Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Novel

ডানায় ডানায়

ওদের আনন্দ দেখে ভাল লাগে তমার। মনে হয়, ওই বয়সে ফিরে যেতে পারলে ভাল হত।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

রূপক ঘটক
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২১ ০৭:২০
Share: Save:

ভেবেই হাসি পেয়ে যায় তমার। ভাবনার একটা সীমা থাকা দরকার। তার সামনে একাগ্রচিত্তে যে লোকটা রুটি-তরকারি খেয়ে যাচ্ছে, সে ভাল হতে পারে, খারাপও হতে পারে, কিন্তু নীচ নয় বলেই মনে হল ওর। খাওয়ার পর টেবিল থেকে নিজেই দু’জনের থালা বাটি সরিয়ে বেসিনের নীচে নামিয়ে দিল তমা। মুখ ধোয়ার সময় চোখে, মুখে, ঘাড়ে জল দিল। বেশ তরতাজা লাগল। নীচ থেকে একটা হাসির হুল্লোড় ভেসে এল। ওরা নিশ্চয়ই ফের তুষারের পিছনে লাগছে। বেচারা ওদের সঙ্গে আড্ডা না দিয়ে ঘুমোচ্ছিল, উঠে দেখে মেয়েগুলো ওর চুলে ঝুঁটি বেঁধে, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখিয়ে রেখেছে। নাদুসনুদুস চেহারার ছেলেটা বেশি রাগতেও পারে না। আর ওরা প্রবল বিক্রমে তার পিছনে লাগছে। আসলে এই সব শিক্ষামূলক ভ্রমণে আসলে বিনোদনটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।

ওদের আনন্দ দেখে ভাল লাগে তমার। মনে হয়, ওই বয়সে ফিরে যেতে পারলে ভাল হত। অনেক কিছু নতুন করে গড়া যেত, কিছু পদক্ষেপ শুধরে নেওয়া যেত। মুখ ধুয়ে ডাইনিংয়ে সেই টেবিলের সামনে এসে দেখল, চারিদিক ভোঁ-ভাঁ। কেউ কোথাও নেই৷ জীবেশের দরজা বন্ধ। তার দরজা ভেজানো। বল্লালের দরজার পাল্লা খোলা। দোতলাটা বেশ চুপচাপ। একটুও বিচলিত না হয়ে নিজের চেয়ারটাতেই বসল তমা। ভাবল, এক বার ফোন করবে কি না গরিমাকে। এখানে আসার পর ও যেন কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে। চুপচাপ কিছু ভাবছে। তবে দুশ্চিন্তা করছে না, সে এটুকু বুঝছে। কিন্তু বল্লাল কী করে বুঝছে? এক বার মনে হল লোকটা আসলে এখনকার নয়। হয়তো সেই ইতিহাসের বল্লাল সেন। কোথাও লুকিয়ে ছিল, এখন বর্তমানের জামা পরে চলে এসেছে। আর রক্তমাংসের মানুষগুলোকে দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখছে, চিনছে আর ভবিষ্যদ্বাণী করছে। ভেবে আবার হাসি পেল তার। আর তখনই দেখতে পেল, একতলা থেকে ধীরে-সুস্থে হেঁটে আসছেন ভদ্রলোক। মাঝারি উচ্চতা, নির্মেদ। এই লোকটা তার চেনা নয়। অথচ এই লোকটার সঙ্গে কথা বলতে তার স্বস্তি লাগছে। জাগছে আকর্ষণ। সে জানে না, তার ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে! কিন্তু এটুকু নিশ্চিত, পরে যখনই তার এই মুন্সিয়ারি সফরের কথা মনে পড়বে তখনই অবধারিত ভাবে মনে পড়বে ওই ঐতিহাসিক চরিত্রের নাম৷ তমা দেখল, লোকটা এখন তার কাছে এসে কিছু একটা বলছে।

মধ্যরাতের সংলাপ

“এ বার ঘুমোতে যাবেন তো, তমা ম্যাডাম! কাল আবার সারা দিন হাঁটাহাটি।”

“আপনি ঘুমোন গিয়ে। আমি এখন বসে বসে বিরক্ত হব।”

“এখন কিন্তু কফি পাওয়া যাবে না।”

“কফি ছাড়াই পা নাড়াতে নাড়াতে মনের আনন্দে বিরক্ত হব।”

“কী মুশকিল, এই তো সন্ধের সময় এক ঘণ্টা ধরে বিরক্ত হলেন।”

“আপনার ইচ্ছে না হয় আপনি ঘুমোনগে যান, বিরক্ত তো একা একাও হওয়া যায়। কেন, আপনি এখন কী করবেন? মেঘাকে ফোন করবেন?”

“সে তো এখনও তার জামাইবাবুর সঙ্গে
গল্প করছে।”

“এখনও?”

“এখনও। ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে। কখনও রাগ করছে, কখনও হেসে বলছে, আমি বরাবরই ছেলেমানুষ। বয়ে গেছে নাটক
দেখতে যেতে।”

“তখন কী একটা গল্প বলতে যাচ্ছিলেন!”

“কোন গল্প বলুন তো?”

“ওই যে, যখন জানতে চাইলাম আপনি কখনও কাউকে ভালবেসেছিলেন কি না, তখন কথা ঘুরিয়ে বললেন একটা গল্প আছে!”

“সে গল্প এখন আপনার ভাল লাগবে না।”

“আশ্চর্য! তখন ভাল লাগত, এখন শুনলে খারাপ লাগবে, এও হয় না কি?”

“হয়ই তো! মানুষের মেজাজ বড় বিদঘুটে জিনিস তমা। এটা বেমালুম ফাজলামির গল্প। তখন শুনলে হয়তো মজা লাগত, এখন বিরক্তি লাগবে!”

“লাগুক, আপনি তো আমায় বিরক্ত করার কপিরাইট নিয়েই রেখেছেন।”

“কপিরাইট? কখন নিলাম?”

“হয়, হয়, কখন কোন কথায় কোন প্রসঙ্গে মানুষের কপিরাইট হাত বদল হয়ে যায়, কে জানে! না, এ বার বলুন, আমি সেটাই শুনব।”

“শুনুন তা হলে। গল্প তৈরিই আছে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে বর্ণিত! যাই হোক, শুনুন। এটা যে সময়ের ঘটনা তখন আমরা কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে গেছি। কেউ চাকরি করছে, কেউ গবেষণা, কেউ আমার মতো ভ্যারেন্ডা ভাজছে। তখন নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎও হয় না কলেজের বন্ধুদের। এমন সময় প্রীতিলতার বিয়ে ঠিক হল। আমাদের দঙ্গলে জনা চার ছেলে আর জনা ছয়েক মেয়ে ছিল। সবার প্রথমে প্রীতিরই বিয়ে ঠিক হল।”

“মাঝখানে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, বাকিদের সকলের বিয়ে কি হয়ে গেছে এত দিনে?”

“না, জনা তিনেকের এখনও অবশিষ্ট।”

“আপনি?”

“ধরুন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আবার মনে করতে পারেন আমি অবশিষ্টদের দলেই আছি।”

“মানে আরও একগুচ্ছ গল্প।”

“তা বলতে পারেন প্রিয় তমা।”

“কী! কী বললেন?”

“বলতে চেয়েছি মাই ডিয়ার তমা। অনুবাদ বুঝতে হোঁচট খেলেন তো?”

“হোঁচট? বিষম খেলাম। সত্যি, আপনার মতো বন্ধু থাকলে...”

“শত্রুর দরকার হয় না?”

“জামাইবাবুর দরকার হয় না। থাক, আর প্রশংসা শুনতে হবে না, বিয়েবাড়িতে চলুন।”

“এই তো, বিয়েবাড়ি পৌঁছে গেছি।”

“সানাই বাজছে, সুগন্ধি উড়ছে, আলোয় ভাসছে চার পাশ?”

“ভাসছে তো। বর এসে গেছে। কনে প্রীতি তখন লাজুক হেসে লোকের থেকে উপহার নিচ্ছে।”

“তার পর?”

“আমাদের দশ জনই হাজির হয়েছি। তখনও কারও আকাশে বিয়ের মেঘটুকুও নেই। সবার মনেই একটু একটু দুঃখ। ফিরে গেছি পুরনো দিনে, কলেজে কে কাকে পছন্দ করত, কার কার জুটি গড়ল, কার জুটি ভাঙল, সেই সব গল্প হচ্ছে। আমাদের মধ্যে প্রীতি ছিল সেই রকম মেয়ে, যার একটু সাজগোজের বাতিক ছিল, ঘর সাজানোয় আগ্রহ ছিল, আর ছিল গিন্নিপনা। কলেজ থেকেই বিয়ে-বিয়ে ভাবও ছিল প্রীতির। দেখতে সুন্দর ছিল, কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল উৎকট সাজ। নিজেকে আরও সাজাতে পারলে ওর মনে হত বিরাট কিছু একটা করেছে। আমাদের বন্ধু নন্দ রোজ ওর খুব প্রশংসা করত। কে একটা বলেছিল, আহা, ছেলেটা রোজ এত জপাচ্ছে, ওর সঙ্গে প্রেম করতে তো পারিস! প্রীতি বলল, এ মা, ওর শুধু হাসিটাই ভাল লাগে, আর কিছু না। সঙ্গে সঙ্গে কে বলল, রাহুলের কিছু ভাল লাগে না? প্রীতি বলেছিল, চোখ। আমার কথা উঠল, বলল ওর গলাটা দারুণ। আর কিছু না। সেই সব কথা মনে পড়ছিল আমাদের। তো বিয়ের দিনে নন্দ খেপে বলল, চল, আজ সব মনে করাব। তার পর যেই বিয়ে শুরু হল, পুরোহিত মন্ত্র শুরু করলেন, অমনি মেয়েগুলো পাশে বসে ওর কানে কানে গুজগুজ করতে থাকল। পুরোহিত কী একটা মন্ত্র বললেন, ঐশী বলল, ‘দ্যাখ প্রীতি, নন্দর হাসিটা কী সুন্দর!’ অমনি পাশ থেকে সুছন্দা ওর অন্য কানে বলল, ‘রাহুলের চোখ দুটো দ্যাখ,’ পুরোহিত এ দিকে রেগে যাচ্ছেন, ‘আপনাকে যা বলতে বললাম, বলুন,’ ও তোতলাচ্ছে, পুরোহিতের ধমক শুনে এক বার বলছে ‘শুক্ল পক্ষে চোখ’ অন্য বার বলছে ‘অগ্রহায়ণ মাসে হাসি’! পুরোহিত তাই শুনে বিষম খান প্রায়! আমি ওদের ইঙ্গিত করে বলছি, আমার গলার কথাটা বল... ওরা দু’জনে দু’কানে সে কথা বলছে! চার পাশে ভিড়, অহরহ উলু, উঁচু স্বরের সানাই, পুরোহিতের কণ্ঠ আর প্রীতির হাসি চাপতে গিয়ে বিকট মুখচ্ছবি! সব মিলিয়ে সে একটা ব্যাপার হয়েছিল বটে! কী হল, আপনি এমন চুপ করে গেলেন কেন?”

“আপনারা বন্ধুবান্ধব মিলে খুব মজা
করতেন না?”

“কেন, আপনারা করেননি?”

“না, আমরা ছিলাম খুব সিরিয়াস, পড়ুয়া
আর নিরীহ।”

“বেচারা! বন্ধুরাও বিরক্ত করেনি। কী দুঃখ!”

“করেছে, কিন্তু সেটা সত্যিকারের বিরক্তি, আপনাদের মতো ভাল লাগা বিরক্তি নয়।”

“বিরক্তিও ভাল লাগে?”

“আগে লাগত না, গতকাল থেকে লাগছে।”

“চলুন, আপনাকে আরও বিরক্তিকর প্রশ্ন করি। ইচ্ছে হলে উত্তর দেবেন, না হলে শুধু হাসবেন।”

“মানে এখানে হাসি মানে না, তাই তো!”

“বাপ রে বাপ! কী কঠিন অঙ্ক আর কী অদ্ভুত সমাধান! হাসি মানে না, কিন্তু অট্টহাসি মানে হ্যাঁ, মুচকি হাসি মানে জানি না। বাঁকা হাসি মানে হতেও পারে, না-ও হতে পারে। আর করুণ হাসি মানে জানা থাকলেও বলব না।”

“একদম তাই। এটাই হোক হাসির বর্ণমালা। বিপ্লব যখন আসবে, আমি এই ভাষাতেই উত্তর দেব। কেউ বুঝবে না, শুধু আপনি বুঝবেন।”

“বিপ্লব?”

“বিপ্লব মানে পরিবর্তন। ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র। এ বার কী প্রশ্ন করবেন?”

“ও, হ্যাঁ! একটা প্রশ্ন। আচ্ছা, আপনাকে যদি বলা হয়, একটা ফুল দিয়ে আপনার প্রিয় ব্যক্তিকে প্রেমের প্রস্তাব করতে, কোন ফুল দেবেন?”

“মানে আমি গিয়ে তার হাতে ফুল দিয়ে বলব, আমার সঙ্গে প্রেম করো?”

“বলতে পারেন, অন্য ভাবেও বলতে পারেন!”

“বলবই না। বলব, ভাগুন মশাই।”

“প্রশ্নের স্বার্থে বলুন।”

“লোকটা যদি পছন্দের হয়, পরিবেশটা যদি ঠিক হয় আর মেজাজ যদি ভাল থাকে, তা হলে যে কোনও ফুল দিয়েই বলতে পারি। তবে গোলাপ নয়, বড্ড ক্লিশে। করবী হতে পারে। কাঞ্চন হতে পারে। জুঁইও আমার পছন্দের। পদ্মপাতা বা কলাপাতায় মোড়া জুঁই বা স্বর্ণচাপা দিতে পারি! তবে কোনও নাটুকে কথা বলতে পারব না। বলুন, কেমন হবে?”

“দারুণ হবে তমা। এ বার পরের প্রশ্ন।”

“পরের প্রশ্নে তো যাবেনই, তার আগে বলুন তো মিস্টার ইতিহাস, আপনি হলে কী ফুল দিতেন?”

“আমার প্রিয় ফুল শিমুল। গাঢ় লাল রং।
ওটাই দিতাম।”

“আশ্চর্য! শিমুল ফুল?”

“এতে আশ্চর্যের কী আছে?”

“আমার জীবনেও শিমুল ফুলের একটা ঘটনা আছে। কী অদ্ভুত! আমি ভুলেই গেছিলাম।”

“ভুলে গেছেন যখন, কী লাভ মনে করে? লোকে সেগুলোই ভুলে যায়, যেগুলো বিরক্তিকর।”

“আপনার মাথা, মিস্টার ইতিহাস! লোকে সেগুলোই ভুলে যায় যেগুলোর নাড়াচাড়া হয় না, আর বিরক্তিকর বিষয় লোকে ভোলে না। আপনাকে শুনতে হবে। মনে যখন পড়ল তখন বলবই।”

“অগত্যা। বলুন।”

“মেয়েটা আমার বন্ধু, নাম পুতুল, পাড়াতুতো সখী। ছোটবেলা থেকেই এক সঙ্গে পাড়ায় থাকা। কলেজ অবশ্য আলাদা। ও এক দিন একটা শিমুল ফুল এনে দিল। বলল, ‘এক জন পাঠিয়েছে।’ আমি বললাম, সে কে? ও বলল, ‘তুই চিনবি না, আমি চিনি।’ ফুলটা দিয়ে বলল, ‘বল, তোর উত্তর কী!’ আমি তখন একটা সম্পর্কের মধ্যে রয়েছি। সম্পর্ক বলুন সম্পর্ক, গাড্ডা বলুন গাড্ডা, মহাকাব্য বলুন মহাকাব্য। তাই কোনও উত্তর দিইনি। এর পর তো পুরো ভুলে গেলাম। জীবনেও মনে পড়েনি। তার পর তো কত বার দেখা হয়েছে পুতুলের সঙ্গে, কত গল্প হয়েছে। আমার মতো ও-ও ভুলে গেছে সেই শিমুলের কথা। এ বার দেখা হলে বলতে হবে। জানেন, পুতুল একটা স্কুল খুলেছে নিজে! দুশোর বেশি বাচ্চা নিয়ে ওর এখন ভরা সংসার।”

“হ্যাপি কিডস।”

“বেশ সুনাম এখন ওর। দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনি কী করে জানলেন?”

“কাঠগোদামে ট্রেন ঢোকার আগে আপনি ফোনে ফেসবুক খুলে সেখানকার ছবি নিজে হাতে করে দেখালেন জীবেশ, গরিমা এবং
এই শ্রীমানকে।”

“ও হ্যাঁ, তাই তো। পুরো ভুলে গেছি! আপনি কিছু মনে করবেন না যেন ইতিহাসবাবু। আচ্ছা, গরিমা এখন কী করছে কে জানে! আপনি তো ভবিষ্যৎ বলেন ইতিহাসবাবু, বর্তমানও কী দেখতে পান? দেখুন না আমার বান্ধবী এখন কী করছে? নিশ্চয়ই দিদির সঙ্গে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।”

“বর্তমানই তো দেখতে পাই। অতীতও দেখতে পাই ম্যাডাম। তবে আপনার বান্ধবী এখন আদৌ ঘুমোচ্ছে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE