জ্বল সাদা হয়ে আছে।

উত্তীয় বেশ কিছুটা সময় এ ভাবেই শুয়ে রইল সেই সবুজ মখমলে। এরই মধ্যে অফিস টাইম পেরিয়ে গেলে গৌরগোপাল ফোন করলেন এক বার, অম্লান মুখে উত্তীয় বলল, “পেটের অবস্থা শোচনীয়, স্যর। আজ আর তাই বেরোনোর রিস্ক নিলাম না।”

“কী ভয়ানক কথা উত্তীয়! গত সপ্তাহেই তো দু’দিন পেটের সমস্যায় কাবু হয়ে রইলে। আজ আবার! না, না, এই বয়সে পেটের এমন হাল... এ তো ভাল কথা নয়। ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েছ কিছু?”

উত্তীয় ঘাসের মধ্যেই আড়মোড়া ভাঙল, “হ্যাঁ, স্যর, দেখিয়েছি। বেড রেস্ট নিতে বলেছেন। বলেছেন কোনও ভাবেই যেন বাড়ির বাইরে না বেরোই।”

“কী মুশকিলে ফেললে বলো দেখি। ও দিকে সাহানা আর মিস্টার দাশগুপ্তও ডুব মেরেছেন। ব্যাঙ্ক চালানোই যে দুষ্কর হয়ে যাবে ভায়া!”

উত্তীয় চুপ করে রইল, কিন্তু তার কাছাকাছি গাছে বাঁধা ঘোড়াটা হঠাৎই তীব্র স্বরে ডেকে উঠল।

গৌরগোপাল ফোনের ও পারে চমকে উঠলেন, “এই উত্তীয়! তুমি কোথায় বলো তো। ঘোড়া
ডাকছে কেন?”

উত্তীয় বিরক্ত চোখে ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে বলল, “টিভিতে সিনেমা দেখছি স্যর। ম্যাকেনাস গোল্ড। রেড ইন্ডিয়ানদের সিনেমা তো। সারা ক্ষণই ঘোড়া ডাকছে। আমি মিউট করে দিচ্ছি, সরি স্যর।”

“ওহ! কিন্তু তুমি ভাই ওষুধপত্র খেয়ে জলদি সুস্থ হও। কাল জয়েন কোরো, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মাসের শুরু, সিনিয়র সিটিজ়েনরা সব কাতারে কাতারে আসছেন, তুমি তো জানো কী পরিস্থিতিটা হয় এখন। আমি রঘুকে বলে টয়লেট পুরো ঝকঝকে করে রাখব, ফিনাইল-টিনাইল ঢেলে একেবারে... আরে মিউট করলে না টিভিটা? ঘোড়া তো ডেকেই চলেছে।”

ফোন রেখে ফের শুয়ে রইল উত্তীয়। ফোন রাখামাত্র ডাক থামিয়েছে বেয়াড়া ঘোড়াটা, একমনে ঘাস খাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE