Advertisement
E-Paper

জলপাই

গ্রিক পুরাণের ‘ব্রহ্মা’ জিউস খুব সুন্দর এক নগরী তৈরি করলেন পৃথিবীর লোকের জন্য। কিন্তু সেই শহরের উপাস্য দেবতা কে হবেন, তাই নিয়ে মনান্তর হল জিউসের মেয়ে এথেনা আর ভাই পসেইডিয়নের। পসেইডিয়ন ছিলেন সমুদ্রের দেবতা আর অত্যন্ত বদমেজাজি। সাইক্লোন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, আর বিভিন্ন সামুদ্রিক উপদ্রবের দেবতা তিনি। অন্য দিকে এথেনা শুধু যুদ্ধ, শান্তি, জ্ঞান, ন্যায়, সভ্যতার আর শিল্পের দেবী।

পিনাকী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০

গ্রিক পুরাণের ‘ব্রহ্মা’ জিউস খুব সুন্দর এক নগরী তৈরি করলেন পৃথিবীর লোকের জন্য। কিন্তু সেই শহরের উপাস্য দেবতা কে হবেন, তাই নিয়ে মনান্তর হল জিউসের মেয়ে এথেনা আর ভাই পসেইডিয়নের। পসেইডিয়ন ছিলেন সমুদ্রের দেবতা আর অত্যন্ত বদমেজাজি। সাইক্লোন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, আর বিভিন্ন সামুদ্রিক উপদ্রবের দেবতা তিনি। অন্য দিকে এথেনা শুধু যুদ্ধ, শান্তি, জ্ঞান, ন্যায়, সভ্যতার আর শিল্পের দেবী। দুজনেই আপনজন, তার ওপর দুজনেই দেবতাদের ‘অলিম্পিয়াড’-এর সদস্য। ‘অলিম্পিয়াড’ বারো জন সবচেয়ে প্রভাবশালী দেবদেবীদের নিয়ে তৈরি। তাই জিউস নিজের ওপর সিদ্ধান্তের ভার না রেখে, আদেশ দিলেন দুই দেবতাকে। নতুন নগরীকে নতুন কিছু উপহার দাও, তার নিরিখে অলিম্পিয়াড-এর বাকি সদস্যরা বিচার করে জানাবেন নতুন নগরীর উপাস্য কে। সেই নতুন শহর ছিল সমুদ্রের উপকূলে, তাই পসেইডিয়ন সেখানে আগে পৌঁছে গেলেন। তিনি তাঁর বল্লম গেঁথে দিলেন মাটিতে, আর সেখানে তৈরি হল নোনা জলের এক কুয়ো। উল্লাসে ফেটে পড়ল তাঁর সমর্থকরা। এথেনা পৌঁছলেন কিছু পরে, নোনা জলের কুয়োর পাশে তিনি তাঁর বল্লম গাঁথলেন। বেরিয়ে এল অলিভ বা জলপাইয়ের এক গাছ। এই গাছ তার কাণ্ডের মাধ্যমে কাঠ দিল মানুষকে, ফলের মাধ্যমে দিল সুস্বাস্থ্য, আর বাণিজ্যের দরজাও খুলে দিল। ‘অলিম্পিয়াড’ এথেনাকে বিজয়িনী ঘোষণা করল আর তাঁকে নতুন শহরের উপাস্য দেবী বলে স্বীকার করল। এথেনার নামে মিলিয়ে নগরীর নাম হল এথেন্স।

অলিভ শুধু গ্রিক উপকথাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য ধর্ম আর সভ্যতাতেও। মিশরের ফারাও তুতানখামেনের সমাধিতে অলিভ গাছের ডাল পাওয়া গিয়েছে। হিব্রু বাইবেল আর ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে, যে পায়রা নোয়ার কাছে খবর এনেছিল যে বন্যা শেষ হয়েছে, বন্যার জল নেমে যাচ্ছে, তার ঠোঁটে অলিভের ডাল ছিল। কোরান শরিফে সাত বার অলিভের উল্লেখ রয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, রমজানের উপবাস ভাঙার সময় খেজুর না পেলে বদলে অলিভ ব্যবহার করা যেতে পারে। খেলার মাঠেও অলিভের বিশাল ভূমিকা, অলিম্পিক-জয়ীর মাথায় অলিভের মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয় সেই আদি কাল থেকেই। তখন অলিম্পিকে শারীরিক কসরতের সঙ্গে বাগ্মিতা আর বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষাও থাকত। কারণ এথেনা যে জ্ঞান আর শৌর্যেরও দেবী। রিও অলিম্পিকেও তাই ঐতিহ্য-মাফিক অলিভের মুকুট পরানো হয়েছে বিজয়ীদের।

মানুষ যে দিন থেকে গাছ পুঁততে শুরু করল, গাছের পরিচর্যা শুরু করল, সেই জমানার এক আদিম গাছ হল এই অলিভ গাছ। ৬০০০ বছর আগে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে গ্রিকদের বর্ণিত সূর্যোদয়ের দেশ ‘আনাতলিয়া’, মানে এখনকার তুর্কি থেকে এর যাত্রা শুরু বলে মনে করা হয়। অলিভ গ্রিস বা ক্রিট দ্বীপেই পৌঁছে গিয়েছিল সেই তাম্রযুগে, আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে। রোমান যুগ থেকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, অলিভ শৌর্য ছেড়ে শান্তির দূত হয়ে উঠেছে। প্রথম শতাব্দীর রোমান কবি ভারজিল তাঁর ‘ইনিড’ কাব্যে অলিভের ডালকে শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন। ৪ জুলাই ১৭৭৬-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম সিল তৈরি করে, তা ১৭৮০-র মার্চে পরিমার্জিত হয়। সেই নতুন সিলে অনেক কিছু বদলালেও বদলায়নি অলিভ আর অলিভ পাতা। এমনকী হালে ১৯৭৪ সালে যখন প্যালেস্তিনীয় নেতা ইয়াসের আরাফত রাষ্ট্রপুঞ্জ অধিবেশনে যান, তাঁর হাতে ছিল অলিভ গাছের ডাল।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

গিরিধারী কবিয়ালের পাঁচালি

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

আকাশবাণীর কলকাতা অফিসে মাঝেমধ্যে যাই। এক প্রযোজকের ঘরে বসে ছিলাম, এক নব্যযুবা বয়স্য সমভিব্যাহারে নায়কোচিত প্রবেশ করলেন। নায়ক নানা ধরনের হয়। ললিত, উদাত্ত, ধীরোদাত্ত... ছেলেটি বিনয়+উদ্ধত= বিনয়োদ্ধত। ঢুকেই আঙুল তুলে প্রশ্ন— গান, কবিতা-টবিতা কে দেখে? প্রযোজক নিজের দিকেই ইঙ্গিত করলে ওর বিনয় প্রকাশিত হল। একটা খাতা টেবিলে রেখে বলল, ‘এর মধ্যে ভ্যারাইটি টাইপের লিরিক আছে: প্রেম, প্রকৃতি, মা-মাটি-মানুষ... আমাকে গীতিকার করে নিন।’ প্রযোজক বললেন, ‘গীতিকারের সেই প্যানেলের কনসেপ্ট আর নেই, দরকার মতো গান কিনে নেওয়া হয়, রেখে যান।’ ছেলেটির বিনয়ভাব কমে রৌদ্রভাব প্রকাশিত হল। ‘ফোন নম্বর দিন, সাত দিন পরে ফোন করব।’ খাতার উপর ওর নাম-ঠিকানা ছিল। ‘গ্রাম গরুচোরা, ভায়া গাইঘাটা’ দেখেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গিরিধারী কবিয়াল-কে চেনেন?’ ছেলেটি বলে, ‘আরে, উনি তো আমার ঠাকুরদা হন! ওঁরই তো কবিতার জিন আমার মধ্যে।’ বলি, ‘কেমন আছেন উনি?’ ও বলে, ‘নব্বুই বছর তো প্রায় হল। এখনও বেরতে চায়, বন্ধ করে রাখি। গলায় একটা অপারেশনের পর কথা বলতে পারে না, গোঁ-গোঁ করে।’

ছেলেটির অনুমতি নিয়ে খাতাটা খুলি। দেখি, ‘মৌমাছি গুনগুন কোয়েলিয়া গান গায়’, পরের লাইনে ‘পূর্ণিমা ফুল মুন প্রাণ করে হায় হায়।’ আধুনিক কিনা। ছেলেটি বলে, ‘কলকাতায় একটা হাই-লেবেল মিটিং-এ এসেছিলাম, খাতাটা রেখে গেলাম। ফোন করব।’

গিরিধারী কবিয়ালের দেখা পেয়েছিলাম চাঁদপাড়ার হাটে। ১৯৮৭-’৮৮ হবে। হাটের এক কোনায় দাঁড়িয়ে, খাতাটাতা না দেখে চেঁচিয়ে, সুর করে অনর্গল কবিতা বলে যাচ্ছেন। হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের উপদেশ, নিষেধাজ্ঞা— এ সব নিয়েই কবিতাগুলি। আবার, রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের অসংগতিও বাদ দিচ্ছেন না। অদ্ভুত লেগেছিল মানুষটাকে। গ্রাম এবং পথের বিবরণ বলে দিয়েছিলেন। অনেক ক্ষণ কথা বলেছিলাম, টেপরেকর্ডার অন ছিল।

বলেছিলেন, ছোটবেলায় কলমি শাক তুলতে গিয়ে ওঁর মা মারা যান। মায়ের মরে যাওয়া নিয়ে কথা বলতেন, সেটাই কবিগান হয়ে যেত। লোকে শুনত আর কাঁদত। বালক বয়সেই বাবার সঙ্গে গরু চরাতেন, গরুকে তাজা ঘাস খাওয়াতেন, যেন বেশি দুধ হয়। ‘সকলই অন্যের গরু, ওরা খাবে দুধ, আমি খাই ফ্যান-ভাত অভাগীর পুত।’

আমার ক্যাসেট চালানোর মেশিনটা এখনও কাজ করে। কিছু ক্যাসেট চিটকে গেছে, কিছু ছিঁড়ে জড়িয়ে আছে। কোনও ক্যাসেটের গায়ে লেখা: ‘বারুইপুরের সাপুড়ে’, কোনওটায় ‘আরবালপুরের ভূতের মেলা’। ‘গিরিধারী কবিয়াল’টা চালালাম।

‘উঠিয়াছে ডংকা বাজি শংকা গেল টুটে/ যুক্তফ্রন্ট আসিয়াছে বিজয় মুকুটে/ আঁধারের রাত্রিশেষে নূতন প্রভাত/ অজয়বাবু জ্যোতিবাবু মিলায়েছে হাত/ শোষিত মানুষ যত মজুর কিষান/ নবজন্ম লভিয়াছে, গাহিতেছে গান।’— এ বার একটা গুরুগুরু শব্দ। আমি জানি, এটা মাইক্রোফোনের উপর দীর্ঘশ্বাস।

গিরিধারী কবিয়াল বলছেন: এটা স্যর ’৬৭-তে লিখেছিলাম। তখন এটা আমার সত্যিকারের মনের কথাই ছিল। আমি কিছু বানায়ে বানায়ে লিখি না স্যর। আমার ঠাকুরের উপদেশ মাথায় নিয়ে লিখিছিলাম— ‘গুরু পুরোহিত সব ভণ্ড পরজীবী/ দেবপূজা তীর্থকর্ম মিছামিছি সবই/ বিবেক যাত্রায় নাই, আছে মোর বুকে/ কুকর্মে রত হলে দাঁড়ায় সম্মুখে।’ বিবেক যা আদেশ করে তা-ই লিখি। ‘জয় বাংলা জয় বাংলা বলে বর্ডার চলো দলে দলে, চাঁদা দাও মুক্তিসেনানীরে’ লিখিছিলাম, ‘হৃদয়ে যদি মুজিব থাকে, মস্তকেও ইন্দিরা’ও লিখিছিলাম। ইন্দিরা গাঁধীকে যখন মারা হল, লিখিছিলাম— ‘কী নিদারুণ খবর দিল আকাশবাণী বেতারে/ তোমার লাগি বক্ষ চাপড়ি, কান্দে ভারত মাতা রে!’

তার পর বামফ্রন্ট এল। মজুরির আইন হল, ভাগচাষ আইন হল, জমি খাস হল— সেও লিখিলাম। গাইলাম, ‘ভয় পেয়ো না ভাগচাষি, রেকর্ড করাও মাঠে আসি, আমাদের সঙ্গে আছে নয়নমণি হরেকৃষ্ণ কোনার। এ বার সময় এল ধানের চারা বোনার।’ আমাকে কয়েক জন মাতব্বর সভায় ডেকে ফলক তুলে দিল। ওই দেখুন, কাস্তে-হাতুড়ি খোদাই করা। কালো হয়ে গিয়েছে। একটা পাউডার আছে, হাটে বিকোয়, ঘষলি চকচকায়, কিন্তু টেম্পোরালি।

তার পর লিখতে হল— ‘কত ত্যাগ অশ্রুজল আন্দোলন শতদল/ ভুলিয়া বাবু কমরেড/ বাহারে স্যুট পরে রত্নেশ ভুটভুটি চড়ে/ আঙুলের ফাঁকে সিগেরেট।’ রত্নেশ তো গোচারণভূমির মাটি বেচতি লাগল, আর নকুল মণ্ডল লরির ব্যবসা ধরল। শোনেন সে কাহিনি। ‘রত্নেশ রায় আসে গরুচোরা গ্রামে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ব্যবস্থার নামে...’ আধ ঘণ্টা ধরে রত্নেশ-নকুলের কর্মকাণ্ডের পাঁচালি গাইলেন। শেষে বললেন, বোঝলেন তো ফলকটা কালো হয় কেন?

এর পর আর গিরিধারী কবিয়ালের সঙ্গে দেখা নেই আমার। কত কিছু ঘটে গেল এর পর। এখনও উনি লেখেন, গাইতে পারেন না। কণ্ঠ রুদ্ধ। গোঁ-গোঁ করে।

swapnoc@rediffmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy