Advertisement
E-Paper

তিতলির দায় দায়িত্ব

তিতলির আজ বড়ই মনখারাপ। এমনিতেই আজ সারাটা দুপুর জুড়ে ছেয়েছিল রিমঝিম বৃষ্টির উঁকিঝুঁকি, তার ওপর সেই ঘন মেঘের আড়ালে লুকনো এক কালো তুলির পোঁচ হঠাৎই এসে ধেবড়ে দিয়ে গিয়েছে ওর সমস্ত উৎসাহের উৎসটুকুকে!

রাখী নাথ কর্মকার

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ২৩:৫৩
ছবি: মণীশ মৈত্র

ছবি: মণীশ মৈত্র

তিতলির আজ বড়ই মনখারাপ। এমনিতেই আজ সারাটা দুপুর জুড়ে ছেয়েছিল রিমঝিম বৃষ্টির উঁকিঝুঁকি, তার ওপর সেই ঘন মেঘের আড়ালে লুকনো এক কালো তুলির পোঁচ হঠাৎই এসে ধেবড়ে দিয়ে গিয়েছে ওর সমস্ত উৎসাহের উৎসটুকুকে!

আজ অপ্রত্যাশিত ভাবেই স্কুল লাইব্রেরির একটা বই হারিয়ে ফেলেছে ও!

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে আজ ব্যাগের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে বইটা। নাহ, বইটা যেন কোন জাদুবলে এক্কেবারে ভ্যানিশ হয়ে গেছে! অথচ ওর স্পষ্ট মনে আছে, লাইব্রেরি থেকে বইটা ব্যাগের পিছনের চেনে ভরে নিয়ে ও সোজা ছুটেছিল স্কুল পার্কে, আর তার পরে পরেই ছুটির ঘণ্টা পড়েছিল। তবে কি ও যখন দোলনায় দুলছিল তখন কেউ চেন খুলে ওর বইটা নিয়ে নিয়েছে? নাকি অসাবধানে বইটা কোথাও পড়ে গেছে? নাকি...? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর মেলেনি। বইটা তিতলির ভীষণ প্রিয়, ও যখন ওর ভাইয়ের মতোই ছোট্ট ছিল, একলা দুপুরে, মা ওকে ওই ছবির বইয়ের মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে আনত চিড়িয়াখানার আনাচেকানাচে। অজানা অচেনা সবুজ জঙ্গুলে জগৎটা কেমন যেন ঝুপ করে এসে হাজির হত পুঁচকে তিতলির সামনে। বইটার পাতায় পাতায় কত শত জীবজন্তুর ছবি, ছবিগুলোর মধ্যে দিয়েই ওর আলাপ হয়েছিল হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভালুক, গন্ডার, কুমির... এদের সব্বার সঙ্গে! তার পর ওর বড় হয়ে ওঠার ধাপগুলোতে কোথায় কখন জানি বইটা হারিয়ে গিয়েছে, বুঝতেও পারেনি ও।

সেই বইটি আজ লাইব্রেরিতে দেখতে পেয়েই লাইব্রেরিয়ান মিস গাঙ্গুলিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মিস, বইটা আজ আমি বাড়ি নিয়ে যেতে পারি?’ মিস জবাব দিয়েছিলেন, ‘নিতে পারো, তবে আগামীকালের মধ্যেই দায়িত্ব নিয়ে বইটা ফেরত দিতে হবে!’

সেই দায়িত্বটাই তো ঠিকঠাক পালন করে উঠতে পারল না তিতলি। আর হয়তো কোনও দিনই মিস গাঙ্গুলি ওকে বই বাড়ি নিয়ে আসতে দেবেন না। আজ সারাটা বিকেল ধরে পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি করার পরেও বইটির দেখা মিলল না। ছোট্ট ভাইটা পর্যন্ত দিদির মেজাজ দেখে বিকেল থেকে ওর ধারকাছ মাড়ায়নি! এ দিকে বৃষ্টির বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে দেখে কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে থাকা মেয়ের কাছে এসে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘জানো তিতলি, দায়িত্বশীল হওয়া মানে কিন্তু শুধু তোমার নিয়ন্ত্রণে যা আছে তার ঠিক দেখভাল করাই নয়, নিজের ভুলগুলোকে শুধরে নেওয়াটাও কিন্তু দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।’

মায়ের কথাগুলো প্রথমে তিতলি ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু তার পরই হঠাৎ তিতলির মনে পড়ে যায় মিট্টুদিভাইয়ের কথা! আরে তাই তো! গত বার ক্লাসে অঙ্কে কম নম্বর পাওয়ায় বড়মাসির মেয়ে মিট্টুদিভাই এ বছর পরীক্ষার আগে রাতের পর রাত জেগে অঙ্ক কষে গেছে, কোনও গল্পের বইয়ের বায়না করেনি, কোনও জামাকাপড়ের আবদার করেনি, এমনকী পাড়ার পিকনিকেও যায়নি।

বেশ, তা হলে আজ সারা রাত তিতলি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে। দায়িত্বশীল হওয়ার!

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢোকে তিতলি। রং-পেনসিলের বাক্স আর নতুন ড্রয়িং খাতাটা বগলদাবা করে সে একমনে ছবি আঁকতে বসে যায়। ড্রয়িং স্কুলের তনিমাদিদি মাঝে মাঝেই ক্লাসে হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক আঁকা প্র্যাক্টিস করান বটে, তবে তিতলির সেটা ভয়ানক বোরিং লাগে! এই মুহূর্তে কিন্তু হারানো বইয়ের প্রতিটি পাতাই যেন ঝলমলিয়ে উঠেছে ওর চোখের সামনে! কুড়ি পাতার ছবির বইয়ে কুড়িটি জন্তুর ছবি, প্রথমেই বাঘের ছবি, তিতলি জানে, বাঘ হল একমাত্র বিগ ক্যাট, যাদের গায়ে ডোরাকাটা দাগ আছে। তার পর পশুরাজ সিংহের ছবি, তার পর হাতি, ঘোড়া, কুমির— কে নেই? আজ সারাটা রাত তিতলির রং-পেনসিল তার দায়িত্বপালন করে যাবে। আগামীকাল মিস গাঙ্গুলির হাতে এই বই, থুড়ি খাতাটা ফেরত না দেওয়া অবধি কিছুতেই রাতে ঘুম আসবে না।

গভীর রাতে ছবি আঁকতে আঁকতে তন্ময় তিতলি হঠাৎই একটা গম্ভীর হুঙ্কারে চমকে উঠে দেখল, ড্রয়িং খাতার সাদা পাতায় লেজ আছড়াতে আছড়াতে গর্জন করতে শুরু করেছে বাঘমামা। ‘এ কী তিতলি! তুমি আমার সামনের দুটো পা আর পিছনের দুটো পা যে একই মাপের এঁকে ফেলেছ। আরে বাবা, পিছনের পা দুটো অনেক বেশি লম্বা বলেই না আমরা এক লাফে দশ ফুটের মতো দূরত্ব অতিক্রম করতে পারি! এক্ষুনি সব ঠিকঠাক করে দাও, নয়তো আমি আর শিকার করতেই পারব না!’ লম্বা শুঁড় দুলিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে হাতিও এসে অভিযোগ জানাল, ‘আর আমার যে দাঁত দুটো সরু করে দিয়েছ, দাঁতাল হিসেবে দলের মধ্যে আমার তো সম্মানটাই আর থাকবে না! এই ‘টাস্ক’-এর এক প্রধান টাস্কই হল অন্য জন্তুদের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের এগিয়ে রাখা, সেখানেই যদি পিছিয়ে পড়ি!’ এদের দেখাদেখি কুমিরও দেখে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে, ‘আরে বাবা, আমাদের দেহে লেজটাই শরীরের অর্ধেক ভাগ দখল করে নেয়, সেখানে এত ছোট লেজ নিয়ে আমি কী করব? দেখ বাপু, তোমায় একটা কথা বলি, কখনও কোনও বিষয় নিয়ে বড়াই করতে নেই, বুঝলে? তুমি এত দিন খালি ভাবতে, তুমি একাই ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে দায়িত্বশীল ছাত্রী, তুমি একাই সবচেয়ে ভাল আঁকতে পারো! আসলে ওই বড়াই এর বেলুনটা একটু কম ফোলাতে হবে। আফ্রিকায় একটা গল্প প্রচলিত আছে জানো তো! এক সময় কুমিরের চামড়া ছিল মসৃণ, সে রাতে বাইরে বের হত। সব জন্তুরাই কুমিরের মসৃণ ত্বকের প্রশংসা করত। দাম্ভিক কুমির এক দিন দিনের বেলা বের হল, কিন্তু রাতের আঁধারে নিরাপদ ত্বক দিনের সূর্যের প্রখর তাপে খসখসে আর ফোলা-ফোলা হয়ে গেল। সেই থেকেই আমাদের চামড়া এ রকম হয়ে গেছে, বুঝলে?’

‘বুঝেছি, বুঝেছি!’ তড়িঘড়ি আবার পেনসিল ইরেজার নিয়ে বসে গেল তিতলি। যত রাতই হোক না কেন, এদের সক্কলকে খুশি করে তবেই আজ ও ঘুমোতে যেতে পারবে। তবে এটা ঠিক, প্রত্যেকেই তিতলির একঘেয়েমি কাটানোর জন্য তাদের রংবাহারি অরিজিন-স্টোরি বলতে শুরু করল, বাঘের গায়ে ডোরাকাটা দাগ কী করে এল, হাতি কী ভাবে শুঁড় পেল? সেই সব গল্প শুনতে শুনতে কখন যে তিতলির চোখ জড়িয়ে এসেছিল, কে জানে! রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘জাস্ট সো স্টোরিজ’ থেকে এমন কত শত জীবজন্তুর ‘অরিজিন-স্টোরি’ কত শত বার মা পড়ে শুনিয়েছেন তিতলিকে।

আজ লাইব্রেরি ক্লাসে সবার সামনেই ভুলটা স্বীকার করল তিতলি। ‘আমি দুঃখিত মিস গাঙ্গুলি, কী ভাবে যেন আমি ছবির বইটা হারিয়ে ফেলেছি গত কাল। তবে ক্ষতিপূরণের জন্য কাল সারা রাত জেগে একটি ছবির বই তৈরি করেছি, আপনি দেখবেন সেই বইটা?’

মিস গাঙ্গুলি বিস্ময়বিহ্বল চোখে তিতলির আঁকা ছবির বই হাতে নিলেন, প্রথম পাতায় বড় করে লেখা, ‘নো দি অ্যানিম্যালস’। তার পর আসল বইটির মতোই পাতায় পাতায় হলুদ-কালোয় বাঘের হম্বিতম্বি, কেশরওলা সিংহের আস্ফালন, দাঁতাল হাতির দামাল দুষ্টুমি!

এই প্রথম বরাবরের গোমড়ামুখো মিস গাঙ্গুলির মুখে মেঘের ফাঁক দিয়ে চিলতে রোদ্দুরের মতো এক ফালি মিষ্টি হাসি উঁকি মারল, ‘তুমি কাল বইটা ব্যাগে ভরেই ছুটেছিলে পার্কের দিকে। কিন্তু খেয়াল করোনি, ব্যাগের চেনটাই আটকানো হয়নি, ফলে, ব্যাগটা কাঁধে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই বইটা পড়ে গিয়েছিল। তবে সেটা পড়েছিল লাইব্রেরির দরজার কাছেই। যখন আমার চোখে পড়ে, তত ক্ষণে তুমি স্কুলবাসে। দায়িত্ব নিয়েও তুমি তা পালন করতে পারোনি ঠিকই, কিন্তু এটা ঠিক—ভুলটাকে শোধরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছ, তাই এ বারের মতো তোমাকে মাফ করে দেওয়া যেতেই পারে, কী বলো?’ মিস গাঙ্গুলির প্রশ্নের উত্তরে ওর সমস্ত বন্ধু-সহপাঠীর দল সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘ইয়েস মিস’!

‘তিতলি, আজ কোন বইটা বাড়ি নিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছ?’ তিতলি অবাক হয়ে দেখল, মিস গাঙ্গুলির ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি, আর লাইব্রেরির বাইরে কারা যেন সবার অগোচরে গলা ফাটিয়ে চলেছে ‘হিপ হিপ হুররে!’

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy