Advertisement
E-Paper

শেষ নাহি যে

ইমারশন হিটার একটা আছে, কিন্তু এখন সেটায় জল গরম করার সময় নেই। স্নানঘরে ঢুকে কিছু না ভেবেই ঝুপুস করে এক মগ জল মাথায় ঢেলে দিল বিহান। ঠান্ডার চোটে বিকট চিৎকার করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে লাগল, “আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও। উরেশালা! ধুইয়ে দাও! ঠান্ডায় মরে গেলুম রে! ধুইয়ে দাও!”

ইন্দ্রনীল সান্যাল

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৮ ২৩:৫৩
ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

পূর্বানুবৃত্তি: দরিয়ার স্বামী বিহান বন্দরের অফিসে ডেটা এন্ট্রির কাজ করে। ওখানেই মেসে থাকে কলেজ জীবনের বন্ধু, বর্তমানে বিরোধী দলের নেতা সনতের সঙ্গে। সনতের জন্যই চাকরি বিহানের। এখন তাই সনতের সব কিছুই তাকে মেনে নিতে হয়, ভাল না লাগলেও।

রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকার কত সুবিধে! বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স থাকা সত্ত্বেও সপ্তাহে চার দিন সনতের অনুপস্থিতি নিয়ে পোর্টের ম্যানেজমেন্ট বা মিস্টার দাস, কেউ কথা বলে না।

জেলা স্তরের একাধিক পার্টি মিটিং সেরে রাত দশটার সময়ে মেসে ফিরে সে বিহানের সঙ্গে মদ খেতে বসে। বিহানকেও বাধ্য হয়ে খেতে হয়। অনেক সপ্তাহেই এমন হয়েছে যে বিহান খায়নি, কিন্তু মদ আর চাট কিনে এনেছে গাঁটের টাকা খরচ করে। বিহানের না খাওয়ার কারণটা খুব সহজ। সনৎ পকেট থেকে টাকা বার করে না। পকেট থেকে টাকা না বার করার ঘটনাটা শুধু মদ কেনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। সনৎ মেস ভাড়া বা বাজার করার টাকাও শেয়ার করে না।

চাকরি পাওয়ার সময়ে সনৎ বিহানকে সাহায্য করেছিল। কৃতজ্ঞতাবশত বিহান প্রথম কয়েক মাস সনৎকে কিছু বলেনি। পরে বুঝেছে, প্রথমেই প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। করেনি বলে সনৎ মাথায় চেপে বসেছে। পোর্টের অফিসে ডেটা এন্ট্রির কাজ বিহানকে দিয়ে করায়। মেসে রান্না করা, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, কাপড় কাচা... সব বিহান করে। এবং এর পরেও খরাজ পার্টির সদস্য হিসেবে মাইনের একটা অংশ বিহানকে ডোনেশন হিসেবে দিতে হয়।

ঝাঁট দেওয়া শেষ করে বিহান দেখল সনৎ ঠান্ডা চা আর বিস্কুট নিয়ে খাটে লেপমুড়ি দিয়ে বসে রয়েছে। পাশে রাখা রয়েছে দুটো স্মার্টফোন। দুটো মোবাইলের চারটে কানেকশন যে কী কাজে লাগে, ঈশ্বর জানেন!

সনৎকে নিয়ে মাথা ঘামালে অফিসের দেরি হয়ে যাবে। স্টোভে চালডাল বসিয়ে বিহান স্নান করতে ঢুকল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দুটো ওমলেট ভেজে নেবে। খিচুড়ি আর ওমলেট। শীতের পক্ষে আদর্শ খাবার। এটাই আজকের সকালের, দুপুরের আর রাতের খাবার। দিনে দু’বেলা স্টোভের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।

ইমারশন হিটার একটা আছে, কিন্তু এখন সেটায় জল গরম করার সময় নেই। স্নানঘরে ঢুকে কিছু না ভেবেই ঝুপুস করে এক মগ জল মাথায় ঢেলে দিল বিহান। ঠান্ডার চোটে বিকট চিৎকার করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে লাগল, “আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও। উরেশালা! ধুইয়ে দাও! ঠান্ডায় মরে গেলুম রে! ধুইয়ে দাও!”

তার চিৎকার শুনে শোওয়ার ঘর থেকে সনৎ হাসছে। ঝপাঝপ কয়েক মগ বরফঠান্ডা জল মাথায় ঢেলে গামছা দিয়ে গা মুছতে থাকে বিহান। ক’টা বাজল কে জানে! ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছতেই হবে। আজ তার চাকরির অ্যানুয়াল কন্ট্র্যাক্ট রিনিউয়ালের দিন। মিস্টার দাসকে দিয়ে সেটা করিয়ে নিতে হবে। লোকটাকে চটাতে চায় না বিহান। দরিয়ার সন্তান হওয়ার দিন কাছে চলে এসেছে। সামনে অনেক খরচ।

বিহানের বাড়ি হাওড়া ময়দানে। তার বউ দরিয়া থাকে লিলুয়ায়, বাপের বাড়িতে। গর্ভাবস্থায় প্রায় সব মেয়েই বাপের বাড়ি থাকে। এটা কোনও নতুন কথা নয়। কিন্তু দরিয়া বিয়ের পরে কখনওই শ্বশুরবাড়ি থাকেনি। শুধু তাই নয়, বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল দরিয়াদের বাড়ি ‘বসবাস’-এ। কারণ বিহানের মা শ্রীরূপার এই বিয়েতে মত ছিল না। তিনি ছেলের বিয়েতে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর অমতে বিয়ে করার পরে শ্রীরূপা বিহানকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দরিয়া এই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। যদিও বিহানের জন্য এই বাড়ির দরজা সব সময় খোলা। তাকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই শ্রীরূপার।

বিয়ের আগে একবার মাত্র শ্রীরূপার সঙ্গে দরিয়ার দেখা হয়েছিল। বিয়ের পরে, গত দেড় বছরে এক বারও মোলাকাত হয়নি। দরিয়া গর্ভবতী, এই কথা জানার পরেও মন গলেনি শ্রীরূপার।

বিয়ের পর থেকে বিহান নিজের জীবনটা তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছে। সোমবার সকাল থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত সে বকুলতলার মেসে থাকে। শনিবার রাত আর রোববার সকালটা হাওড়া ময়দানের বাড়িতে মায়ের কাছে কাটিয়ে রোববার দুপুরে চলে যায় ‘বসবাস’-এ। শ্বশুর সাম্যব্রত আর শাশুড়ি সীমার সঙ্গে গল্প করে কিছুটা সময় কাটে। আর দরিয়া তো আছেই! বসবাসে পৌঁছে বেঁচে থাকার একটা আবছা মানে খুঁজে পায় বিহান। সারা সপ্তাহের অক্সিজেন পেয়ে যায় রবিবারের ওই কয়েক ঘণ্টায়।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে শার্ট প্যান্ট গলাল বিহান। ফুল সোয়েটার পরে গলায় মাফলার জড়িয়ে একটু আরাম হল। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল খিচুড়ি তৈরি। দুটো ডিম ভেঙে প্লাস্টিকের মগে ফেটিয়ে, পেঁয়াজ কুচি আর নুন-হলুদ দিয়ে চ্যাঁচাল, ‘‘সনৎ, তুই কখন খাবি?’’

‘‘বেড়ে রেখে দে। পরে খাব।’’ মোবাইলে কথা বলার ফাঁকে হুকুম করল সনৎ।

বিহান দুটো ওমলেট বানাল। সনতের খিচুড়ি আর ওমলেট থালায় রেখে কাঠের মিটসেফে ঢুকিয়ে দিল। নিজের খিচুড়ি একটা থালায় নিয়ে হাপুস হুপুস করে খেতে খেতে বলল, ‘‘গত মাসের অনেক কাজ পেন্ডিং রয়ে গিয়েছে। তুই একদম কিছু না করলে কী করে হবে বল তো? গত এক বছরে বকুলতলা পোর্টে কতগুলো কার্গো লোডিং আর আনলোডিং হয়েছে, তার ডেটা হেড অফিসে মেল করতে বলেছে। আমার একার পক্ষে এত ডেটা এন্ট্রি করা সম্ভব?’’

ঠান্ডা চায়ে সুড়ুত করে চুমুক দিয়ে ঠান্ডা চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে সনৎ বলল, ‘‘তুই কি আমাকে ডেটা এন্ট্রির কাজ করতে বলছিস?’’

বিহান বুঝতে পারছে, সে আজ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সনৎকে অফিসের কাজ করতে বলা আর বাঁদরকে ‘দেবতার গ্রাস’ মুখস্থ করতে বলা একই ব্যাপার। কিন্তু আজ কন্ট্র্যাক্ট রিনিউয়ালের দিন। মিস্টার দাস রিনিউয়াল না করলে বিহানের চাকরি থাকবে না। যার বৌয়ের আজকালের মধ্যে সন্তান হতে চলেছে, সে কোনও রিস্ক নিতে পারে না।

বিহান মিনমিন করে বলল, ‘‘ডেটা এন্ট্রির কাজ। যে কাজের জন্য আমরা মাইনে পাই।’’

সনৎ ক্রুর হেসে বলল, ‘‘আমি সংগঠনের কাজ করি। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করি। মাইনের সব টাকা আমি সংগঠনকে দিয়ে দিই। ওই টাকায় আমার কোনও লোভ নেই।’’

‘‘আমাকে দু’জনের কাজ করতে হচ্ছে,’’ বিহান নাছোড়বান্দা, ‘‘আমি পেরে উঠছি না। মিস্টার দাস যদি আমার পারফরম্যান্সে অখুশি হয়ে কনট্র্যাক্ট রিনিউয়াল না করেন তা হলে কী হবে?’’

‘‘উরিত্তারা! হেব্বি বললি কিন্তু! তা হলে উত্তরটাও শুনে রাখ। তোর বদলে একটা অভাবি ছেলে চাকরি পাবে। ঠিক কি না? সবার কপালে তো আর তোর মতো শাঁসালো শ্বশুর জুটবে না। সবাই তোর মতো ঘরজামাইও হতে পারবে না।’’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল সনৎ। আবার মোবাইলে বকরবকর শুরু করল।

শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল বিহান। খাওয়া শেষ। এ বার টিফিন বক্সে খাবার ভরে বেরোতে হবে।

বিহান সার বুঝেছে, এই দুনিয়ায় একটা জিনিসেরই গুরুত্ব আছে। টাকা! টাকার জন্যই সে বৌ আর নিজের বাড়ি ছেড়ে বকুলতলায় পড়ে রয়েছে। টাকার জন্যই বৌ বাপের বাড়িতে থেকে টিউশনি করে। তার সঙ্গে বকুলতলায় থাকতে পারে না। মেসবাড়িতে ভূতের মতো একা থাকা, হাত পুড়িয়ে রান্না করা, কাপড় কাচা, ঘর ঝাঁট দেওয়ার কষ্ট তো আছেই। সেগুলো গায়ে লাগত না, যদি বৌ সঙ্গে থাকত। আর বিছানায় একা রাত কাটানোর কষ্ট কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।

টাকা! সামান্য ক’টা টাকার জন্য সকাল থেকে উঠে চরকি পাক খাচ্ছে বিহান। গরম খিচুড়ি খেয়ে মুখ পুড়োচ্ছে, নিজের এঁটো থালা মাজছে, নিজের এবং সনতের এঁটো চায়ের কাপ ধুচ্ছে, কাঁধে ব্যাগ আর পায়ে জুতো গলিয়ে মেসবাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড় দিচ্ছে অফিসের উদ্দেশে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে, সকাল দশটা দশ বাজে। আজকেই দেরিটা হতে হল?

পাশাপাশি এটাও মনে হচ্ছে, আজ সকালে দরিয়াকে ফোন করা হল না।

দরিয়া অনেক দিন ধরেই ঠিক করে রেখেছে যে উল্টোপাল্টা খরচ করবে না। কিন্তু বুধনের ফুচকা দেখলে মাথার ঠিক থাকে না। কোন কাস্টোমারের কী চাহিদা সেটা বুধন খুব ভাল করে জানে! এ পাড়ার সবাই বুধনের পুরনো কাস্টমার। ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, গোলমরিচ, ধনেপাতা দিয়ে পুরটা দুর্দান্ত বানায়। নোনতা নোনতা, টক টক তেঁতুলগোলা জলের কথা ভাবলেই জিভে জল চলে আসে। ওই জিনিস ছাড়া যায় না কি? তখন খরচ কমানোর কথা মাথা থেকে উড়ে যায়।

বুধনের কাছ থেকে মাত্র দুটো ফুচকা খেয়েছিল দরিয়া। ওই খেয়েই পেট খারাপ। তলপেটে মোচড় দিচ্ছে। এক বার টয়লেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। মুশকিল হল, পেটে মোচড় দিলেও বেগটা আসছে না। বিছানা থেকে না উঠে, দরিয়া অপেক্ষা করতে লাগল, কখন সাম্যব্রত চা নিয়ে আসবেন।

গর্ভাবস্থার ছ’মাস পর্যন্ত বাড়ির সব কাজই দরিয়া করত। রান্না করা, ঘর সাফাই, জামাকাপড় কাচা, বাসন মাজা বা সাপ্তাহিক বাথরুম পরিষ্কার— সব। কাজের লোক রাখার সামর্থ্য তাদের নেই। ছ’মাসের মাথায় নিউ লাইফ মেটারনিটি ক্লিনিকের গাইনিকলজিস্ট ডাক্তার মিত্র বলে দিলেন, “বাড়ির কাজ আর করা যাবে না। দরিয়ার ব্লাড প্রেশার বেশি। ডেলিভারির সময়ে সমস্যা হতে পারে।”

সেই থেকে সব কাজ সাম্যব্রত করেন।

প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়া নিয়ে দরিয়ার আপত্তি ছিল। ও সব জায়গায় অনেক খরচ। সাম্যব্রত মেয়ের কথা শোনেননি। ভারী গলায় বলেছেন, ‘‘পাড়ার মধ্যে ছোট্ট মেটারনিটি ক্লিনিক। শুধু নরমাল ডেলিভারি আর সিজ়ারিয়ান সেকশন হয়। ডাক্তার মিত্র আমার চেনা। পনেরো হাজার টাকার প্যাকেজ। ওটা বেড়ে বড়জোর কুড়ি হবে। ওই নিয়ে তুই ভাবিস না।’’

দরিয়া কখনও সাম্যব্রতর মুখের উপরে কথা বলে না। সে চুপ করে গিয়েছে। সব ভালয় ভালয় মিটে গেলে বাবাকে টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। টিউশনি করে সে-ও অল্পবিস্তর টাকা জমিয়েছে।

সকাল আটটার সময়ে প্লাস্টিকের ট্রেতে তিন কাপ চা নিয়ে হাজির সাম্যব্রত। মেয়েকে বললেন, ‘‘আজ ঠান্ডাটা একটু কম বলে মনে হচ্ছে না?’’

আধশোওয়া হয়ে, চায়ের কাপ গালে ঠেকিয়ে দরিয়া বলল, ‘‘আমার তো ভীষণ শীত করছে।’’

‘‘বড্ড শীতকাতুরে হয়েছিস।’’ ট্রে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন। এখন ওখানে বসে কত্তা-গিন্নি একসঙ্গে চা খাবেন আর গল্পগাছা করবেন।

বাবা আর মায়ের প্রেম দেখে হিংসে হয় দরিয়ার। বুড়ো বয়সে প্রেম বাড়ে কি না কে জানে! সাম্যব্রত তো সীমাকে ছেড়ে এক ঘণ্টাও থাকতে পারেন না। বাজারহাট যাওয়া, পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মারতে যাওয়া, সকাল বিকেল হাঁটতে বেরোনো... যাই করুন না কেন, সেটা চুকিয়ে সীমার পাশে বসে পড়েন। তার পরে দু’জনে মিলে নিচু গলায় বকরবকর শুরু হয়ে যায়।

এক কাপ চা শেষ করেও টয়লেটের বেগ এল না। তলপেটের কিনকিনে ব্যথাটা যাওয়ার নাম করছে না। বিহানের সঙ্গে এক বার কথা বলবে না কি? থাক বাবা! দরকার নেই। ওর ফেরার কথা আগামীকাল। তার আগে এই সব ঝামেলা ওর কানে না তোলাই ভাল।

Novel Indranil Sanyal ইন্দ্রনীল সান্যাল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy