Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অটোগ্রাফ দিলেন ডলারের উপর

আমেরিকায় বাদ্যযন্ত্রের দোকানে উঁচু তাকের উপরে রাখা একটা সেতারই পছন্দ হয়েছিল শিল্পীর। সেটাই নামিয়ে বাজানো শুরু করতে, ভিড় জমে গেল চারিদিকে। আবেগে তখন কর্মীর চোখেও জল। আমেরিকায় বাদ্যযন্ত্রের দোকানে উঁচু তাকের উপরে রাখা একটা সেতারই পছন্দ হয়েছিল শিল্পীর। সেটাই নামিয়ে বাজানো শুরু করতে, ভিড় জমে গেল চারিদিকে। আবেগে তখন কর্মীর চোখেও জল।

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০৮:০০
Share: Save:

সালটা ১৯৫৮। সাধারণ পোশাক পরা ৩৫-৩৬ বছর বয়সের যুবকটি যখন দোকানে ঢুকল, দোকানের কর্মী ক্রিস্টিনা শুরুতে তেমন আমল দেননি। এ রকম বহু কৌতূহলী মানুষই আসেন তাঁদের দোকানে, বেশির ভাগই এটা-ওটা দেখেন, প্রশ্ন করেন, তার পর চলে যান। যে সমস্ত বাদ্যযন্ত্র এই দোকানে রাখা আছে, তা বোঝার মতো মানুষ কমই আছেন এই পৃথিবীতে।

সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের এই দোকানটি ইন্ডিয়ান মিউজিকের কার্যত একমাত্র প্রামাণ্য দোকান সারা আমেরিকায়। মালিক ডেভিড বার্নার্ড সেই সমস্ত জিনিস রাখেন যা দুনিয়ার ধ্রুপদী সংগীতের সমঝদাররা কদর করবেন। সেখানে এই সমস্ত সাধারণ এলেবেলে লোকেদের কোনও রকমে হাই-হ্যালো করে পাশ কাটিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

তাই এক রকম নিমরাজি হয়েই ওই যুবককে ‘‘এক্সকিউজ মি, স্যর, আপনাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি?’’ জিজ্ঞেস করলেন ক্রিস্টিনা। আনমনা তরুণটি সেতার দেখতে চাইলেন। ক্রিস্টিনা বুঝলেন, এ নির্ঘাত শখের বাজনদার, কোথাও সেতারের শো দেখে তারও মাথায় সেতার বাজানোর শখ চেপেছে। দোকানের সংগ্রহের সাধারণ সেতারগুলো দেখানো শুরু করতেই লোকটা নিজে থেকেই নানান সেতার নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করল। কিছু ক্ষণ পর ক্রিস্টিনা বিরক্ত হয়ে গেলেন। প্রায় সব রকম সেতার দেখানোর পরও লোকটার যেন কিছুই পছন্দ হয় না। এ রকম একটা সাদামাটা লোক সেতারের বোঝেটা কি? এমন দারুণ দারুণ সেতারের কোনওটাই পছন্দ হচ্ছে না?

হঠাৎ একেবারে ওপরের তাকের দিকে আঙুল দেখিয়ে যুবকটি বললেন, ‘‘ওই সেতারটা মনে হচ্ছে কাজে লাগতে পারে, বাজিয়ে দেখি একটু? যদি দেখান...’’ সেতারটা অত্যন্ত দামি, নামানোও কঠিন, তা ছাড়া ওটা সাধারণের বাজানোর সেতার নয়, একমাত্র কোনও বিরাট মাপের সেতার-বিশারদ ওটা ঠিকঠাক বাজাতে পারেন। ক্রিস্টিনা গলায় একটু ঝাঁঝ মিশিয়েই বললেন, ‘‘ওটা সাধারণ সেতার নয়, নামানো যাবে না। তা ছাড়া ওটা বাজানোর অনুমতিও আপনি পাবেন না, কারণ ওটা ‘বস সেতার’। অত্যন্ত দামি, আর ও বাজানোও সহজ কাজ নয়। ও রকম একটা দামি আর জটিল সেতার নামী সেতারবাদকরা শুধুমাত্র বড় বড় অনুষ্ঠানেই বাজিয়ে থাকেন। আপনি বরং অন্যগুলোর মধ্যে থেকে একটা পছন্দ করুন।’’

কিন্তু যুবকটি নাছোড়বান্দা, সে ওই সেতারটাই দেখবে। এবং নিজে বাজিয়েই দেখবে। উপায় না দেখে ক্রিস্টিনা তাকে পাঠালেন মালিক ডেভিড বার্নার্ডের কাছে। এক প্রকার নিশ্চিত হয়েই যে ডেভিড তাকে পত্রপাঠ বিদেয় করবেন।

যুবকের কথায় কী মনে হল কে জানে, ডেভিড সেতারটা নামিয়ে বাজানোর অনুমতি দিলেন তাকে। সেতারের তার টিউন করতে করতে যুবকটি বললেন, ‘‘আপনারা একে ‘বস সেতার’ বলেন, আমাদের দেশে একে ‘সুরবাহার সেতার’ বলা হয়।’’ তার পর চোখ বুজে শুরু করলেন সেতার বাজানো।

বাজনা যখন শেষ হল, তখন দোকানের ভিতরে-বাইরে ভিড় জমে গেছে। ডেভিড এগিয়ে এসে যুবকটির হাত ধরে বললেন, ‘‘অসামান্য, অভূতপূর্ব! এ রকম বাজনা আমি শুধু পণ্ডিত রবিশঙ্করের শো-তে শুনেছি। হলফ করে বলতে পারি, আপনি ওঁর চেয়ে কম প্রতিভাধর নন। কে আপনি? দয়া করে আপনার পরিচয় দিন, আর বলুন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।’’

যুবকটি বললেন, ‘‘এই সেতারটি আমি কিনব, আপনি শুধু বিলটুকু করে দিন।’’ দোকানের মালিক বললেন, কিনতে হবে না, আমি আপনাকে এই সেতারটা উপহার হিসেবে দিলাম।’’ ক্রিস্টিনা সেতারের সুর শুনে আবেগে কাঁদছিলেন, এগিয়ে এসে যুবকটির হাতে একটা ডলারের নোট গিয়ে বললেন, ‘‘আমি ভারতীয়দের একটু নিচু নজরে দেখতাম, গুরুত্ব দিতাম না, কিন্তু আপনার বাজনা যেন আমাকে চাবুক মারল। জানি না ভবিষ্যতে আমাদের দেখা হবে কি না, আমি এই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই। যদি অনুগ্রহ করে এই নোটে আপনার একটা অটোগ্রাফ দেন, আমি সারা জীবন এটা আমার সঙ্গে রাখতে চাই— এমন এক জন অসাধারণ প্রতিভার স্মৃতি হিসেবে।’’

যুবকটি সেতার নিয়ে ফিরলেন। সে বছরই, রাগ খাম্বাজের উপর তৈরি করলেন একটা গান, ব্যবহার করলেন সেই সুরবাহার সেতারটি। লতা মঙ্গেশকর গাইলেন সেই গান: ‘না যেয়ো না, রজনী এখনও বাকি...’। সুপারহিট সেই গান পরের বছর তৈরি করলেন হিন্দিতেও।

ক্রিস্টিনার নোটে সেই যুবক সে দিন লিখে এসেছিলেন নাম। সলিল চৌধুরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE