Advertisement
E-Paper

পাঠকও ধরতে পারেননি নকল কে

লেখক বিমল মিত্রের নামে গল্প-উপন্যাস লিখতেন প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন নকল বিমল মিত্র। আসল আর নকল লেখকের নামযুদ্ধ গড়িয়েছিল আদালতেও। লেখক বিমল মিত্রের নামে গল্প-উপন্যাস লিখতেন প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন নকল বিমল মিত্র। আসল আর নকল লেখকের নামযুদ্ধ গড়িয়েছিল আদালতেও।

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ০৭:৩০
আসল: বিমল মিত্র

আসল: বিমল মিত্র

মুর্শিদাবাদের লালগোলার মহারাজা ধীরেন্দ্রনারায়ণের ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছেন সাহিত্যিক বিমল মিত্র। বিয়ে বাড়ির হইচইয়ের মধ্যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল একটা চমক। খাবার টেবিলে ধীরেন্দ্রনারায়ণ পুত্রবধূর সঙ্গে বিমল মিত্রের আলাপ করাতে গিয়ে বললেন, ‘এই হলেন আসল বিমল মিত্র। আর এই হলেন নকল বিমল মিত্র!’ বলে পা‌শে বসা এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দিলেন। নকল বিমল লজ্জায় খাবারের প্লেট ফেলে ছুটে পালালেন।

হওয়ার কথা ছিল এমনটাই। কিন্তু হয়নি। বরং নকল বিমল মিত্রের অট্টহাস্য শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলেন আসল বিমল। ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর লেখক বিমল মিত্রের নামেই লিখতেন, বাজারে ছিলেন এমন ২০-২৫ জন। বেশ কিছু প্রকাশক সে সব লেখা প্রকাশও করতেন। রমরম করে বিক্রি হয়েছে সে সব বই। পাঠক ধরতেই পারেননি। কিন্তু আসল বিমল মিত্রের আর্থিক ক্ষতি তো হয়েইছিল, কপালে জুটেছিল সমালোচনাও। চেন্নাইয়ের ভেনাস পিকচার্স স্টুডিয়োর নানু ঘোষ বিমল মিত্রের মুখের উপর বলেছিলেন, তাঁর পাঠানো গল্পটি এক কথায় রাবিশ। শুনে আকাশ থেকে পড়েছিলেন বিমলবাবু। কারণ তিনি কোনও দিনই কোনও পরিচালককে তাঁর গল্প থেকে ছবি করার জন্য সুপারিশ করেননি। ঘোষবাবুর থেকে বিমলবাবু জানলেন, তাঁকে নকল বিমল মিত্র লিখেছিলেন, ‘‘আমি ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর লেখক, আমার নতুন বই ‘কড়ির চেয়ে দামী’ সিনেমা করার জন্য পাঠাচ্ছি।’’

নকল লেখকের উৎপাতে বিদেশ থেকেও নিন্দা শুনতে হয়েছে তাঁকে। ফিলাডেলফিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বিমল মিত্রের বই পড়ে তাঁর বন্ধু দিলীপ ঘোষ বিমলবাবুকে লিখে জানিয়েছিলেন, তাঁর ‘কড়ির চেয়ে দামী’, ‘বসন্ত মালতী’, ‘মানস সুন্দরী’ বইগুলো অপাঠ্য। ১৯৭১ সালে ‘ফুল ফুটুক’ উপন্যাসটির নিবেদন অংশে জাল বইয়ের জন্য তাঁর বিড়ম্বনার প্রসঙ্গে এই ঘটনার উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সে সব যে আমার নামে প্রকাশিত জাল বই, দুঃখের সঙ্গে তাঁকে সে কথা জানাতেও ঘৃণা হল।’’

১৯৭০ সালে এক দিন, স্টেট লটারি ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন। ও পারে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের লটারি ডিপার্টমেন্টের অফিসার, বিমল মিত্রকে অনুরোধ করছেন লটারি বিচারক হওয়ার জন্য। বিমলবাবু লটারির টিকিট বিক্রির বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বারংবার অনুরোধে রাজি হতে হল। নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠানে পৌঁছে জানতে পারলেন, তাঁকে নিয়ে প্রবল সমস্যায় পড়তে হয়েছিল অফিসারটিকে। অফিসার ফোন গাইড দেখে বিমল মিত্রকে ফোন করতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। বিমল মিত্রের মতো মানুষ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হচ্ছেন, সন্দেহ হয় তাঁর। তখন ফোন করেন আর এক বিমল মিত্রকে। বারংবার আপত্তিতেই বুঝে যান, আসল বিমল মিত্রকে পেয়েছেন।

সত্তরের দশকে কলেজ স্ট্রিটের কয়েকটি ছোট প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক গড়েপিঠে তৈরি করেছিলেন নকল বিমল মিত্রদের। নকলদের মধ্যেও আবার সবচেয়ে বেশি দর ছিল রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। বছর কয়েক আগে, সদ্য প্রয়াত সাহিত্য গবেষক অদ্রীশ বিশ্বাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথবাবু জানিয়েছিলেন, বিমল মিত্র ছিলেন তাঁর প্রিয় লেখক, সাহিত্যচর্চার গুরু। নিজের বই প্রকাশের ইচ্ছে নিয়ে এক প্রকাশকের কাছে গেলে সেই প্রকাশক তাঁকে একটা টোপ দেন। তিনি শ্রীচক্রবর্তীর বই ছাপবেন, যদি বিমল মিত্রের নামে তিনি একটা উপন্যাস তাঁকে লিখে দেন। ওই প্রকাশকের ক্ষমতা ছিল না বিমল মিত্রের মতো বড় লেখকের বই প্রকাশ করার। আর এ দিকে বিমল মিত্র মানেই আজকের ভাষায় বেস্টসেলার। টোপ গেলেননি রবীন্দ্রনাথবাবু, তবে মনে মনে চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। দেখি তো পারি কি না বিমল মিত্রের মতো লিখতে! লিখলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রক্ত পলাশ’। প্রকাশককে পড়ালেন। প্রকাশক বুঝলেন, তিনি লোক চিনতে ভুল করেননি। রবীন্দ্রনাথবাবু গোড়ায় পাণ্ডুলিপি দিতে অস্বীকার করলেও প্রকাশকের মগজধোলাইয়ের কাছে তাঁকে হার মানতে হয়। ‘রক্ত পলাশ’ খুব হিট করে বইবাজারে। ১৯৬৮-’৭৩-এর মধ্যে তিনি একাধিক বই লিখেছেন ‘বিমল মিত্র’ হয়ে। লিখতে-লিখতে ভুলেই গিয়েছিলেন, তিনি বিমল মিত্র নন। আজ অবধি তার নিজের নামে কোনও বই প্রকাশ পায়নি। বিমল মিত্রের নামে চিঠি এলে তিনিই উত্তর দিতেন। সর্তক থাকতেন যাতে তাঁর লেখা বইয়ের রিভিউ ছাপা না হয়, তা হলেই আসল বিমলের নজরে এসে যাবে। ১৯৭৩-এ ‘চতুরঙ্গ’ প্রকাশের পর ধরা পড়েছিলেন নকল বিমল। নকল বিমলকে বাঁচাতে প্রকাশক রাতারাতি জাল রেশন কার্ড, কর্পোরেশনের সার্টিফিকেট বের করে ফেলেছিল। একই নামে দু’জন লেখক থাকতেই পারেন। আইনত কিছু করা যায় না। মামলাটি হেরে যান আসল বিমল মিত্র!

১৯৭৮ সালে ‘যা ইতিহাসে নেই’ উপন্যাসে এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বিমল মিত্র জানিয়েছিলেন, ‘আমার পাঠক-পাঠিকাবর্গের সতর্কতার জন্য জানাচ্ছি যে, সম্প্রতি দুই শতাধিক উপন্যাস ‘বিমল মিত্র’ নামযুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক মহলে আমার লোকপ্রিয়তার ফলেই এই দুর্ঘটনা ঘটা সম্ভব হয়ছে। .... একমাত্র কড়ি দিয়ে কিনলাম ছাড়া আমার লেখা প্রত্যেকটি গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠায় আমার স্বাক্ষর মুদ্রিত আছে।’ একেই কি বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা?

Bimal Mitra Writer Duplicate বিমল মিত্র
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy