Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

বিশ্ব জুড়ে হঠাৎ লাল দিবসটি কালো হয়ে গেল। মার্কিন মুলুকেরই শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনাটির পরে এই দিন পালন করা শুরু। সে দেশেরই প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন পয়লা মে এখন থেকে আর ‘শ্রমিক দিবস’ নয়, বরং ‘মালিক দিবস’ হিসাবে চিহ্নিত হবে। অথচ এখনও পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩৫ ভাগ। তবে, সে দেশের ওয়াশিংটন বার্তায় খবর ছাপা হয়েছে যে, এখন আমেরিকায় নাকি কোনও শ্রমজীবী মানুষ নেই। কলকারখানা সব মালিক একাই কন্ট্রোল করেন রোবট দিয়ে। কাজেই যেখানে যন্ত্রমানব ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে, সেখানে আট ঘণ্টার বেশি কাজ না করার লড়াই নিয়ে মান্ধাতার আমলের ‘মে দিবস’কে আঁকড়ে রাখার কোনও মানে হয়? উন্নয়নশীল দেশের জননায়করা এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। বিশেষত, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এই দিনবদলকে স্বাগত জানিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বলেছেন, তাঁরাও বহু দিন ধরেই দেশ থেকে শ্রমদিবস উঠিয়ে দিয়েছেন। শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার বলে এখানে কিছু রাখা হয় না। তাদের খাওয়া-পরার বন্দোবস্ত করেও অর্থের অপচয় করা হয় না। যে আট ঘণ্টা কাজ করার দাবিতে এত আন্দোলন, সে সব দাবিকে এখানে গুরুত্বই দেওয়া হয় না। বরং ২৪ ঘণ্টা শ্রম নিংড়ে নেওয়াই এ দেশের অর্থনীতির লক্ষ্য। তবে, এই দিনটি এত বছর প্রতীক হিসাবে থাকলেও, অনেক দলই দিনটিকে কেন্দ্র করে নানা অন্যায্য দাবিদাওয়া তুলত, একজোট হয়ে অশান্তি করত। এখন দিনটির অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হলে, সে সমস্যাও মিটবে। আর এত অনাহার, অত্যাচার, বঞ্চনায় শ্রমিকরা মরে গেলেও ক্ষতি কিছু নেই। ভারতবর্ষ বেকারে ভর্তি দেশ। এক জন শ্রমিক মারা গেলে সে জায়গায় ৮০ জন শ্রমিক পাওয়া যাবে। সেই ৮০ জন মারা গেলে তো আরও ভাল। জনসংখ্যা কমবে। নিঃসন্দেহে সাধু প্রস্তাব।

শুভাশিস দাস, দিনহাটা

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

প্লেন হাইজ্যাক হল, নামল দমদমে

১৯৯০ সালের ১০ নভেম্বর। কলকাতা বিমানবন্দরে নাইট ডিউটিতে এসে জানলাম, তাই এয়ারওয়েজ–এর একটা বিমান বিকেল চারটে নাগাদ কলকাতা নেমেছে ‘ডাইভার্সন’-এর কারণ দেখিয়ে, ২০৫ জন যাত্রী আর ১৬ জন বিমানকর্মী নিয়ে। প্লেনটা ব্যাংকক থেকে রেঙ্গুন যাচ্ছিল। নামার পর যথারীতি আন্তর্জাতিক পার্কিং স্ট্যান্ডে পাঠানো হয়েছে। ঠিক তার পরই পাইলট এটিসি-কে (এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল) জানালেন, কোনও মানুষজন বা যানবাহন যেন বিমানের কাছে না আসে, এলেই বিপদ হবে।

ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। পাইলটকে বাধ্য করা হচ্ছে এ কথা বলার জন্য। মানে, প্লেন হাইজ্যাক হয়েছে! এটিসি অফিসারদের মাথায় হাত। আগে বুঝলে প্লেনটাকে ‘আইসোলেশন বে’-তে পাঠানো হত। টারম্যাকে অন্যান্য বিমানের সঙ্গে এটাকে পার্ক করানো যথেষ্ট ঝুঁকির কাজ হয়ে গেছে। প্লেনটা তখন কন্ট্রোল টাওয়ারের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে। রীতিমাফিক বিমানবন্দরের সব কাজ স্বাভাবিক রাখতে হচ্ছে।

ট্রেনিং পিরিয়ডে শিখেছিলাম, বিমান ছিনতাই হলে এটিসিকে কী কী করতে হয়। এমন বিরল অভিজ্ঞতার সুযোগ পেতে কন্ট্রোল টাওয়ারেই ডিউটি নিলাম। এ দিকে খবর এল, আমাদের শিফ্‌ট-ইনচার্জ আসতে পারছেন না, খুব মাথাব্যথা। বুঝলাম, উনি কত বিচক্ষণ! এই সব ঝামেলায় কে পড়তে চায়? পরে তদন্ত সামলাতে হতে পারে কিনা!

ইতিমধ্যে অপহরণ পরিস্থিতির প্ল্যান অনুযায়ী সমস্ত জায়গায় খবর চলে গেছে, কাজও শুরু হয়ে গেছে সেই মতো। অ্যান্টি-হাইজ্যাকিং কন্ট্রোল রুম খুলে দেওয়া হয়েছে, কমিটির সদস্যরা সেখানে যাচ্ছেন। এই কন্ট্রোল রুম এটিসি ইউনিট থেকে স্বতন্ত্র, এটিসির সব রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সির প্যারালাল সেট এখানে রাখা। দিল্লি ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে হটলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থাও আছে।

পরের পদক্ষেপ, হাইজ্যাকারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, তাদের দাবি নিয়ে দরদস্তুর করা, আর বিমানকর্মী সহ সমস্ত যাত্রীদের উদ্ধার করা। তারও আগে জানতে হবে, কী তাদের দাবি।

১০ নভেম্বর, ১৯৯০। কলকাতা বিমানবন্দরের টারম্যাকে দাঁড়িয়ে ‘তাই এয়ারওয়েজ’- এর সেই ছিনতাই হওয়া বিমান।

রাত বাড়ছে, পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। শুধু হাইজ্যাকাররা গ্রাউন্ড পরিষেবার কিছুটা নিতে রাজি হয়েছে। ‘গ্রাউন্ড পাওয়ার ইউনিট’ লাগানো হয়েছে, নইলে প্লেনের নিজস্ব পাওয়ার ইউনিট থেমে গেলে প্লেনের ভেতরটা পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। জানা গেল, অপহরণকারীরা মায়ানমারের, সংখ্যায় দুজন। তারা পাইলটদের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছে এটিসির সঙ্গে, যা শোনা যাচ্ছে কন্ট্রোল রুমেও। কিছু ক্ষণের মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব মণীশ গুপ্ত এসে আলোচনার ভার নিলেন। খবর এল, দিল্লি থেকে কম্যান্ডো বাহিনী নিয়ে বিশেষ বিমান কিছু ক্ষণের মধ্যেই কলকাতায় পৌঁছবে। তারা আসা অবধি আলোচনা চালিয়ে যেতেই হবে। অপহরণকারীরা ইংরেজি জানত। তাদের অনুরোধ করা হল, শিশু, মহিলা ও অসুস্থ যাত্রীদের যেন ওরা প্লেন থেকে নামতে দেয়। ওদের সব দাবি শোনা হবে।

কম্যান্ডো বাহিনীর প্লেন চলে এল, এটিসিতে বসে আমাদের উত্তেজনার পারা চড়তে লাগল আরও। নির্দেশ এল, এই স্পেশাল প্লেনটাকে দূরে কোথাও, সবার অগোচরে দাঁড় করাতে হবে। যে আইসেলেশন বে’তে ছিনতাই-হওয়া প্লেনটাকে পাঠানো উচিত ছিল, স্পেশাল প্লেনটাকে সেখানেই পাঠানো হল।

এ দিকে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে দেখতে পাচ্ছি, ছিনতাই-হওয়া বিমান থেকে কিছু যাত্রী সারিবদ্ধ ভাবে নেমে আসছেন। মানে, ওঁদের ছাড়া হয়েছে। একটু বাদে খবর এল, কম্যান্ডোদের অনেকেই গ্রাউন্ড স্টাফ এবং ক্লিনিং স্টাফের পোশাক পরে প্লেনের ভেতর ঢুকে পড়েছে, রাত বাড়লে কম্যান্ডো অ্যাকশন হওয়ার সম্ভাবনা। ভয় করতে লাগল, চোখের সামনে কী দেখব কে জানে! মনে পড়ে গেল, বছর কয়েক আগে করাচি বিমানবন্দরে ‘প্যান অ্যাম’-এর বিমান ছিনতাই, এয়ারহোস্টেস নীরজা ভানোটের মর্মান্তিক পরিণতির কথা।

ছিনতাইকারীদের মূল দাবি ছিল, তাদের ইন্টারন্যাশনাল প্রেস কনফারেন্স করতে দিতে হবে। তারা মিডিয়াকে বলতে চায় তাদের দেশ মায়ানমার বা বর্মার মিলিটারি অপশাসন আর অত্যাচারের কাহিনি। জানা গেল, ছিনতাইকারী ছেলেদুটি রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ দলের সদস্য। স্বদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি গোটা বিশ্বকে জানানোর জন্যই তাদের বিমান ছিনতাই।

অপহরণকারীদের জানানো হল, প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তারা যেন আত্মসমর্পণ করে, আর বাকি যাত্রীদের ছেড়ে দেয়। রাত বারোটা নাগাদ তা-ই হল। সব যাত্রী আর বিমানকর্মী নিরাপদে নেমে এলে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

ছেলে দুটিকে নিরস্ত্র করতে গিয়ে দেখা গেল, রুমালে ঢাকা যে গ্রেনেড বা বোম দেখিয়ে ওরা প্লেন উড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল, তা আসলে ছিল সাবান আর কিছু তাসের প্যাকেট। মিডিয়ার কাছে ওরা ওদের তিন সদস্যের রক্তমাখা টিপসই-দেওয়া দাবি-সনদ দেখাল। তৃতীয় সদস্যটিও ওদেরই মতো এক ছাত্র, প্লেনভাড়া জোগাড় করতে না পেরে সে ও-দেশেই থেকে গেছিল।

কলকাতা বিমানবন্দরের ইতিহাসে একমাত্র বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা, বিনা রক্তপাতে, বিনা ক্ষয়ক্ষতিতেই শেষ হল। এটিসির ক’জন অফিসারকে বিভাগীয় তদন্তের মুখে পড়তে হয়েছিল, ডাইভার্সন-এর কারণ ঠিকঠাক না বুঝে ওঁরা প্লেনটাকে নামতে দিয়েছিলেন বলে। পরে জেনেছি, ওই দুজন ছাত্রের বারাসত কোর্টে বিচার হয়, এ দেশের আইন অনুযায়ী দীর্ঘ কারাবাসের আদেশও হয়। এখন তারা কোথায় কে জানে! সম্প্রতি মায়ানমারে গণতন্ত্র এল, সুদীর্ঘ আন্দোলন, রক্তক্ষয় পেরিয়ে। কাগজে সে খবর পড়ে ওদের মুখগুলো মনে ভেসে উঠছিল।

মলয় দত্ত, ভিআইপি রোড, কলকাতা

malaydt@gmail.com

নইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rabibasariya Magazine Rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE