Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধ ও একটি গান

সবে ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে এলাম। ফেব্রুয়ারি এলেই মনের মধ্যে ভেসে আসতে থাকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ এই গানটির রচয়িতা আবদুল গফ্‌ফর চৌধুরীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যখন আমি বিবিসি-র চাকরি নিয়ে লন্ডনে যাই। সেই বন্ধুত্ব এখনও অটুট।

বাংলাদেশ স্বাধীন। পাক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি সই করছেন আত্মসমর্পণপত্রে।

বাংলাদেশ স্বাধীন। পাক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি সই করছেন আত্মসমর্পণপত্রে।

পঙ্কজ সাহা
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

সবে ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে এলাম। ফেব্রুয়ারি এলেই মনের মধ্যে ভেসে আসতে থাকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ এই গানটির রচয়িতা আবদুল গফ্‌ফর চৌধুরীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যখন আমি বিবিসি-র চাকরি নিয়ে লন্ডনে যাই। সেই বন্ধুত্ব এখনও অটুট। তিনি দীর্ঘ দিন লন্ডনে। তাঁর কাছে শুনেছি এই গান রচনার ইতিহাস। ১৯৫২ সালের সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ঝোড়ো দিনটিতে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে যে মিছিল বেরিয়েছিল, তাতে তিনি পা মিলিয়েছিলেন। মিছিল খানিকটা এগোতেই গুলি চলতে শুরু করল। গফ্‌ফর ভাই দেখলেন, বন্ধুরা একের পর এক লুটিয়ে পড়ছেন। তিনি ছুটতে শুরু করলেন। বাড়িতে পৌঁছে সমস্ত ক্ষোভ, প্রতিবাদ উজাড় করে দিয়ে লিখলেন একটি কবিতা। সেই কবিতা থেকেই পরে, আলতাফ মাহমুদের সুরে, সৃষ্টি হল এই আশ্চর্য গান। ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে গিয়েছে এই গান।

১৯৭১ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল, তখন আমি আকাশবাণীতে। খবর পেলাম, পূর্ব বাংলার যে সব সংগীতশিল্পী এ-পারে চলে এসেছেন, তাঁরা ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণিতে রিহার্সাল করছেন। ছুটলাম তাঁদের গান রেকর্ড করতে। দেশভাগের পর সেই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পীদের গান এখানকার বেতারে প্রচারিত হল। ওই শিল্পীরা রবীন্দ্র সদনে একটি ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান করেছিলেন। ও-পার বাংলার শিল্পী মুস্তাফা মানোয়ারের নেতৃত্বে, ওই অনুষ্ঠানের জন্যে সারা রাত ধরে সেট তৈরির কাজে আমিও হাত লাগালাম। স্বাধীনতার পরে যখন এক বার বাংলাদেশ গেলাম, তখন মুস্তাফা মানোয়ার বাংলাদেশ টিভির ডিরেক্টর জেনারেল।

সত্তর দশকে ‘ইন্সটিটিউট অব অডিয়োভিস্যুয়াল কালচার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছিলাম। সেখানে রোজ সন্ধ্যায় ও-পার বাংলার শিল্পী সানজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, শাহীন সামাদ, বেণু, ডালিয়া নওশীন, আজাদ হাফিজ, বিপুল ভট্টাচার্য, তারেক আলি, আরও অনেকে আসতেন। আকাশবাণী কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপ সেনগুপ্তকে জানালাম শিল্পীদের আর্থিক কষ্টের কথা। তাঁর নির্দেশে এক দিন সব শিল্পীকে নিয়ে গেলাম আকাশবাণীতে। তিনি তাঁদের আকাশবাণীর অতিথি শিল্পী করে নিয়ে, তাঁদের গান সম্প্রচারের এবং আয়ের একটা পথ খুলে দিলেন। দিলীপবাবু এক দিন আমাকে জরুরি তলব করে একান্তে বললেন, এ বার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবে। সেই অনুযায়ী অনুষ্ঠান তৈরি করতে লেগে যাও। ঝাঁপিয়ে পড়লাম একের পর এক অনুষ্ঠান তৈরি করতে।

বনগাঁ সীমান্তে গেলে চোখে পড়ত, দু’দিক দিয়ে চলেছে সারিবদ্ধ মানুষ। বাঁ দিকে মানুষের মিছিল চলেছে ও-পারের মানুষের হাতে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, যার যা সাধ্য। কেউ গরুর গাড়িতে কিছু চাল-ডাল নিয়ে চলেছেন, কেউ রিকশা করে বালতি-মগ, কেউ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পোশাক, কম্বল। যেন এক মানবিকতার মিছিল। আর ডান দিকে দলে দলে লোক মাথায়, কাঁধে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ছুটতে ছুটতে প্রবেশ করছেন ভারতে। সীমান্ত তখন উন্মুক্ত। ভারতে ঢুকে পড়েও তাঁদের ভয় কাটেনি, তখনও তাঁরা ছুটছেন। এক দিন দেখেছিলাম, সেই ছুটন্ত শরণার্থীদের সারিতে একটি পরিবার, সব সদস্যের মাথায়-কাঁধে বাক্স, পুঁটুলি, আর সব শেষে পিছিয়ে পড়েছে একটি ন্যাংটো শিশু। সে তো কোনও মাল বয়ে আনতে পারেনি, কেবল গভীর মমতায় একটি স্লেট আর একটি বই বুকে জড়িয়ে ছুটে ছুটে আসছে। আমার কল্পনা করতে ভাল লাগে, সেই শিশুটি এখন বড় হয়ে হয়তো কোথাও শিক্ষকতা করছে।

যা কিছু খবর, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি সীমান্তের এ-পার থেকেই সংগ্রহ করার নির্দেশ ছিল, কিন্তু তারুণ্যের উৎসাহে ও উত্তেজনায় আকাশবাণীর পরিচয়পত্র সামরিক বাহিনীর কাছে গচ্ছিত রেখে, সীমান্ত পেরিয়ে যুদ্ধরত পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছি। এক দিন সীমান্ত পেরিয়ে, টেপরেকর্ডার কাঁধে কিছু দূর এগোনোর পর, আওয়ামী লিগের কয়েক জন সদস্যের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁরা আমাকে একটি গাড়ি দিলেন, আমার সঙ্গে থাকলেন এক জন। যশোর রোড ধরে এগোতে এগোতে তাঁদের কাছে জানতে চাইছি মুক্তিযুদ্ধের নানা খবর। লক্ষ করলাম, গাড়ির তরুণ চালকটি কোনও কথা বলছেন না। পরে জানলাম, তিনি এক ধনী হিন্দু পরিবারের ছেলে। তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে খানসেনারা হত্যা করেছে। তরুণটি ধানের গোলার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সব দেখেছেন। এখন তিনি বাক্যহারা। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে সারা দিন তাঁর গাড়িটা নিঃশব্দে চালিয়ে যাচ্ছেন।

পৌঁছলাম ঝিকরগাছা হাটে। সেখানে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্‌স-এর দুজন সদস্য, গরুর গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে সবাইকে সতর্ক করছেন: ‘ভাইরা, তোমরা সবাই বাসায় চলে যাও, খানসেনারা যে কোনও মুহূর্তে এসে পড়বে।’ হাটের মানুষ আমার পরিচয় জানতে পেরে খানসেনাদের অত্যাচারের কথা বলতে লাগলেন। তাঁদের কথা রেকর্ড করতে লাগলাম। তাঁরা তাঁদের হাতে তৈরি বাংলাদেশের পতাকা আমাকে উপহার দিলেন, আর আমাকে ঘিরে গাইতে লাগলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’ সে দিন প্রত্যক্ষ ভাবে অনুভব করেছিলাম, ভাষা আন্দোলনই মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা।

গেলাম যশোরের বিখ্যাত নাভারন হাসপাতালে। খানসেনারা এগোতে এগোতে রাস্তার দু’পাশে খেলাচ্ছলে সাধারণ মানুষকে গুলি করেছে। তাদের নিয়ে আসা হচ্ছে এই হাসপাতালে। কারও হাত উড়ে গেছে, কারও পায়ে গুলি লেগেছে। হাসপাতালে ঢুকে দেখা হয়ে গেল আমার বন্ধু শিবাজী বসুর সঙ্গে। সে তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রনেতা (এখন তো সে কলকাতার বিখ্যাত ইউরোলজিস্ট)। বিস্ময়ে বললাম, তুই এখানে! শিবাজী বলল, ‘আমরা কলকাতা মেডিকেল কলেজের মাস্টারমশাই আর ছাত্ররাই তো এই হাসপাতাল চালাচ্ছি। এখানকার ডাক্তাররা তো নেই। কিন্তু এটা একেবারে গোপন রাখতে হবে। যেন ব্রডকাস্ট হয়ে না যায়।’ আমি ওর কথা রেখেছিলাম। বাইরে এসে দেখি, এক পুরুষ-নার্স পাকিস্তানের পতাকা পোড়াচ্ছেন, তাঁকে ঘিরে মানুষ গাইছেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...’

গাড়ি এগোচ্ছে পুব বাংলার আরও ভেতরে। দেখি, ধানখেতের মধ্যে দিয়ে রাইফেল কাঁধে দু’জন ছুটতে ছুুটতে চিৎকার করে আমাদের থামতে বলছেন। তাঁদের গাড়িতে তুলে নিলাম। মুক্তিযোদ্ধা তাঁরা, সে দিন ওই অঞ্চলে খানসেনারা বিপুল সংখ্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেখে কৌশল হিসেবে রিট্রিট করছেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, দেখুন, আমরা তো এক। আপনার-আমার খুন, মানে রক্ত তো একই। আপনারা ছিলেন, দুর্গাপুজো হত, ছেলেবেলায় আমরাও গেছি সেই উৎসবে। তার পর সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। আবার দেখবেন, দুই বাংলা এক হয়ে যাবে। কিছু ক্ষণ নীরবতার পর কানে এল, এক মুক্তিযোদ্ধা গুনগুন করে গাইছেন সেই গান, ‘...আমি কি ভুলিতে পারি।’

pankajsaha.kolkata@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pankaj saha bangladesh independence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE