Advertisement
০২ মে ২০২৪

একটা [ভয়] কষ্ট লজ্জা

রাতের ফোন, ভোরবেলায় দরজায় চেনা লোক, আর ফোনে ‘শোন, একটু কথা ছিল’— এগুলো হলেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামতে থাকে। কিছুই যেন শুনতে পাই না। হার্টবিট দামামার মতো বাজতে থাকে। সব ব্লক হয়ে যায়, সব অনুভূতি। আগে কারও কোনও বিপদ হলে সবাই আমার নম্বর ডায়াল করত, হাসপাতাল, রাত-জাগা, রক্ত জোগাড়, ডাক্তারের সঙ্গে ঝগড়া, নার্সের সঙ্গে স্যালাইনের বোতল ধরা— সব করেছি এক-কলজে জোর নিয়ে।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রাতের ফোন, ভোরবেলায় দরজায় চেনা লোক, আর ফোনে ‘শোন, একটু কথা ছিল’— এগুলো হলেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামতে থাকে। কিছুই যেন শুনতে পাই না। হার্টবিট দামামার মতো বাজতে থাকে। সব ব্লক হয়ে যায়, সব অনুভূতি।

আগে কারও কোনও বিপদ হলে সবাই আমার নম্বর ডায়াল করত, হাসপাতাল, রাত-জাগা, রক্ত জোগাড়, ডাক্তারের সঙ্গে ঝগড়া, নার্সের সঙ্গে স্যালাইনের বোতল ধরা— সব করেছি এক-কলজে জোর নিয়ে। আর সেই ভয়ানক ডাকাবুকো মেয়ে এখন প্রচণ্ড অ্যাংজাইটি-প্রবণ। কাছের মানুষদের কী সাংঘাতিক কিছু হতে পারে, এই ভেবেই সে সারা দিন কাটিয়ে দেয়। আচ্ছা, মা সারা দিন ফোন করেনি, সব ঠিক আছে তো? দিদির ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, দেখানো হল কি না আমায় জানাল না তো! তার মানে সিরিয়াস কিছু? বাবাকে হঠাৎ কেন ব্লাড টেস্ট করতে বলল?

সব সময়ই মনে হয়, এই বাজে কিছু ঘটবে। এ আমার মনের ব্যারাম, জানি। নিজেকে অনেক বোঝাই— ওরে তোর এত বয়স হয়ে যায়নি যে তুই জীবনকে চিরতার সঙ্গে বেটে বড়ি বানিয়ে খাচ্ছিস। আর, এ সব তো চলতেই থাকবে। আগে কিছু সিরিয়াস হোক, তবে তো তুই ভয় পাবি।

ডিপ ব্রিদিং, ডিপ ব্রিদিং, জোরে জোরে শ্বাস, জোরে জোরে শ্বাস। ধুস্স্স্স্, এ সব করে কিছু হয় না। নেগেটিভ পাওয়ার খুবই পাওয়ারফুল, শ্বাসপ্রশ্বাসের তোয়াক্কা করে না। খুব উচ্চ মানের বিদেশি হরর ফিল্মে, লাস্ট সিনে ক্লু থাকে: ভূত নিকেশ হয়নি। কোনও না কোনও ফর্মে ঠিক থেকে গেছে। নেগেটিভ থিংকিং ঠিক ও-রকম। মা এক দিন খুব বকুনি দিয়ে বলেছিল, ‘ন্যাকামি কোরো না। তোমার আসলে উদ্বেগ-বিলাস হয়েছে।’

কিন্তু আসল ক্যাচ বা প্যাঁচ অন্য জায়গায়। আমার কাছের লোকজন আমার এই অতি-উদ্বেগ ব্যাপারটাকে প্রথমে পাত্তা না দিলেও, এখন ওয়াকিবহাল। ফলে অর্ধেক জিনিস চেপে যায়। ‘আহা থাক, ও আবার টেনশন করবে।’ আমার ভয়টা ওখানেই। সব কথা, সব আলোচনা, সব ফোনের পর মনে হয়, মা আমায় নিশ্চয়ই পুরো সত্যিটা বলল না, দাদা কাল আমার সঙ্গে তড়িঘড়ি কথা বলে নামিয়ে দিল, আমি রিপোর্ট দেখতে চাইলে দেখাতে চায় না। বাবা-মা ডাক্তার দেখানোর পর আমায় বলে, দেখিয়ে এলাম, বলেছে সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারি না। অনেক বার ওদের বোঝাই, ‘শোনো, আমি টেনশন করি ঠিকই, কিন্তু এখনও আমার ব্রেন সচল। কোন সময় কী করতে হবে আমি ঠিক বুঝতে পারব। তোমরা না জেনে আমার ক্ষতি করছ। আমি সব সময় আরও ভয়ে থাকছি এই ভেবে যে কারও কিছু হচ্ছে, অথচ আমায় বলছে না। তার চেয়ে ঢের ভাল, আমায় বলে দেওয়া আর ওই সময়টুকুর জন্য আমার টেনশনটা অ্যালাও করা।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে। এর সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটি কিংবা আত্মীয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও বলে না। ফলে আমি দোফাঁদে পড়ে গিয়েছি।

আগে আমি কেবল উদ্বেগ নিয়ে থাকতাম, এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অবিশ্বাস। সর্ব ক্ষণ ভয় করে, হয়তো ক্রাইসিসে আমার কিছু করার থাকত, কিন্তু স্রেফ জানতে পারব না বলে কিচ্ছু করতে পারব না। ফোন ধরার আগে একটা ভয়, রেখে দেওয়ার পর আর একটা। আমার হিতৈষীদের এ কথা কে বোঝাবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sanchari Mukhopadhyay anxiety doctor hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE