রবীন্দ্রনাথের জুড়ি নেই বিপন্নতা বাড়াতে! স্বাধীনতা দিবস কবে, কাকে বলে, তা তো ছোটবেলা থেকেই জানি। স্বরাজ সংগ্রাম, শহিদের অবদান, রক্তক্ষয় সেই কবে ইতিহাস বই থেকে হৃদয়ে উঠে এসে চিরকৃতজ্ঞ করে রেখেছে। রাষ্ট্রে, সমাজে, সংসারে স্বাধীনতার গূঢ় গুরুত্বকথাও জানি। কিন্তু স্বাধীনতা কারে কয়, জানি কি? ‘জানি’, বলতেই রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে আলখাল্লার পকেট থেকে চার পঙ্ক্তি বার করে এগিয়ে দিলেন— “শর ভাবে, ছুটে চলি, আমি তো স্বাধীন/ ধনুকটা একঠাঁই বদ্ধ চিরদিন/ ধনু হেসে বলে, শর, জানো না সে কথা—/ আমারই অধীন জেনো তব স্বাধীনতা।”
কী আপদ! মুহূর্তে ‘ফিউজ়’ উড়ে গেল! স্বাধীনতা পরাধীন হয়ে গেল! অবশ্য, এত রহস্য করে না বলা হলেও তত্ত্ব স্বাধীনতা-সংজ্ঞার যুযুধান আন্দাজ দিয়েছে অঢেল-ঢের। কিন্তু তারা যেন অজস্র কামরার ধোঁয়ার উদ্গিরণ ঘটানো ছুটন্ত বাষ্পগতি রেলগাড়ি। সেখানে কামরায় কামরায় ঘর্ষণ টের পাওয়া যায়। পেতে রাখা রেললাইনে মাপ-মাপা যত্নরক্ষিত ফাঁকে চাকা পেরিয়ে যাওয়ার শব্দছাপ অনুভব করা যায়। পাকিয়ে-ওঠা ধোঁয়ার মর্ত্য সংসার ত্যাগ করে উড়ে যাওয়ার তুমুল বাসনাও ভাবুক করে তোলে। কিন্তু রেলগাড়ির কামরায় বসে শরীর জুড়ে গতি আর টের পেলাম কই! সে সব নাগালে না পেয়ে আর বেশি না ভেবে কৌটো খুলে মায়ের দেওয়া লুচি-আলুর দম খেয়েছি এবং দর্শনের দোলনমায়ায় কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোরে ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে পিছনপানে উদ্দাম দৌড়তে থাকা ধানখেত-কলাগাছ, বাগান-পুকুর, চাষি-মজুর, হাট-বাজার, মাঠ-বাড়িঘরের ফাঁক দিয়ে এক্কেবারে মাথা-ঠান্ডা আর নিশ্চিন্ত সূর্যদেবকে উঠতে দেখে বিলক্ষণ মনে হয়েছে, আমি আর কর্ণের বাপ বিলক্ষণ স্বাধীন।
কিন্তু কর্ণ কি স্বাধীন ছিলেন? দিৎসা তাঁকে পরাধীন করেনি? বিশ্বজ্ঞানীরা বলবেন, সূর্যদেবও স্বাধীন নন। বলবেন, ব্রহ্মাণ্ডের কোনও কিছুই স্বাধীন নয়। ঘুরন্ত গ্রহ পরাধীন, স্থির নক্ষত্র আদতে অস্থির। বস্তু বা বস্তু-ভাবনার ঊর্ধ্বের সব অস্তিত্বও প্রচণ্ড নিয়মে বাঁধা। পরমাণু-স্তরে গেলেও নির্মম ভাবে পরাধীনতাই একমাত্র সত্য। তা হলে কি স্বাধীনতা পরাধীনতার বাড়িতে চুক্তিতে ভাড়া থাকে?
তত্ত্ব মাঝেমধ্যে ভাড়াবাড়ির রসিদ দেখায় বই কী! বলে— আইনের শাসন মেনে চলার নাম স্বাধীনতা। এ কথাও বলে— আইনই স্বাধীনতার রক্ষাকর্তা। সে সব ভাবনা নিয়ে তুমুল লাঠালাঠি তত্ত্বে-তত্ত্বে। পাঠ্যের পাতায় পাতায় তখন কুরুক্ষেত্র, ট্রয়। মিল বলছেন, প্রতিবন্ধকতার বিসর্জনই স্বাধীনতা। বলছেন, নিজের দেহ-মনের উপরে সার্বভৌম ক্ষমতাই স্বাধীনতা, আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করার নাম পরাধীনতা। বার্কার মানছেন না। তাঁর মত, আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতা ভোগ করতে চাই, তবে রাষ্ট্রীয় নজরদারি জরুরি। অবাধ স্বাধীন ব্যাপারটাকে তিনি মোটেই পাত্তা দিচ্ছেন না। মার্ক্স অন্য কথা বলছেন। তাঁর মত, অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ হওয়া আর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিসর তৈরি হওয়াই স্বাধীনতার লক্ষণ। এমনই আরও মত, আরও পথ তত্ত্বের। স্বাধীনতায় ব্যক্তি কতটা, রাষ্ট্র কতটা আর আইন কতটা— এ লঙ্কাভাগে কোনও কালনেমিই সহমত নন। আইনের সঙ্গে স্বাধীনতার এমনিতে সম্পর্ক ভালই এবং তেমন ঝগড়াঝাঁটি নেই জানিয়ে বার্কার আবার এক কাঠি এগিয়ে বলছেন, স্বাধীনতার নিজের সঙ্গে নিজেরই বিস্তর চুলোচুলি হতে পারে। কারণ, স্বাধীনতা এক নয়, বহু।
না, এ সব তত্ত্ব নিজে পড়িনি। পড়লেও বুঝতে পারতাম না। কাকা পড়ত। রোজ ভোরে চিৎকার করে নামতার মতো আওড়াত। সবই বিজ্ঞানকথা। কত গবেষণা, ভাবনাচিন্তা, কত দর্শন, নীতি, প্রতর্ক পেরিয়ে তারা বড়-বড় ছাতা খুলে অপেক্ষা করছে জ্ঞানসমুদ্রের তটে মানুষের জন্য। কিন্তু আমি ভিতু। কোনও কিছু না বুঝলে ভয় বেশিই করে! বাধ্য হয়ে কী করলাম? ও সব পড়ে-জেনে-বুঝে যাঁরা স্বাধীনতার এক-একটি বর্ণ পরিচয়, সহজপাঠ লিখে রেখে গিয়েছেন, তাঁদের এক-এক জনকে পড়লাম। যেমন, শামসুর রাহমান। যেমন তাঁর ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটা। তাঁরা ভয় অনেকটা কাটালেন।
*****
কুয়াশার চাদর জড়ানো শীতের ভোর। আমাদের ছোটবেলার মফস্সল শহর তখন ঘন সবুজ। হিমেল আস্তর ওড়নার মতো উড়ে এসে খানিক আবছা করেছে তার পৃথিবী। রাস্তাঘাট আধফোটা ক্যানভাস। তার মধ্য দিয়ে উদ্দাম বেগে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া ছিল আমাদের স্বাধীনতা। তখনও পথকুকুরের আলস্য কাটেনি। খবরের কাগজের গোছা সাজিয়ে স্টেশন-প্ল্যাটফর্ম থেকে বিলির জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়নি তখনও কাউকে। তখনও চায়ের দোকানের উনুন ধরানো হয়নি। আমরা ক’বন্ধু গতি হতাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, জানি না কেউ। তবে যাচ্ছি যে, তা সত্য।
একই রকম স্বাধীনতা কৈশোরের একটা বড় সময়ে— ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতে হাঁটতে হাঁটতে পাশের পাড়ার বন্ধুর বাড়ির সামনে অপেক্ষা করা। সে এলে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারের মাঠে পৌঁছনো। কিছু সময় দৌড়নো। তার পরে ঝাঁপ গঙ্গায়। আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে। কোনও দিন আধ ঘণ্টা, কোনও দিন এক— অবাধ স্বাধীন সাঁতার। বাড়ি ফেরার পরে দিনের ছক-কাটা নানা কাজে ধীরে ধীরে সে-স্বাধীনতার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া বরাদ্দ অনুশাসনে— রবীন্দ্রনাথ যাকে পারিবারিক তৈমুরলঙদের বীররসের চর্চা বলেছিলেন। কিন্তু ভোরের প্রাপ্তি দিয়ে বেশ চালিয়ে নেওয়া যেত দিনটা।
কিছু রাতেও আমাদের জন্য উপহার সাজিয়ে রাখত স্বাধীনতা। গ্রামরক্ষী বাহিনী। বাড়িতে জেদ করে, পাড়ার সবাই কী বলবে গোছের সামাজিকতার দোহাই পেড়ে সেখানে যোগদান। রাতের সেই দলে নানা বয়সের লোক। সদ্য কৈশোর-পেরনো সমবয়সি দু’-এক জন আমরাও ছিলাম। সপ্তাহে এক রাতে আমরা সেখানে স্বাধীন। পাড়া-পাহারার আলাদা ঘ্যাম। সবাই যখন ঘুমিয়ে, আমরা যেন তখন সীমান্তে জাগ্রত জওয়ানের ভূমিকায়! ভাবলেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ নাগরিক বলে পুলক হত! সে শ্লাঘার পাশাপাশি গ্রীষ্মের রাত আমাদের গুমোট ঘরের বদলে মুক্তি-বাতাস দিত। বর্ষার রাত দিত পাড়ার নানা বাগানের বাতাবি লেবু। তারা আমাদের আঁকশিতে গাছ থেকে সানন্দে ছিন্ন হয়ে সানুনয় প্রশ্ন করত: একটু খেলবে আমাদের নিয়ে? অনুরোধ ফেরাতাম না আমরা। যত ক্ষণ না উচ্ছ্বাসে ফুটিফাটা হয়ে ওঠে বাতাবি, আমরা মারাদোনা-ধর্ম পালন করতাম মাঠে, রাস্তায়, ক্লাবঘরের বারান্দায়। শীতের রাতও উষ্ণতা উজাড় করে দিয়েছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে চাঁদা-তোলা মাংস-ভাতের পিকনিক। সে সব ছিল স্বাধীনতার সহজ উদ্যাপন। তার বড় কারণ, পরাধীন করতে যাঁরা সিদ্ধহস্ত, বেচারি তাঁরা তো তখন ঘুমিয়ে!
আরও কত রকমের স্বাধীনতা ছিল আমাদের শৈশবে-কৈশোরে। সবই যে আমার স্বাধীনতা, তা মোটেই নয়। আরও অনেকেরই। যেমন, সাতসকালে ঠাকুমার পুজোর জন্য ফুল তুলতে যাওয়া, আর কত নতুন-নতুন পোকামাকড়ের সঙ্গে আলাপ। সন্ধেবেলা শাঁখ বাজিয়ে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে ওঠার পরেই ঘরে ঘরে ‘শ্যামলীদের মাধবীদের গান শেখা’। দিনমান কাজে ব্যস্ত হয়ে থুম মেরে থাকা পাড়া যেন কোন এক জাদুতে মুখর হয়ে উঠত তখন। বাড়িতে বাড়িতে সা-রে-গা-মা কিংবা কোনও গান। সঙ্গে সুরো-বেসুরো হারমোনিয়াম। সে ছিল ‘গান শিখতেই হবে’ গৃহনিদানে পরাধীন নবীনদের কান-ফাটানো অথচ পাড়া স্নিগ্ধ করে তোলা মিষ্টি স্বাধীনতা।
সন্ধে একটু গড়ানোর পরেই আর এক স্বাধীনতা। ভাই আর আমি পড়তে বসেছি। খুব লোডশেডিং হত তখন। হ্যারিকেনের আলোয় পড়া। তবে, লোডশেডিং হোক বা না হোক, পাশের বাড়ি থেকে ঠিক ভেসে আসত সেই প্রতি-সন্ধের বজ্রনির্ঘোষ— ‘অশোক ভারতের সম্রাট ছিলেন’। পাশের বাড়ির এক সমবয়সি পড়ুয়া রোজ সন্ধ্যায় ওই একটি লাইনই চিৎকার করে টানা পড়ে যেত। তার আগেও কিছু নেই, পরেও না। সম্রাট অশোক আর এগোননি। সাহস পাননি। তিনি সম্রাট হওয়ার আগে কী করতেন, পরে আদৌ কিছু করেছিলেন কি না, সম্রাট এবং আমাদের ভাগ্যদোষে জেনে ওঠা হয়নি। লাইন থেকে না সরার এই প্রত্যয় ছিল পাশের বাড়ির সেই দিন-লাজুক ছেলেটির সান্ধ্য-স্বাধীনতা। যত দূর জানা যায়, সম্রাট অশোক কোনও দিন তার সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি।
*****
স্বাধীনতা খুব মন দিয়ে আইনস্টাইন পড়েছে বলে মনে হয়। আপেক্ষিকতা গুলে খেয়েছে। যে-আমি টিউশনজীবী প্রথম যৌবনে বৃষ্টি পড়লেই কাকভেজা অভিসারিকা শ্রীরাধিকার ভাবাদর্শে নিজেকে পদাবলি-প্রস্তুত করে তুলে, নানা গলিপথ উজিয়ে, সাইকেল থামিয়ে নির্দিষ্ট এক বাড়ির দরজার ছাউনির তলায় আশ্রয়-অছিলায় দাঁড়ানোকেই মোক্ষ মানতাম, যে-আমার কাছে কোনও এক বর্ষাসন্ধ্যায় সে দুয়ার এক দিন খুলেওছিল, আর বিশেষ কারও মুখ দেখে কোনও উপচার-উৎসব ছাড়াই যে-আমার কাছে সেই ক্ষণটুকুকে মনে হয়েছিল স্বাধীনতা দিবস, সেই আমারই আজ সেই সব কৃতকাজকে বয়সের রীতিজনিত পরাধীনতা বলে মনে হয়। যে-আমি উদ্ভিন্ন বয়সে সন্ধের আগে স্টেশন-বাজার থেকে ফুল কিনে এনে ক্যাসেট প্লেয়ারে চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় চালিয়ে ‘আজি সাঁঝের যমুনায় গো’ শোনাকেই নিভৃত আপন স্বাধীনতা বলে মনে করতাম, ‘সেই-যে দুটি উতল আঁখি উছল করুণায় গো’ শুনে পাতি-অকারণ পুলক-বেদনায় কেঁদে ভাসাতাম, আবার পাড়ার কেব্ল-টিভিতে বৃহস্পতিবার রাত বারোটায় ‘বড়দের ছবি’র প্রার্থিত-কাঙ্ক্ষিত সময়ে কেব্ল-মালিক কানুদাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ চালিয়ে দিয়ে গোপনে বৈপ্লবিক আনন্দ পেতাম কিংবা ভরা বর্ষারাতে শূন্য মাঠে একা শুয়ে ভিজতে ভিজতে গান বাঁধতাম, সেই আমি-র আজ একাকিত্বকে ভয় করে। আজ মনে হয়, অনেকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারাটাই স্বাধীনতা। বোধ হয়, জড়িয়ে থাকার আকাঙ্ক্ষা যেমন স্বাধীনতা, সত্য অর্থে জড়িয়ে থাকাও তেমনই।
তবে, কম বয়সেই সম্ভবত ঢের বেশি স্বাধীন ছিলাম। আয়ু যত গড়িয়েছে, পরাধীন হওয়ার উদগ্র বাসনা নানা ভাবে তত বেশি প্রখর হয়েছে। নানা রশির মায়াবাঁধনে বাঁধা পড়তে উন্মুখ হয়েছি। কখনও পেশায়, কখনও রাজনীতি-ভাবনায়, কখনও সম্পর্কে, কখনও সংসারে, কখনও বা হতাশায়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দক্ষ গায়কও যেমন তাঁর ঘরানার কাছে পরাধীন, বাউলের উদাসী হাওয়া যেমন তাঁর জগতের নয়, সামাজিক-সাংসারিক-রাষ্ট্রিক বিধিনিয়মের ব্যাকরণ তেমনই এক পরাধীন স্বাধীনতার বিস্ময়-আঠা।
আমাদের ইস্কুলের নানা অনুষ্ঠানে পাশের শহরের এক অধ্যাপককে আমন্ত্রণ জানানো হত। বাগ্মী হিসাবে তাঁর বিস্তর নামডাক। শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সমাজসেবী, মানে নিজের দলের লোকজনদের সেবা করার মানুষ হিসাবেও বেশ যশ ছিল তাঁর। পনেরোই অগস্টের ভোরে ইস্কুলের অনুষ্ঠানে আসতেন তিনি, এবং ঝটকা মেরে সাদা পাঞ্জাবির হাত গুটিয়ে বক্তৃতা শুরু করতেন। সে ভাষণ টেস্ট ক্রিকেটে অসীম সময় নিয়ে গড়ে তোলা ধ্রুপদী শতরানের মতো। দীর্ঘক্ষণ চলা সে বাণী-নির্ঝরে অযুত-নিযুত মণিমাণিক্য। কিন্তু তা শেষ হতে চাইত না। আমাদের মন পড়ে থাকত কলা-পাউরুটিতে, কাদামাখা ফুটবল মাঠে। তিনি বলে চলতেন। আমরা বাধ্য হতাম শ্রোতার ভূমিকায় নিবিড় সমীক্ষার অভিনয় করে যেতে। নিজেরা তেমন কিছুই বুঝতাম না শুধু এটুকু বোঝা ছাড়া যে, উনি নিবিড় জ্ঞানী। সে-বক্তৃতা অবশেষে শেষ হলে মনে হত, ঢাকের বাদ্যি থামলে বেশি মিষ্টি লাগে। মূর্খ বলেই আজ মনে হয়, জ্ঞানের নিগড়ে কী ভীষণ পরাধীন পণ্ডিতেরা! ঠিক একই কাজ আমরাও জীবনভর করে থাকি। নিরন্তর জ্ঞান দিয়ে অন্যকে পরাধীন রাখার চেষ্টা করে যাই সংসারে, সমাজে, গণমাধ্যমে, রাজনৈতিক মঞ্চে কিংবা আইনসভায়। কী নিবিড় পরাধীন না আমরা নিজেরাই?
*****
ছোটবেলায় বাড়ির পাশের বাগানে আখ চুরি করতে যাওয়ার মধ্যে যে অনাবিল স্বাধীনতা ছিল, ভোট চুরি করে তার লেশমাত্র মেলে না। সবিতাব্রত দত্তের গলায় উদাত্ত গণগান শুনে যে স্বাধীন শিহর কম্পিত হত বুকে, আজ তুমুল নেতা-নেত্রীর আস্ফালন-ভাষণে তার কণামাত্রও মেলে না। জানি, বয়ঃসন্ধিতে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে পরাধীন ভাবাটাই দস্তুর, কিন্তু মরার বয়সে পৌঁছেও এত পরাধীন লাগা কেন? বাবরি মসজিদ ধংসের রাতে বন্ধুরা দল বেঁধে যখন পাড়ার মন্দির-মসজিদ পাহারা দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম, আগুন-আবহেও নিজেদের স্বাধীন মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ কোটি কোটি নাগরিকের মন-মন্দির মন-মসজিদ হৃদি-গির্জায় যখন নিত্যদাহের রাজনৈতিক অভিক্ষেপ, এত নিষ্কাম পরাধীন আর হীনম্মন্য মনে হয় কেন? সম্ভবত, অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সুফল! অধীনতার রং-রঙিন মায়ায় স্বাধীনতার ধূপধুনোর গন্ধ কবে যেন অবসৃত হয়ে গিয়েছে! দক্ষিণ আফ্রিকায় রেলগাড়ি থেকে মোহনদাসকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ব্ল্যাক নেটিভ’ বলে দেগে দিয়ে। কী ফারাক তার সঙ্গে দিল্লি-হরিয়ানায় কর্মরত পশ্চিমবঙ্গের সেই সব পরিযায়ী শ্রমিকের, মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলায় যাঁদের অনায়াসে বিদেশি বলে দেগে দেওয়া যায়? বাংলাদেশ এখন বিদেশ। কিন্তু বাংলা বিদেশি ভাষা? ভাষার নৃতত্ত্ব রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দেবে? কোকিলকে কুহু-ডাক শেখানো রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা? না কি আপেক্ষিক সাম্রাজ্যবাদ?
মিলিটারি কায়দায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনও ‘বস’ যখন কর্মচারীকে হুমকির ভঙ্গিতে বলেন— ‘ইজ় দ্যাট ক্লিয়ার?’— দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মাথা যদি তাতে হেলে গিয়ে সায় না দিয়ে সসম্ভ্রম বলে উঠতে পারত— ‘নাহ্, বেশ অস্পষ্ট’— সেই সাহসটি হত তাঁর অর্জিত স্বাধীনতা। আধিপত্যবাদকে আজও আমাদের স্বাধীন মন সপাট তাচ্ছিল্য করার স্বাধীনতা পায়নি।
আমাদের মফস্সল শহরে চার দশকেরও বেশি আগে পাড়ার এক দিদি স্বাধীনতার মর্ম চিনিয়েছিলেন। পড়াশোনায় তুমুল। খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক কাজে সবার আগে হাজির। কত বয়স তখন তাঁর? পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। বিনা পয়সায় প্রচুর ছেলেমেয়েকে পড়াতেন। তার জেরে সরকারি ইস্কুলের টিউশনকামী শিক্ষকদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের কোচিং মাছি তাড়ালেও দিদির বাড়ির পড়ানোর ঘর উপচে পড়ে। এ ভাবেই চলছিল। কিন্তু এ বার রোজগারের প্রয়োজন পড়ল। সংসার টানতে কিছু একটা করতে হবে। চাকরির জন্য অপেক্ষা করার মতো সময়ও নেই। হাল ধরতে হবে সংসারের। কী করলেন দিদি? পাড়ারই একটি ঝিমিয়ে পড়া চপের দোকান ভাড়া নিলেন। এলাকার সবাই অবাক হয়ে গেল! অমন একটা মেয়ে— সে কি না চপ ভাজবে! অনেকে অনেক পরামর্শ দিলেন। দিদি কানে নিলেন না। এক বিকেলে মার্জিত চেহারায় সে দোকান নতুন করে খুলল। অচিরে জমে উঠল দিদির দোকান। ভরা সন্ধ্যায় নিত্য যানজটের মতো অবস্থা দোকানের সামনের সরু রাস্তায়। ‘মিথ’ হয়ে উঠলেন এলাকার সব মানুষের আপদে-বিপদে দাঁড়ানো প্রতিবাদী আর বিনয়ী দিদি। পড়ানো কি বন্ধ হল দিদির? মোটেই নয়। ওই দোকানেই দু’বেলা দিদির নিজের পাঠশালা চলতে লাগল।‘পথের পাঁচালী’র প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের ছিল মুদির দোকানের পাঠশালা। আমাদের দিদির পাঠশালা চপের দোকানে। আমরা স্বাধীনতার নতুন পাঠ শিখে নিয়েছিলাম।
*****
জীবন, জীবনের সান্দ্র প্রাণরেণু আমাদের অন্তরমহল নিজের মতো করেই সাজিয়ে রাখে। অধিকাংশ সময়েই চিনে নেওয়ার সাহস পাই না আমরা। কিছু মশাল, কোনও দিশা, কোনও মাঝি স্বাধীন সেই ব্রহ্মাণ্ডে নিয়ে যান আমাদের। সবাই সুযোগ পাই, এমনও নয়। পেলে বর্তে যাই। পৃথিবী বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
প্রথম যৌবন বলাটা ঠিক হবে না, দ্বিতীয় যৌবন বলা যেতে পারে। আমরা তখনও অধিকাংশই বেকার। একটা বড় দল ছিল আমাদের, যে দল সন্ধেবেলায়, টিউশন পড়িয়ে রাত দশটা নাগাদ বা দুপুরেও গঙ্গার ধারের দখল নিত। পচা, কাজল, বাবু, তরুণ, আশিস, উজ্জ্বল, কাজল, রাজেন, রিন্টু, সুকান্তি, স্বরূপ— বিরাট বাহিনী। চর্চার মূল বিষয় দু’টি: রাজনীতি আর ব্যথা। আড্ডা বসত কাজলের বাড়িতেও। সেখানে আমাদের হই-হট্টগোল, তাস-ক্যারমের ধুন্ধুমার এবং তারস্বরে সুমনের গান ‘তোমাকে চাই’ শোনার ইন্ধন দিতেন কাকিমা, কাজলের মা। অন্ধকার নিয়ে দিন কাটানো তখন। আমাদের মধ্যে হাতে-গোনা ক’জন ভাল পড়াশোনার সুবাদে প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি সবেমাত্র পেয়েছে। বাকি আমরা ‘এমনি এসে ভেসে যাই’ দশায়। আমাদের সেই পৃথিবীতে আড্ডার মাঝখানে তেলেভাজা-মুড়ি বা রুটি-তরকারি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে স্বাধীন ভাবনার পাঠ দিতেন কাকিমা। হালকা ছলে এমন কিছু বলে যেতেন, বাড়ি ফিরে আনচান লাগত। সেই আনচান বাঁচার পথ দেখাত। ধীরে ধীরে পথ পেলামও গঙ্গার ঢেউ গোনা সব ক’টাই। আমাদের কাকিমা স্বরাজসাধক না হলে, কে আর!
আর এক স্বাধীন মনের সন্ধান পেয়েছিলাম। পচা— অসিত দাস। আমাদের গঙ্গা-দলেরই এক জন। ছোট ক্লাস থেকে আমার সহপাঠী, সমবয়সি। এখন তিনি শিক্ষক। কিন্তু সে সময়ে দুপুরের পর দুপুর তখনও-বেকার পচা তখনও-বেকার আমায় তার বাড়িতে, তার ঘরে এমন অনেক কিছুর সন্ধান দিয়েছিল, যা আজ বিস্মিত করে। পচা অঙ্কপাগল। দুপুরে যেতাম ওর বাড়ি। চাকরির পরীক্ষা সবাই দিচ্ছি। কিন্তু আমি অঙ্কে তেরো! আমায় অঙ্ক শেখানোর চেষ্টা শুরু করল পচা। আমার উর্বর মাথার সৌজন্যে সে ভাবনার অবশ্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতোই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটল। কিন্তু শিখলামও অনেক কিছু। পচা আঁকা শেখেনি, কিন্তু রং চেনাল। পচা গান শেখেনি, কিন্তু সুর চেনাল।
এক গ্রীষ্ম-দুপুরে সাদা কাগজে আস্ত একটা মেয়ে এঁকে ফেলল পচা। চোখের সামনে সে মেয়েকে ধীরে ধীরে জন্মাতে দেখলাম, শুয়ে পড়তে দেখলাম ঘাসের উপর, বিরহদগ্ধ হতে দেখলাম, এক হাত কনুইয়ে ভর করে অন্য হাতে ভূর্জপাতায় চিঠি লিখতে দেখলাম। কাকে লিখছে চিঠি? সে ছবিতে আরও দু’জন উঁকি মারল। দু’টি হরিণ। এল এক জন কাঠবিড়ালিও। সবুজ গাছগাছালি আর নীলাভ-ফিতে নদীকে পিছনে রেখে কী লিখছে ওই সুন্দরী? জানি না। ছবি সাঙ্গ করে পচা পরনের লুঙ্গিটাকে শাড়ির মতো করে দুলিয়ে নেচে উঠে বলল, ‘শকুন্তলা!’ মানে, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা? বলল, ‘হ্যাঁ তো!’ হেসে বললাম, সত্যি বল তো, কাকে আঁকলি? পাড়ার দু’একটা মেয়ের নামও জুড়ে দিলাম। আবারও এক পাক ঘুরে পচা বলল, ‘ধুস! শকুন্তলাই!’ ভরদুপুরে শকুন্তলা কেন ঘাড়ে চাপল ওর, বুঝলাম না। বললাম, চল, নাজিরদার দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। আনমনা পচা বলল, ‘তুই যা। কান্নাটা আঁকতে হবে। কাঁদছে তো!’
সে বয়সেই কি কালিদাস পড়ে ফেলেছিল পচা? মনে তো হয় না। এই অভিজ্ঞান তা হলে পেল কোথা থেকে! কোথায় শিখল এমন আঁকা? মন থেকেই নিশ্চিত— স্বাধীনতা। কী করে জানল, শকুন্তলাদের চোখের পাতা অমন ভিজে হয়? অবশ্যই জীবন থেকে— স্বাধীনতা। পাড়ায় পাড়ায় অভাব তো নেই শকুন্তলার! কী শিখলাম? শিখলাম, সব চেয়ে বড় শাস্ত্র স্বাধীন মন। শিখলাম— স্বাধীন চিন্তাই আখর-তুলি-রং, শুকনো ব্যাকরণ নিজেই পরাধীন।
জীবনে গান না শিখেও মনে মনে সারাক্ষণের গায়ক পচার সঙ্গে পরিচয় না ঘটলে হয়তো শচীনকত্তাও শোনা হত না, শোনা হত না আব্বাসউদ্দিন, অধরা থাকতেন সুধীরলাল চক্রবর্তী, গীতা দত্ত, তালাত মাহমুদ। ছোট্ট একটা সস্তার ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল পচার স্বাধীন পৃথিবী, স্বাধীন এক-কামরার বট-গজিয়ে যাওয়া দেশ। স্বাধীন সেই দেশের পাসপোর্ট-ভিসা পচাই দিয়েছিল আমায়।
বন্ধুতার প্রশিক্ষণ আর নির্ভরতা উজ্জ্বল-রং স্বাধীনতাই। আমাদের সেই স্বাধীন গঙ্গা-টিমেআমি আজ আর নেই। মাটি হারিয়ে অনেক দূরে। কিন্তু স্বাধীন ভাবনার সেই সুগন্ধ একবিন্দু মোছেনি— শকুন্তলার চিঠি যেমন ডাক-গন্তব্য খুঁজে না পেলেও থেকে যায়!
*****
স্বাধীন স্বর রবীন্দ্রনাথ। চোখে দেখিনি, বাঁশি শুনেছি। চির-স্বাধীন সেই সুর-স্বর-রং হজম করতে করতে বৈতরণি উতরে যাবে জীবন, তবু এক-জীবনে তাঁর উপনিষদের পাঠোদ্ধার অসম্ভব। পরলোকে রবীন্দ্র রচনাবলি পাওয়া গেলে অবশ্যই সবার আগে সংগ্রহ করব। কারণ, পড়া হয়নি প্রায় কিছুই। আশা করি, স্বাধীন বাকি আত্মাগণ বাধা দেবেন না।
দেখিনি দিলীপকুমার রায়কেও। কিন্তু এক সন্ধ্যায় কলকাতার যোধপুর পার্কের বাড়িতে কবি জয় গোস্বামী যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিলেন, কাঁপা ফিতের ক্যাসেটে তিরতির করে সুর-স্বাধীন রংধনু-পতাকা কাঁপতে দেখলাম। স্বর-পরিব্রাজন এত স্বাধীনও হয়? স্বাধীন অভিব্যক্তির এমন সংবিধানও সম্ভব? এ ভাবেও রস চুঁইয়ে পড়ে উচ্চারণে?— ‘মুঠো মুঠো রাঙা জবার’ স্বাধীনতা! এক সব পেয়েছির দেশে নিয়ে গিয়ে তাঁর ‘বৃন্দাবনের লীলা’ যেন বলল— বাছা, দাও তুলে তোমার হৃদ্পতাকা! আজ সুরের স্বাধীনতা দিবস!
স্বাধীনতার সন্ধান দিয়েছিলেন নাট্যমানুষ রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। নান্দীকারের মহড়াঘরে কোনও একটি বিষয় তুলে ধরে তাকে নিয়ে সম্ভাবনার জাল বুনতে শিখিয়েছিলেন স্যর। চরিত্রকে নিজের মতো করে ভাববার ব্যাটন তুলে দিয়েছিলেন আমাদের মনে। পরিভাষা— ‘ইম্প্রোভাইজ়েশন’, লক্ষ্য— স্বাধীনতা। নাট্যকলা শিখে উঠতে পারিনি, কিন্তু মনের পরাধীন অন্দরমহলে, ঘুমন্ত চিলেকোঠায় যে কত-কৌণিক ক্ষুধিত-পাষাণ স্বাধীন-মন জমে থাকে, তার সূচিপত্রটুকুর খানিক-ঝলক অন্তত দেখেছি।
‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়’? কেউ না। কিন্তু কী কী ভাবে হওয়া যায় স্বাধীন? আচ্ছা, স্বাধীনতার প্রত্যর্পণও হয়? হয় বোধ হয়। বাংলা গান যেন তার প্রমাণ ধরে রেখেছে— ‘ও তোতা পাখি রে, শেকল খুলে উড়িয়ে দেব, মাকে যদি এনে দাও’— আমি তোমায় স্বাধীন করব, আগে আমার মাকে এনে দাও। মা— আমার স্বাধীনতা। দ্বন্দ্বমূলক স্বাধিকারবাদ। জানি, আমিও পরাধীন করে রেখেছি অনেককে, অনেক কিছুকে। সংসারে, সমাজে, আপিস-কাছারিতে, মঠ-মন্দিরে। সব তোতা উড়িয়ে স্বাধীন করে দেব। কিন্তু আগে আমার উৎসকে স্বাধীন করা হোক। মা মৃত্যুর কাছে পরাধীন, ক্ষয়ের অধীনস্থ, এটা যে মানব না, তারই চুক্তিস্তোত্র যেন নির্মলা মিশ্রের ওই গান। মনেপ্রাণে আমরা বোধ হয় শর্তসাপেক্ষ মাউন্টব্যাটেন।
হ্যাঁ, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া আমার স্বাধীনতা। হ্যাঁ, প্রত্যর্পণের শর্তও আমার স্বাধীনতা। হ্যাঁ, রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান আমার স্বাধীনতা। হ্যাঁ, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো কাজী নজরুল আমার স্বাধীনতা। হ্যাঁ, পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল আমার স্বাধীনতা। হ্যাঁ, পিতার কোমল জায়নমাজ়ের উদার জমিন আমার স্বাধীনতা। আমার স্বাধীনতা শ্রীচৈতন্য, সুফি, লালন, পরমহংস, পদাবলি, বিদ্যাসাগর, গির্জাগান, মহাত্মা গান্ধী, নিখিল বাঁড়ুজ্যে, আজান, ভীষ্মদেব, কীর্তন, বাবা আলাউদ্দিন, রুপোলি পর্দা, মঞ্চ, খেলার মাঠ, অবনঠাকুর, গণেশ পাইন— অগণন স্বাধীনতা আমার।
*****
শাস্ত্রীয় গানের শিল্পীরা যখন সরগম করেন, তখন কি সত্যি মনে হয়, ওঁরা মুখস্থ করে এসে কুলকুচি করছেন? না কি আমরা যেমন অ-আ-ক-খ শিখি এবং ‘অ-আ-ক-খ দিয়ে শব্দ বলো তো’ বললেই অনায়াস যেমন অনেক শব্দ বলে যেতে পারি, তেমনই পারেন ওঁরা? ওঁরা ওঁদের অক্ষর উচ্চারণ করছেন। ওঁরা ওঁদের ভাষায় কথা বলছেন। আমরা শুধুমাত্র ‘পায়েলিয়া ঝঙ্কার’টুকুই বুঝতে পারছি। স্বাধীনতা তেমনই। শুধুই সাংবিধানিক নয়। প্রতি অলিন্দে-নিলয়ে তার সুর বেজে চলেছে। তাই বৃদ্ধ বাবাকে গাঁ-দেশে হাতছাড়া হওয়া একদা-নিজেদের ছোট্ট আমবাগানে গিয়ে শিশুর মতো স্বাধীন হয়ে ছুটতে দেখেছি। মাকে দেখেছি সাঁতার প্রতিযোগিতায় আমাদের সঙ্গে পুকুরে ঝাঁপিয়ে সংসারের মালিন্য ধুয়ে ফেলতে। সবই স্বাধীনতার সরগম, নিজের-নিজেদের আখরে।
প্রথম চুম্বনের স্বাধীনতা, স্বাধীনতা প্রথম মিলনের, রাজনৈতিক আর্দশের স্বাধীনতা, স্বাধীনতা ধর্মপালনের, ভাষার স্বাধীনতা, স্বাধীনতা নারীর, তৃতীয় লিঙ্গের স্বাধীনতা, স্বাধীনতা মানুষের অধিকারের— সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল— যারা গড়ে তুলতে চায় মহাদেশের-পৃথিবীর, অতল সাগরের স্বাধীন সত্তা। অসাম্যের, চোখরাঙানির কোনও অংশীদারি নেই সত্য-স্বাধীনতার উইলনামায়।
কিন্তু প্রশ্ন— ‘লিবার্টি’ না ‘ফ্রিডম’— কার কপালে চন্দনচিহ্ন এঁকে দেব? কীর্তনে আখর মাখা আমার স্বাধীনতা, কিন্তু গান-বয়ানের মাঝপথ থেকে রবীন্দ্র, নজরুল, অতুল, রজনী বা যে কোনও সঙ্গীতকারের গান গাইতে শুরু করার বাসনা স্বাধীনতা নয়। যেমন স্বাধিকার-পথ নয় দেশপ্রেমের অছিলায় সরকার-নিয়ম-নিদান কাঠামোর জনবিরোধী শিলানির্দেশও।
ভুল মন্ত্রে অর্চনা অসম্ভব। ভুল নিদান চোখ বুজে মানতে গেলে এ কথাও মানতে হয় যে, অন্য বর্গের স্বাধীনতাও হয়। যেমন, ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ খাওয়া স্বাধীনতা, রাজনীতিকের দুর্নীতি স্বাধীনতা, ধর্ষণ পুরুষের স্বাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতার নিগড়ে বেঁধে রাখা স্বাধীনতা ছদ্ম-ধার্মিকের বা ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের। তা হলে কি আমাদের ছোটবেলার প্রতিবেশী রিকশাচালক রামুকাকার রোজ রাতে নেশা করে বাড়ি ফিরে কাকিমাকে মারধর করাটা স্বাধীনতাই ছিল? তা হলে কি বিয়ে করে ধর্ষণের ছাড়পত্র প্রাপ্তি স্বাধীনতা? শিশুশ্রম বড়দের স্বাধীনতা? গণপিটুনি কি গণস্বাধীনতা?
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে আগের রাতে বন্ধুরা মিলে জঙ্গলপথে মদমাতাল টুইস্ট নাচ অবশ্যই স্বাধীনতা। পরের সকালে পাহাড়ী সান্যালের কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের ‘সে ডাকে আমারে’ শোনাও প্রকৃতি-আবেশে মনকে স্বাধীন বাতাস জোগানো। কিন্তু আদিবাসী মেয়ের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে সম্মতি বা অসম্মতিক্রমে তাঁকে ভোগ করে আসা চরিত্রটি কি আদতে স্বাধীন? নাহ্, নিজের শিকলে নিজে পরাধীন। কবীর খানের ছবি ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর নামচরিত্র সলমন খান বা পাক সাংবাদিক চরিত্রে নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকির মন আর জঙ্গি হামলায় মদতদার শিবিরের মন— দু’তরফই এক সঙ্গে স্বাধীনতার উদাহরণ হতে পারে না। স্বাধীনতা ভয় বা ভয়ে-ভক্তি চায় না, ভালবাসা চায়।
গোড়ায় গলদ ধরিয়ে দেওয়ার পান্ডা রবীন্দ্রনাথই লিখছেন— পারিবারিক দাসত্ব, স্বাধীনতা প্রসঙ্গে: “ভক্তির ভাব ভাল, কিন্তু ভক্তির অপেক্ষা অনুরাগের ভাব আরও ভাল; কারণ, ভক্তিতে অভিভূত করিয়া ফেলে আর অনুরাগে আকর্ষণ করিয়া আনে... কত শত কালীভক্ত আছে, কিন্তু রামপ্রসাদের মতো কয় জন ভক্ত দেখা যায়! অন্য ভক্তেরা শত হস্ত দূরে থাকিয়া তটস্থ হইয়া কালীকে প্রণাম করে; কিন্তু রামপ্রসাদ যে কালীর কোলে মাথা রাখিয়া তাঁহার সঙ্গে কথাবার্তা কহিয়াছেন, রাগ করিয়াছেন, অভিমান করিয়াছেন! হাফেজের ন্যায় ঈশ্বর-ভক্ত কয় জন পাওয়া যায়, কিন্তু দেখো দেখি, হাফেজ কী ভাবে ঈশ্বরের সহিত কথোপকথন করেন!”
স্বাধীনতাই হোক বা জীবন— রুদ্ধ দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে তটস্থ হয়ে সম্মান করার বদলে রামপ্রসাদ হলে ক্ষতি কী? কী ক্ষতি হাফেজের মতো প্রেমের মন্ত্রে কথোপকথনে? অবশ্যই ‘আমরা সবাই রাজা’। কিন্তু রাজা ‘রাজার রাজত্বে’ই। এই রাজা রবীন্দ্রনাথের রাজা হলে, অধ্যাত্মচিন্তার রাজা হলে পুণ্য সমীরণ বইতে পারে। কিন্তু সে রাজা রাজতন্ত্রের রাজা হলে, গোলমেলে গণতন্ত্রের রাজা হলে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)