Advertisement
E-Paper

বেওয়ারিশ নোটের বান্ডিল

তা র পুরনো রাশিয়ান হাতঘ়়ড়ির কেসটায় গোটা গোটা অক্ষরে কী সুন্দর খোদাই করা ছিল— ‘আমার ছেলে জাঙ্কো পেত্রভ-কে’। ওই ‘গ্লোরি’ ঘড়িটা দেখেই সে রোজ সকালে ঠিক সময়ে বিছানা ছাড়ে। পোষা খরগোশগুলোর খাঁচা পরিষ্কার করে, তাদের জলটল দিয়ে, তার পর কাজে বেরোয়।

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০

তা র পুরনো রাশিয়ান হাতঘ়়ড়ির কেসটায় গোটা গোটা অক্ষরে কী সুন্দর খোদাই করা ছিল— ‘আমার ছেলে জাঙ্কো পেত্রভ-কে’। ওই ‘গ্লোরি’ ঘড়িটা দেখেই সে রোজ সকালে ঠিক সময়ে বিছানা ছাড়ে। পোষা খরগোশগুলোর খাঁচা পরিষ্কার করে, তাদের জলটল দিয়ে, তার পর কাজে বেরোয়। সে হল গিয়ে রেল দফতরের লাইনম্যান। মস্ত রেঞ্জটা বাগিয়ে সে রেল লাইনের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো টহল দেয়। কোথাও ফিশপ্লেটের স্ক্রু-টা একটু ঢিলে মনে হলে সেটাকে কষে টাইট করে দেয়। সে দিনও পেত্রভ রোজকার মতো কাজেই বেরিয়েছিল। কারশেডের বাইরে দাঁড়ানো ইঞ্জিন থেকে রোজকার মতো সে দিনও ডিজেল চুরি হচ্ছিল। যারা করছিল, তারা সবাই পেত্রভের চেনা মুখই। সে-ও রোজের মতোই তাদের পাত্তা না দিয়ে লাইন ধরে এগিয়ে যায়। আর তখনই ঘটনাটা ঘটল। রেল লাইনের ওপর ইতিউতি ছ়়ড়ানো একটা-দুটো করে কারেন্সি নোট কুড়িয়ে পেতে পেতেই পেত্রভ দেখল, লাইনের এক ধারে তাড়া তাড়া নোট পড়ে আছে। বেমালুম বেওয়ারিশ। নোটের সেই গাদা থেকেই দু-চারটে এ দিক-ও দিক উড়ে উড়ে যাচ্ছিল! যাচ্ছে!

জাঙ্কো পেত্রভ, যার কয়েক পুরুষের সারা জীবনের রোজগারও ওই টাকাটার ধারেকাছে পৌঁছবে না, সে ফোন করে পুলিশে খবর দেয়। নোট-কাণ্ডের বলটা ওখান থেকেই গড়িয়ে যায় পরিবহণ মন্ত্রকের জন-সংযোগ দফতরের দাপুটে কর্ত্রী জুলিয়া স্তেইকোভার কোর্টে। জুলিয়ার কাছে প্রথম ফোনটা যখন আসছে, ও তখন বর ভ্যালেরির সঙ্গে ডাক্তারের চেম্বারে। চল্লিশ-ছুঁইছুঁই বয়সে মা হওয়ার জন্য ওর বিশেষ চিকিৎসা চলছে তো! পরিচালক-জুটি ছবির মূল ন্যারেটিভের পাশাপাশিই জুলিয়ার বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার ব্যাপারটাকে ছুঁইয়েই রেখে গেছেন। জুলিয়া যে ভাবে তার অফিস সামলায়, এই ‘মিশন মাতৃত্ব’ও তার কাছে ও রকমই স্রেফ একটা যান্ত্রিক-কেজো-রুটিন-আমলাতান্ত্রিক ‘দায়িত্ব’।

জাঙ্কো পেত্রভও ছিল তার কাছে ও রকমই একটা ‘অ্যাসাইনমেন্ট’। রেল লাইনের ধারে বেমক্কা অতগুলো নোটের বান্ডিল যাতে দুর্নীতির কোনও বিষয় না হয়ে ওঠে, জুলিয়া-রা তাই রাতারাতি জাঙ্কো পেত্রভকে ‘শ্রমিক শ্রেণির জাতীয় নায়ক’ বানাতে লেগে পড়ে। মফস‌্সলি রেল-শহর থেকে তাকে রাজধানীতে ডেকে পাঠানো হয়। পরিবহণমন্ত্রী স্বয়ং সদর দফতরে তাকে সংবর্ধনা দেবেন। পেত্রভ মানুষটা এমনিতেই একটু অদ্ভুত গোছের। কথায় একটু জড়তা আছে বলে লোকজনের সঙ্গে তেমন মেলামেশাও নেই। এ হেন পেত্রভ তার যাবতীয় অদ্ভুতপনা, বিদঘুটে চুল-দাড়ি, মান্ধাতা আমলের কোট-ট্রাউজার্স আর গুচ্ছের বেসামাল অগোছালো গেঁয়োপনা-সুদ্ধ, জুলিয়া আর তার জনসংযোগ টিমের ঝকঝকে-তকতকে শহুরে সপ্রতিভতার মুখোমুখি হয়। তার ময়লা লেগে যাওয়া ট্রাউজার্সটা বদলাতে গিয়ে পেত্রভের পকেট থেকে ঝনঝন করে খুচরো পয়সাগুলো এ দিক-ও দিক গড়িয়ে যায়। পেত্রভ সেগুলো কুড়োতে গিয়ে জুলিয়ার ধমক খায়। মন্ত্রীমশাই তাকে নতুন ডিজিটাল ঘড়ি উপহার দেবেন বলে জুলিয়া তার পুরনো সাধের গ্লোরি ঘড়িটা হাত থেকে খুলে নেয়। পরিবহণমন্ত্রী নিজে রেলশ্রমিকের হাতে ঘড়ি বেঁধে দিচ্ছেন। এতে মন্ত্রকের ইমেজ আরও চকচকে হবে।

পরিচালক-জুড়ি তাঁদের ট্রিলজির এই দু’নম্বর ছবিটায় তেরচা, উদাসীন কিন্তু চোখা কৌতুকের ছুরিতে সরকারি সংবর্ধনার সাজানো-ন্যাকা-নাকউঁচু দেখানেপনার রাংতা-পুলটিস চেঁছে তুলে দিয়েছেন। মন্ত্রী ক্যামেরার সামনে পেত্রভের সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথা বলার ভান করলেও পেত্রভ যখন তার চোখের ওপর ঘটে-যাওয়া নানা দুর্নীতির কথা জানাতে চায়, তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান! সংবর্ধনা পর্ব মিটে যেতেই এত ক্ষণের ‘শ্রমিক বীর’ পেত্রভকে আর কেউ পাত্তা দেয় না। জুলিয়াও তার পুরনো ঘড়িটা ফেরত দিতে ভুলে যায়। মন্ত্রীর উপহার দেওয়া নতুন ঘড়িটা ভুলভাল সময় দিচ্ছে। ও দিকে বাবার দেওয়া পুরনো ঘড়িটাও সে ফেরত পাচ্ছে না। আসলে, জুলিয়া-রা পেত্রভদের শুধু ব্যবহারই করে, বুঝতে চায় না! একটা বেসরকারি চ্যানেলের চালাকচতুর সঞ্চালক পেত্রভের ক্ষোভটাকে রাজনৈতিক বিষয় বানিয়ে দেয়। জুলিয়া পালটা তার জনসংযোগ ব্যবহার করে পেত্রভকে ফাঁসিয়ে, তার মুখ থেকে মন্ত্রীর পক্ষে ক্লিনচিট আদায় করে নেয়। আর সে চ্যানেলে বসে যে-সব নাম বলে দিয়েছিল, রেলের ডিজেল পাচারচক্রের সেই মাফিয়ারা মাঝরাস্তা থেকেই পেত্রভকে তুলে নিয়ে যায়।

ছবিটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তার পরেও কাগজে এক লাইনম্যানের আত্মহত্যার খবর পড়ে জুলিয়ার বিবেকে আচমকা নাড়াচাড়া পড়ে। সে অফিসের ড্রয়ার-আলমারি হাঁটকে, পুরনো গ্লোরি ঘড়িটা খুঁজেপেতে, শেষ অবধি পেত্রভের দরজায় গিয়ে ঘণ্টা বাজায়। আগাগোড়া কালো-কষটা নির্লিপ্ত কৌতুকে-মোড়া ছবিটায় বাড়তি দৃশ্য, বাড়তি কোনও সংলাপ প্রায় নেই। পোয়েটিক জাস্টিস-এর এই বাড়তি মোহটুকুও এড়াতে পারলে বোধহয় সবচেয়ে সুবিচার হত!

sanajkol@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy