Advertisement
E-Paper

ঘন জঙ্গলে ঢাকা দ্বারকানাথের ‘হলেজ ঘর’

মোটা লোহার তারে বাঁধা ডুলি। তাতে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসে কয়লা। এটাই হলেজ পদ্ধতি। এ দেশের প্রথম শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত ঘর, কয়লাখনি ও বাংলো আজ শুধুই ভগ্নস্তূপ।মোটা লোহার তারে বাঁধা ডুলি। তাতে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসে কয়লা। এটাই হলেজ পদ্ধতি। এ দেশের প্রথম শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত ঘর, কয়লাখনি ও বাংলো আজ শুধুই ভগ্নস্তূপ।

সুশান্ত বণিক

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০

আজও তিনি শায়িত লন্ডনের কেনসাল গ্রিন সেমেটরিতে। ভারতীয়, বিশেষত বাঙালি পর্যটকদের কাছে এখনও সেই সমাধিস্থল অত্যন্ত মর্যাদার। কিন্তু অনেকেরই প্রায় জানা নেই, ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের অগ্রণী পুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরই প্রথম ভারতীয়, যিনি রানিগঞ্জে একটি আধুনিক কয়লাখনি বানিয়েছিলেন। বাঙালি শিল্পবিমুখ, এই অপবাদ ঘুচিয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুর সে দিন যে কারিগরি দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, তা এখনও তামাম রাষ্ট্রীয় কয়লা উত্তোলক সংস্থাগুলির কাছে এক পরম বিস্ময়। দ্বারকানাথের সৃষ্টি সেই খনি ও বাংলোর ধ্বংসাবশেষ এই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে আজও দ্রষ্টব্য।

ভারতে কয়লা খননের আঁতুড়ঘর রানিগঞ্জ। ১৭৪৪ সালে প্রথম এখানে ইংরেজ সাহেবরা মাটির তলা থেকে কয়লা তুলতে শুরু করে। কিন্তু ইতিহাস দাবি করেছে, দ্বারকানাথ ঠাকুরই প্রথম ভারতীয় যিনি ব্রিটিশ শিল্পপতি তথা ইংরেজ বন্ধু উইলিয়াম কার-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়লাখনি গড়ে তুলেছিলেন। সংস্থার নাম দিয়েছিলেন কার এন্ড টেগোর কোম্পানি। ১৮৩৫ সালে খনি-শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে দামোদর নদের তীরবর্তী নারানকুড়ি গ্রামে ওই ভূগর্ভস্থ কয়লাখনি বানানো হয়। খনি বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, বিশাল একটি কুয়োখাদ বানিয়ে তার দেওয়াল কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করে মাটির গভীর থেকে কয়লা খুঁড়ে বের করার পরিকল্পনা করে এই কোম্পানি। কিন্তু ভূগর্ভের কয়লা উপরে তোলা হবে কী করে? জানা যায়, খনি থেকে কিছুটা দূরে একটি ঘরে কপিকলের মতো বিশাল একটি যন্ত্র বসানো হয়। যন্ত্রের সঙ্গে প্যাঁচানো মোটা লোহার তারের উলটো প্রান্তে সার বেধে জোড়া থাকত একাধিক ডুলি। এতেই কয়লা চাপিয়ে, তার গুটিয়ে কয়লা উপরে তোলা হত। ঠিক যেমন ইঁদারা থেকে জল তোলা হয়। ভূগর্ভে শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া ও ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্যও এই ডুলি ব্যবহার করা হত। এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হলেজ’ পদ্ধতি। যে ঘরে যন্ত্রটি বসানো ছিল তার নাম ‘হলেজ ঘর’। এই পুরো কাজটি হাতে নয়, বাষ্পীয় যন্ত্রের মাধ্যমে চালিত হত। খনি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এখনও দেশের সমস্ত ভূগর্ভস্থ কয়লাখনিতে এই পদ্ধতিতেই কয়লা তোলা হয়। তবে বাষ্পীয় যন্ত্রের পরিবর্তে বিদ্যুৎ-চালিত যন্ত্র বসানো হয়েছে।

আজও নারানকুড়ি গ্রামের ওই পরিত্যক্ত কয়লাখনির পাশে গেলে জঙ্গলে ঘেরা সেই হলেজ ঘরটির দেখা মেলে। খনি থেকে প্রায় তিনশো মিটার দূরেই ছিল প্রশাসনিক ভবনটি। সেখানেই বসে নিয়মিত কাজের তদারকি করতেন দ্বারকানাথ ও উইলিয়াম কার। পাশের একটি ভবনে ছিল অধস্তন কর্মচারীদের ঘর। শোনা যায়, খনির কাজ দেখাশোনা করার জন্য নিয়মিত সেখানে আসা-যাওয়া করতেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বারকয়েক নাকি তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। প্রায় ১৯০ বছরের পুরনো ওই হলেজ ঘরটির দেখা মিললেও প্রশাসনিক ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত। তবে খুঁজলে পুরনো ইট, মেঝের টালির দেখা মেলে।

কয়লা উত্তোলনের পরে কোথায় সরবরাহ হত সেই কয়লা? ইতিহাস বলছে, উত্তোলিত কয়লার বেশির ভাগই চলে যেত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। কিছুটা সরবরাহ হত বিহারে। খনি থেকে তোলা কয়লা গরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হত নারানকুড়ি গ্রামের সীমান্তে মুক্তেশ্বরী মন্দির ঘাটের জেটিতে। সেখানে নৌকায় কয়লা চাপিয়ে তা পাঠানো হত কলকাতার কয়লাঘাটায়। রানিগঞ্জ থেকে কয়লা পরিবহণের জন্য মুক্তেশ্বরী মন্দির জেটিও তৈরি করেছিলেন দ্বারকানাথ। এখন সেখান থেকে নৌকা পারাপার হয় না, তবে সেই জেটির ধ্বংসাবশেষ আজও আছে। এক সময় দ্বারকানাথের মনে হয়, নৌকায় করে কয়লা পরিবহণ অত্যন্ত বিপজ্জনক, আর লাভজনকও নয়। তাই কলকাতা থেকে রানিগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ পাতার পরিকল্পনাও করছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি তো ‘নেটিভ’, তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে রেললাইন পাতার অনুমোদন দেয়নি। তবে পরবর্তী কালে ১৮৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকারই রেললাইন পাতার কাজটি করেছে।

এখন পুরো এলাকাটি রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লা উত্তোলক সংস্থার আওতায়। সংস্থার আধিকারিকদের দাবি, ওই এলাকায় প্রচুর উন্নত মানের কয়লা মজুত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ভূপৃষ্ঠের খুব কাছেই রয়েছে এই কয়লার স্তর। প্রতি মাসে অন্তত পাঁচ লক্ষ টন কয়লা এখান থেকে তোলা যাবে। কিন্তু এলাকার বাসিন্দারা চান, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই এলাকাটিকে ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করা হোক, আজকের প্রজন্ম হাতে-কলমে জেনে নেবার সুযোগ পাক বাঙালির প্রথম, অনন্য শিল্প প্রয়াস। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা, সত্যিই যদি দ্বারকানাথের এই কয়লাখনি লাগোয়া এলাকায় নতুন করে খনন করে কয়লা তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তবে হয়তো দেশের প্রথম ভারতীয় কয়লাখনি মালিকের শেষ চিহ্নটুকুও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

Prince Dwarkanath Tagore প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর Induatrialist Coal Mine Raniganj রানিগঞ্জ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy