Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আপনিই ফ্যাসিস্ট

সংসদে ঠারেঠোরে এই ভাবেই পরস্পরকে আক্রমণ করতেন জওহরলাল নেহরু ও মেঘনাদ সাহা। অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়সংসদে ঠারেঠোরে এই ভাবেই পরস্পরকে আক্রমণ করতেন জওহরলাল নেহরু ও মেঘনাদ সাহা। অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

জওহরলাল নেহরু ও মেঘনাদ সাহা।

জওহরলাল নেহরু ও মেঘনাদ সাহা।

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৯
Share: Save:

জুলাই ৪, ১৯৫২। মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটি অবলুপ্ত করা হবে কি না, সে বিষয়ে বিতর্ক সংসদে। বলতে উঠলেন কলকাতা উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র থেকে বেলচা-কোদাল প্রতীক নিয়ে জয়ী, বাম সমর্থিত নির্দল সাংসদ— বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা।

শুরুতেই তীব্র আক্রমণ সরকারপক্ষকে। আক্রমণের লক্ষ্য, তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রকের মন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ। ১৫ মার্চ, ১৯৫০-এ প্ল্যানিং কমিশন তৈরি হয়। ’৫১-য় মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পরে গুলজারিলাল কমিশনের কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিরোধীদের আহ্বান জানালেন। কটাক্ষ করে মেঘনাদ বললেন, ‘‘কমিশনে তো কংগ্রেসের লোকজনই আমন্ত্রিত। কখনওই বিরোধীরা ডাক পাননি।’’

শিক্ষা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পারমাণবিক শক্তি ও দেশের নদী-বাঁধ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মেঘনাদের। সে দিন তাঁর পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে কিছু ‘জ্ঞান’ আছে জানিয়ে, কেন এ ক্ষেত্রে সব পরিকল্পনা সাংসদদের থেকে গোপন করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। ছুড়লেন মোক্ষম বাণ, ‘‘বর্তমান কার্যক্রমই বলে দিচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’’

‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটিই যেন বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালল। বলতে উঠলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু— ‘‘ডক্টর সাহা ফ্যাসিবাদ শব্দটির অর্থ জানেন না।... উনি বিজ্ঞানকেও অসম্মান করেছেন।’’ পিছু হঠার পাত্র নন মেঘনাদও। ১১ জুলাই, মেঘনাদের এ বার লক্ষ্য স্বয়ং নেহরু। জানালেন, ১৯২৭-এ বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা-র মৃত্যু শতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান কংগ্রেসে’ যোগ দিতে তিনি ইটালি গিয়েছিলেন। সেই সময়ে ফ্যাসিবাদ নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা ও এই মতবাদটিকে কাছ থেকে জানার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। এমনকি, সেই সময়ে বেনিটো মুসোলিনির আমন্ত্রণে এক ভোজসভায় গিয়ে দেখেছিলেন, কী ভাবে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে নামী বিজ্ঞানী, গুণী লোকজন শাসকের ‘ইয়েস ম্যান’-এ পরিণত হয়েছে। পরে কৌটিল্য-শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে এই প্রবণতাটিকেই ফ্যাসিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করলেন মেঘনাদ। এ বার বললেন, ‘‘আমি বলিনি সরকার ফ্যাসিবাদী হয়ে গিয়েছে। বলেছি, ফ্যাসিবাদী প্রবণতার দিকে চালিত হচ্ছে।’’

তুমুল হট্টগোল। স্পিকার কোনও মতে থামালেন। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী সম্পর্কে নেহরুর মন্তব্যকেও ছেড়ে কথা বললেন না মেঘনাদ। জানালেন, এখনও বিজ্ঞানের সঙ্গে তাঁর ভাল যোগাযোগ। বিশ্বের বিজ্ঞানমহল তাঁকে বিজ্ঞানজগতের ‘পিছনের সারির সদস্য’ বলে মনে করে না।

এ বার নেহরু বলতে উঠে মেঘনাদকে ‘সম্মাননীয় বন্ধু’ বলে উল্লেখ করলেন। জানালেন, বিজ্ঞানী হিসেবে মেঘনাদ সাহার কাজ দেশের জন্য গর্বের। বিজ্ঞানের জগতে তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার কোনও অর্থই হয় না। এর পরেই তুখোড় বাগ্মী নেহরুর আত্মপ্রকাশ, ‘‘বৈজ্ঞানিক মেজাজ রাজনীতির ক্ষেত্রেও আসবে, এটাই প্রত্যাশিত।’’ শুধু তাই নয়, সাহার ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দ ব্যবহারের তিনি প্রতিবাদ করেননি। বরং মেঘনাদ তাঁর বিতর্কে ‘ফ্যাসিবাদ’-এর চেয়ে ভাল শব্দ কেন প্রয়োগ করলেন না, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন মাত্র, দাবি করলেন তিনি। এও জানালেন, ‘অপশব্দ’ হিসেবে সাহাকেও তিনি ‘ফ্যাসিবাদী’ বলতে পারেন। এক জন বিজ্ঞানী তখনই এই শব্দ ব্যবহার করতে পারেন, যখন বিজ্ঞানের সংস্রব থেকে দূরে সরে যান তিনি।

ইটালিতে কী ভাবে ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে জেনেছিলেন, সে কথা জানিয়েছিলেন মেঘনাদ। নেহরুও তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুললেন: ‘‘আমি রোমে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার নেমন্তন্ন করেছিলেন মুসোলিনি। কিন্তু তা গ্রহণ করতে পারিনি।’’ মুসোলিনিকে দূরে সরিয়ে রেখেই ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তাঁর জানা!

এ প্রসঙ্গে মুসোলিনিকে সম্বোধনটিও ভারী মজার। মেঘনাদ তাঁর বক্তব্যে মুসোলিনিকে ‘ডুচে মুসোলিনি’ বলেছিলেন। ডুচে-র অর্থ, ‘দ্য লিডার’। এই সম্বোধনেই জনপ্রিয় ছিলেন মুসোলিনি। কিন্তু নেহরু এ ক্ষেত্রেও দূরত্ব বজায় রাখতে সচেতন ভাবেই বললেন, ‘সিনর’ অর্থাৎ ‘মিস্টার’ মুসোলিনি!

বেশ কয়েকবার সাহা-নেহরু বৌদ্ধিক দ্বৈরথের সাক্ষী থেকেছে ভারতীয় সংসদ। নেহরু কিছু ক্ষেত্রে মেঘনাদকে ব্যক্তিগত কটাক্ষও করেছেন। দেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ১৯৫৪-র ২০ ও ২১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলোধোনা করলেন মেঘনাদ। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল, মেঘনাদ ভারত সরকারের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে চিয়াং কাই-শেকের নেতৃত্বাধীন চিনের মিল রয়েছে বলায়। নেহরু মেঘনাদকে ‘ইউজ়ড টু বি এ গ্রেট সায়েন্টিস্ট’ বলে কটাক্ষ করলেন। প্রত্যুত্তরে মেঘনাদ বলেন, ‘‘বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে খুব অল্পই কিছু করেছি। কিন্তু একশো বছর পরেও আমার নাম স্মরণে থাকবে। তবে কিছু রাজনীতিবিদ কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে চলে যাবেন।’’

ভারতবর্ষের সংসদ এমনই নানা বৌদ্ধিক লড়াইয়ের সাক্ষী। তাই কলকাতা উত্তর-পূর্বের একদা-সাংসদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, প্রথম সংসদে ‘‘হর্ষ-নাট্য ও বারুদের কমতি ছিল না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jawaharlal Nehru Meghnad Saha Fascism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE