ঝোলার ভেতরে থাকত কবিতার বই। মন্ত্রের মতো সব লাইন। কবিতাপ্রেমিকদের মুখে মুখে ফিরত— কে ভুলতে পারে, ‘মাটি তো আগুনের মতো হবেই/ যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো/ যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও/ তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।/ যে মানুষ গান গাইতে জানে না/ যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।’ দরজায়-দরজায়, মেলায়, গ্রামে ঘুরে ঘুরে নিজের বই বিক্রি করেছেন। ত্রিশ বছর ধরে এ ভাবেই কেটেছে। বইমেলাতেও দেখা যেত, নিজের বই নিজেই বিক্রি করছেন। কাঁধে ঝোলা, মালকোঁচা মেরে ধুতি, পাঞ্জাবি। এই তাঁর পোশাক। ভালবাসতেন বিড়ি, সিগারেট চা। প্রিয় খাদ্য মুড়ি আর জিলিপি। বাঙাল ভাষায়, ঢাকাই টানে কথা বলতেন। চশমা, চটি, কলম, ছাতা হারাতেন প্রায়ই। কবিতা মাথায় এলে হাতের কাছে যা পেতেন— সিগারেটের প্যাকেট বা বাসের টিকিট— লিখে রাখতেন তাতেই। তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। জীবন যাপনে, নিজের আদর্শ, স্বাধীনতা ও সততার প্রতি দায়বদ্ধতায় অন্য কারও সঙ্গে যাঁর মেলে না। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিরল সাহস আর মানুষের প্রতি অনিঃশেষ ভালবাসার জন্য যাকে হামেশাই রাখা হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর ঋত্বিক ঘটকের পাশে।
প্রথম জীবনে যাঁদের কাছ থেকে কবিতা লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন বিমলচন্দ্র ঘোষ এবং অরুণ মিত্র। কলেজে শিক্ষক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে। সুভাষচন্দ্র বসু তখন তাঁর জীবনের প্রেরণা। ঋত্বিক ঘটকের মতোই দেশভাগ তাঁকে আলোড়িত করেছিল। আক্ষেপ করেছিলেন, ‘‘আমার জন্মভূমিকে এখন আমি স্বদেশ বলতে পারি না।’’ চল্লিশের দশকে অনেক কবি-লেখকের সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা। ছিলেন রাম বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের মতো কবি, আবার অমিয়ভূষণ মজুমদারের মতো গদ্যকার, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো গায়ক। বলতেন, ‘‘এদের সবাইকে নিয়ে আমার যে নিজস্ব পৃথিবী তার পায়ের নীচে কিছু শক্ত মাটি রয়ে গেছে, সেখানেই আমার অথবা আমাদের জোর।’’ বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে ‘দেশ’-এ লিখেছেন। কখনও ঢুঁ মারতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র বা দিনেশ দাসের বাড়ি। কখনও শিয়ালদায় সত্যপ্রিয় ঘোষের বাড়ি। শান্তিনিকেতনে অশোকবিজয় রাহা এক বার অসুস্থ বীরেন্দ্রকে সুস্থ করে তুলেছিলেন।
অসুস্থ সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর বই মাঝেমধ্যে খুলে পড়ার চেষ্টা করছেন শুনে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। জীবনানন্দ দেখা হলেই বলতেন, ‘‘ভাল বাড়ি দেখে দিতে পারেন?’’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গল্প আনতে গেলে বলতেন, ‘‘গল্প লেখা হয়নি, তাতে কী, আমার অনেক কবিতা আছে।’’ বারবার কর্মহীন হয়েছেন বীরেন্দ্র। নানান কাজ করেছেন। প্রতিনিয়ত অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তবু সরকারি বৃত্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাকে তীব্র শ্লেষ করে এক বার লিখেছিলেন, ‘রাজা আসে যায়/ রাজা বদলায়।’ আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর। বলতেন, কবি যত শক্তিমানই হোন, তাঁকে ভাল মানুষও হতে হবে।