E-Paper

হাঁসুলীবাঁকের সন্ধানে

বীরভূমের কোপাই নদী যে হংসীগ্রীবা বানিয়ে তুলেছে, তাকে কেন্দ্র করেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপকথা। যে আখ্যান লাভপুর, বোলপুর, সিউড়ির গায়ে লেগে থাকে আলিম্পনের মতো। হাঁসুলীবাঁক আসলে কোথায়? আজও কি সেখানে থাকেন কাহার-সমাজের উত্তরসূরিরা?

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫৫
ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। ১৯৪৬ সাল। শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’। সেই হিসেবে এ বছর আশিতে পা দিল এই উপন্যাস। উপন্যাসটির সম্পূর্ণ সম্প্রসারিত সংস্করণটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে, সেই হিসেবে পঁচাত্তর স্পর্শ করল ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’। এবং শুধু মেহগিনির মঞ্চসজ্জায় আপনার অস্তিত্ব ধরে রাখা নয়। এই উপন্যাস স্বগুণে আজও পাঠকের মনোহরণ করে।

বহু উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখেছেন তারাশঙ্কর। প্রায় সব লেখাই পাঠকপ্রিয়। তাঁর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রও অনেক। জীবদ্দশায় তিনি তাঁর রচনার বাণিজ্যিক সাফল্য ও সাহিত্য-সার্থকতা অনেকটাই দেখে যেতে পেরেছেন। তাঁর প্রথম ও ভাস্বর স্বাক্ষর তাঁর প্রদত্ত নামগুলিতে। পাঠকের আগ্রহ প্রবলতর করে তুলতে পারে নামগুলি। যেমন ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’।

সেই কবে, কত বছর আগে, প্রথম বার এই উপন্যাসের পাঠ, হাঁসুলীবাঁক সম্বন্ধে এক স্বপ্নিল অস্তিত্ব মনের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিল। যেখানে যত নদীর বক্রতা, সব এক-একটি হাঁসুলীবাঁক। বীরভূমের কোপাই নদী যে হংসীগ্রীবা বানিয়ে তুলেছে, যাকে কেন্দ্র করে তারাশঙ্করের উপকথা, সে যেন স্বয়ং এক প্রবহমানতার ধ্রুব ব্যঞ্জনা। সে যেন স্বয়ং বীরভূম। লাভপুর, বোলপুর, কীর্ণাহার, সিউড়ির গায়ে লেগে থাকা, মেটেঘরের গায়ে আলিম্পনের মতো। অথচ, বীরভূমের যতেক বন্ধুদের কাছে হাঁসুলীবাঁক দর্শনের প্রসঙ্গ তুললে উত্তর এসেছে একটিই— “হ্যাঁ, হাঁসুলীবাঁক বলে একটা জায়গা আছে, তবে দেখিনি।”

যার সম্বন্ধে পড়া হয়েছে, যে আছে, অথচ এমন কাউকে পাওয়া যায়নি, যে ওই রূপকথার মতো নদীর বাঁক দেখে এসেছে, সে যেন প্রায় অলীক। বহু বার বোলপুর যাত্রা ও কোপাই, অজয় দর্শন হয়ে থাকে। কিন্তু ওই হাঁসুলীবাঁক? সে কোথায়? সে কত দূর? এত বছর পেরিয়ে, আজও কি কাহার-সমাজের উত্তরসূরিরা সেখানে বাস করেন? সেই তখনকার মতো, আজকের কাহার মেয়েরাও কি রুপোর হাঁসুলী পরেন গলায়?

এখন মেয়েদের সাজের উপকরণ অগণিত। অলঙ্কারের ভান্ডারে বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। যদি এ কালের কোনও প্রসাধনপ্রীতা, যিনি বুঝি জানেনই না হাঁসুলী নামের গহনাটির কথা, তাঁকে অজ্ঞতার দোষে দোষী বলা চলে না। কিন্তু তিনি যদি ‘হাসুলীবাঁকের উপকথা’ পড়েন, গোড়াতেই জেনে যাবেন, হাঁসুলী এক অলঙ্কার, হাঁসের সরু বাঁকানো গলার মতো দেখতে, রমণীয় কণ্ঠ জড়িয়ে দ্যুতি ছড়ায়। সাঁওতাল রমণীদের ভারী পছন্দের গহনা এটি।

তারাশঙ্কর এই উপন্যাসের প্রথম পাতায়, বাঁশবাঁদি মৌজার লাট্‌ জাঙলে, অত্যন্ত অল্প পরিসরে, কোপাই নদীর বাঁক নেওয়ার বিভঙ্গ তুলনা করেছেন ‘শ্যামলা মেয়ের গলায় সোনার হাঁসুলী’র সঙ্গে। এই বঙ্কিম পাড়ে কয়েক ঘর কাহারের বাস। ছোট একটি কাহার গ্রাম। সে গাঁয়ের মানুষের ভয়-ভীতি, সংস্কার, দারিদ্র; রুষ্ট প্রকৃতির সঙ্গে অসম যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার প্রয়াস, নরনারীর প্রেম ও গোষ্ঠীর মাতব্বর হয়ে ওঠার নিরুচ্চার প্রতিযোগ এই উপন্যাসের বিষয়। কিন্তু এর চলনের মধ্যে আছে যুগ ও সমাজমানসের রূপান্তর, আছে অল্পে তুষ্ট মানুষের ক্রমাগত ভোগবিলাসের প্রতি আকর্ষণ ও তার ফলে ব্যক্তিত্বের বদল, আছে কৃষিভিত্তিক জীবনযাপন থেকে কলকারখানার শ্রমিক হয়ে যাওয়ার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ।

এই সময়, যখন শহর আর গ্রাম পরস্পর সংজ্ঞা মিলিয়ে ফেলছে, আজকের সবুজ কৃষিক্ষেত্রে কালকেই গজিয়ে উঠছে উদ্ধত উপনগরী, যখন গ্রাম থেকে শত-সহস্র মানুষ জীবিকার সন্ধানে প্রতি দিন ভিড় করছে বড় শহরে, এমনকি, গ্রাম ছেড়ে, ঘর-পরিবার ছেড়ে, কত লোক চলে যাচ্ছে ভিনরাজ্যে কাজের আশায় আর সমাজে তৈরি হচ্ছে ভাষা-সন্ত্রাস, তৈরি হচ্ছে শ্রমজীবীদের নব্য শ্রেণি ও ব্যাখ্যা, যা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ শব্দদ্বয়ে বর্ণিত, যখন মেধাবী তারুণ্য সুখ ও সাফল্যের স্বপ্ন নিয়ে আকাশবিহার করে চলে যাচ্ছে বিদেশে, তখন, কৃষি ও কারখানার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নতুন উপস্থাপনায় ভাবিয়ে তোলে। ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’য় নদীপাড়ের জীবন ছেড়ে কাহার মেয়ে-মদ্দ চলে গিয়েছিল চন্ননপুর। সেখানে ‘পানার বউ’ আঙামুখো উড়োজাহাজের আস্তানায় খাটে। খাটুনি, না মাথা। ‘ওজকার খুব; ফেশান কি!’ আর, গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার বিরোধী ছিল যে বনওয়ারী, সে উদাস চোখে দেখে চন্ননপুরের ঝকঝকে পাকা রাস্তা। ওই রাস্তা দিয়েই কাহাররা পাঁচ সিকে দেড় টাকা মজুরিতে জন খাটতে যায়।

এখানেই উপন্যাসটি চিরকালীন হয়ে ওঠে। নতুন করে বুঝতে ইচ্ছে করে হাঁসুলীবাঁকের লাল কাদামাটি-মাখা জীবনের শিকড়টিকে। যা ফিরে পাওয়ার জন্য, উপন্যাসের করালী, বানে ভেসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, পরিত্যক্ত গ্রামটিকে, হাঁসুলীবাঁকটিকে মাটি খুঁড়ে বার করতে চেয়েছিল।

আরও সুখ, আরও সুবিধা, আরও বৈভব, আরও নিরাপত্তার জন্য স্থানান্তরণ মানুষের অন্তর্গত স্বভাব। আদিকাল থেকেই তা হয়ে আসছে। কিন্তু সুন্দরতর জীবনের সন্ধানে যত অভিযাত্রা, তার সবটুকুই তো সফল নয়। আরও অনেক কর্ম ও প্রয়াসের মতোই, সেই সাফল্য কিছু চিহ্ন রেখে গিয়েছে, ব্যর্থতা মিশে গিয়েছে ধূলিতে। কেউ যদি বা কোনও ভূখণ্ড নিজের দেশ বলে গড়ে নিতে পেরেছে, কারও মরণপণ লড়াই চলছে যুগ যুগ ধরে। কবে এই লড়াই থামবে, কী হবে এর পরিণতি, কেউ জানে না। যেমন, কেউ জানে না, প্রতি দিন জীবনযাপনের ধরন বদলে দেওয়া গতিশীল আগ্রাসী প্রযুক্তি শেষ পর্যন্ত মানবজাতির কোন পরিণতি ঘটাতে চলেছে।

শিল্প বিপ্লবের পর কৃষি বনাম প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমজীবিকা সুবিধা এনে দিয়েছে, কিন্তু দারিদ্র দূর করতে পারেনি। শান্তি ও নিরাপত্তাও তৈরি করা যায়নি যথেষ্ট মাত্রায়, যাতে রাতে নির্ভয়ে ঘুমোতে পারে মানুষ। জীবনের অনিবার্য সত্যই এই যে, সুখ-সুবিধা ও নিশ্চিন্তির সন্ধান মানবসমাজের পক্ষে অনিরুদ্ধ অথচ চিরকালীন বিফলতা। হয় মানুষ নিজেই নিজের আবিষ্কারের দ্বারা বিধ্বস্ত, অথবা, অপরাজেয় প্রকৃতির দুর্দমনীয় সংঘটন নিশ্চিহ্ন করে দেয় সকল প্রয়াস, সমস্ত গৌরব। তাই, আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগেও কারখানা বা শিল্প নিয়ে দারুণ আশাবাদী হতে পারেননি সমাজসচেতন, কুসংস্কারবিরোধী, চিন্তক তারাশঙ্কর। এই উপন্যাসে তিনি লিখছেন, হাঁসুলীবাঁক ছেড়ে চন্দনপুরে অভিবাসী কাহারেরা “এখন নতুন মানুষ। পোষাকে-কথায়-বিশ্বাসে তারা অনেকটা পালটে গিয়েছে। মাটি ধুলো কাদার বদলে মাখে তেলকালি, লাঙল কাস্তের বদলে কারবার করে হাম্বর-শাবল-গাঁইতি নিয়ে। তবে চন্ননপুরের কারখানায় খেটেও তারা না খেয়ে মরে, সাপের কামড়ের বদলে কলে কেটে মরে, গাড়ি চাপা পড়ে মরে।”

কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভূমিকা অস্বীকার করাও যে নিরর্থক। তারা মানবের দৈহিক শ্রমনির্ভর যাপন ক্রমশ করে তুলছে মনননির্ভর। অতীত ভাল, নাকি বর্তমান, এই বিতর্কের কোনও সমাধান নেই। হাঁসুলীবাঁকের শ্রমিক বনে যাওয়া কাহাররা “চন্ননপুরের ঘুপচি কোয়ার্টার্সে থেকেও তাকায় বালিভরা ওই হাঁসুলীবাঁকের দিকে। কিন্তু কী করে ফিরে যাবে তারা, আগে পথ ধরবে কে?”

ফিরব বললেই কি ফেরা যায় আদৌ? উইন্ডোজ় ইলেভেন এসে গেছে। চাইলেও আর ভার্সন এইট দিয়ে কাজ চালানো যায় না। কী ভাবে সে প্রত্যাবর্তন করবে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কালে? এখন সেই প্রযুক্তিযুগ, যখন আত্মীয়বন্ধুরাও কালেভদ্রে কারও গৃহে এলে, আগে লোকেশন শেয়ার করতে হয়।

অস্বীকার করা যাবে না, এই আধুনিকতম বৈদ্যুতিন প্রযুক্তিই নতুন করে হাঁসুলীবাঁক দর্শনের ইচ্ছে জাগিয়েছিল। সপ্তাহান্তে এক সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে, কলকাতার কাছাকাছি বেশ মনোরম কোনও স্থানের সন্ধান চলছিল ফোনের মাধ্যমে। হঠাৎ এসে গেল হাঁসুলীবাঁকের নাম। বহুকাল পর পুরনো প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়া যেন। কিংবা, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় কোনও বস্তুর পুনরুদ্ধার।

হাঁসুলীবাঁক? সেই হাঁসুলীবাঁক? উইকএন্ড ট্যুরের সব ব্যবস্থা করা সেখানে?

যতটুকু তথ্য সব জেনে নেওয়া গেল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত বিখ্যাত উপন্যাসের গৌরবমুকুটধারী মূলক্ষেত্র হাঁসুলীবাঁক এখন রাজ্য সরকার-কৃত অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। সুবিশাল পরিসরে আছে পুষ্পিতকানন, সুসজ্জিত তরুবীথিকা, বাচ্চাদের খেলাধূলার বিস্তৃত আয়োজন। আছে ভ্রমণপিপাসুর চিত্তরস ধন্য করার জন্য অপরূপ সবুজ, আছে চিরচেনা কোপাই নদীর সেই হংসীগ্রীবা বক্রতার বিস্ময়। গাড়ি নিয়ে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যায়, একখানি টুরিস্ট লজের নাতিস্পষ্ট ছবিও দেওয়া আছে আন্তর্জালিক বিবরণী প্রাঙ্গণে।

পরমোৎসাহে লজের অগ্রিম কক্ষ সংগ্রহে লেগে পড়া গেল। বিশেষ সুবিধা হল না। উপগ্রহী মানচিত্র বলছে, বোলপুর থেকে ষোলো কিলোমিটার। সে জানে ওই হাঁসুলীবাঁকের সঠিক সন্ধান, কিন্তু ওখানকার অতিথিশালার হদিস জানে না। অগত্যা, হাঁসুলীবাঁকে রাত্রিবাস করে, উপন্যাসের শুরুতেই ভয় ধরানো সেই অদ্ভুত শিসের কল্পনায় বুঁদ হয়ে যাওয়ার বিলাসী ইচ্ছা দমন করে, বোলপুরে একটি সরাই ব্যবস্থিত হল। পাকা সড়কের ধারে, পশ্চিমে দিগন্তছোঁয়া কৃষিখেত, পুবে পোড়ো জমি, দূরে ছোট ছোট গ্রাম, কোথাও কোথাও সরকারি প্রকল্পের ঘেরাজমি, কোথাও নামী-দামি প্রতিষ্ঠানের উঁচু বাড়ি। এতদ্‌সত্ত্বেও নতুন এই সরাইটি এখনও সবুজে ও শান্তিতে ঘেরা। পড়ে থাকা জমিতে উলুঘাস, এরাইল, চেচড়া, সিয়াকুল, বড়শ্যামার জঙ্গল।

সরাইয়ে স্থানীয় কর্মচারীদের কাছে হাঁসুলীবাঁকের হদিস জিজ্ঞেস করতে তারা বলে, “সেই তারাশঙ্করের হাঁসুলীবাঁক? হ্যাঁ। নাম তো শুনেছি। যাইনি কখনও।”

এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বরং, সাধারণ বীরভূমবাসী, আদৌ যাঁদের সঙ্গে সাহিত্যের সম্বন্ধ নেই, তাঁদের কাছেও তারাশঙ্কর পরিচিত নাম, তা ভাল লাগার বিষয়। এমনকি, তিনি যে লাভপুর ছেড়ে কলকাতার টালা অঞ্চলে বাস করছিলেন, তাও জানেন অনেকেই। কিন্তু তাতে হাঁসুলীবাঁকের সন্ধানে সুবিধা হয় না। অতিথির বিপন্নতা অনুভব করে সহৃদয় ‘মেঞ্জার’বাবু বলেন, “আপনারা বিশ্রাম নিন। কাল যাবেন তো? আমি বিকেলের মধ্যে খোঁজখবর নিয়ে রাখছি।”

এ যেন গুপ্তধনের সন্ধান। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। আন্তর্জালিক বিজ্ঞাপনে প্রচারিত ভ্রমণক্ষেত্রের খোঁজ জানে না অতিথিশালা? আবার সেই হাঁসুলীবাঁক পার্ক নিয়ে ওয়েবসাইটে তথ্যসন্ধানে ব্যস্ত হতে হল। যদি কিছু ভুল হয়ে থাকে আগের দেখায়। কিন্তু তথ্য একেবারে একই রকমে প্রোজ্জ্বল। কোনও বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। বোলপুর থেকে ষোলো কিলোমিটার দেখাচ্ছে। কী আর এমন দূর! স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অজ্ঞানতার চেয়ে উপগ্রহী মানচিত্র ও বিজ্ঞাপনে অধিক আস্থা রাখাই সমীচীন, এই সিদ্ধান্তে খানিক ভরসা এল। তবে দায়িত্বপরায়ণ ‘মেঞ্জার’বাবু কথা রাখলেন। বিশাল এক ঝাড়বাতি-জ্বলা ঝকঝকে লবির নরম সোফায় বসে তাঁর কাছে হাঁসুলীবাঁকের পথনির্দেশ বুঝতে হল। তিনি বললেন, “ব্রেকফাস্ট সেরে যাবেন। এখান থেকে চব্বিশ-পঁচিশ কিলোমিটারের কম হবে না।”

“চব্বিশ পঁচিশ? নেট বলছে ষোলো। তা সেটা আঠারো হতে পারে। তাই বলে চব্বিশ?”

“আপনারা কলকাতার লোক, এ পাড়া-ও পাড়া যেতেও নেট দেখেন। তবে নেটে সব সত্যি কথা থাকে না।”

কথাটা ভুল নয়। গুগল ম্যাপ দেখে সল্টলেকে ঠিকানা পেতেও বিস্তর চক্কর দিতে হয়েছে। জীবনে চলার পথের মতোই ভুল গলিতে ঢুকে হতবুদ্ধি হতে হয়েছে। উপগ্রহী মানচিত্রের বৈদ্যুতিন মগজ ফেল মেরেছে সেখানে বহু বার। তবু। সাহায্য পাওয়া গিয়েছে অনেক বেশি। এ যেন ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’র করালী। কাহার সমাজের মানুষ তার উদ্ধত অবস্থান সহ্য করতে পারে না, আবার তাকে অস্বীকারও করতে পারে না। যে রহস্যময় শিসের শব্দ দিয়ে উপন্যাসের শুরু, যা থানার দারোগাকেও নাজেহাল করে দিয়েছে, কাহার সমাজ যাকে ধরে নিয়েছে ‘বাবাঠাকুর’-এর রোষ, এবং তার মুক্তির উপায় সন্ধান করছে, সেই কুহকী শিসের উৎস একেবারে আমূল বাস্তব রূপে সর্বসমক্ষে এনে দেয় করালী। রহস্যভেদ করে স্বয়ং হয়ে ওঠে রহস্যময়, যে ভূত-প্রেত-মন্ত্র-তন্ত্র অনায়াসে অস্বীকার করে চলে যায়, যে মাতব্বর বনওয়ারীর নির্দেশ উড়িয়ে দেয় মক্ষীতাড়নের ভঙ্গিতে।

এই করালীকে তারাশঙ্কর বর্ণনা করেছেন ভারী চমৎকার। যাকে বলে টল ডার্ক হ্যান্‌সাম। তাঁর কথায়, “লম্বা দীঘল চেহারা, সাধারণ হাতের চার হাত খাড়াই তাতে কোনও সন্দেহ নাই, সরু কোমর, চওড়া বুক, গোলালো পেশিবহুল হাত, সোজা পা দু’খানি, লম্বা আমের মতো মুখ, বড় বড় চোখ, নাকটি খাঁদা; কিন্তু তাতেই চেহারাখানিকে করেছে সবচেয়ে মিষ্টি, তারও চেয়ে মিষ্টি তার ঠোঁট আর দাঁত। হাসলে বড় সুন্দর দেখায় করালীকে।”

কিন্তু করালী একরোখা, বেপরোয়া। তাকে সহ্য করা মুশকিল। বাবাঠাকুরের পুজোয় বলি দেবে বলে তিনখানা হাঁস নিয়ে এল করালী। কাহার সমাজের মাথা যারা, সেই হাঁস নিতে রাজি নয়। তারা চায়, করালী নাকে খত দিক, জরিমানা দিক, কারণ, রহস্যময় শিসের কারক সেই ‘পে-কা-ণ্ড চন্দ্রবোড়া,’ যে কিনা বাবাঠাকুরের প্রিয়, তাকে আগুনে ঝলসে মেরে ফেলেছে। সেই পাপের প্রতিবিধান করতেও সে আগ্রহী নয়। সে কারখানায় কাজ করে, তার রকম-সকম আলাদা। মাতব্বরের নির্দেশ শুনে “করালী আর কোনও কথা না বলে পট পট করে হাঁস তিনটের মুণ্ডু দু’হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল— কত্তা, খাবে তো খাও, না খাবে তো খেয়ো না, যা মন চায় তাই করো। আমাদের হাঁস খাওয়া নিয়ে কথা, আমাদের বলিদান হয়ে গেল—”

শুধু কি এই? কাহার সমাজের নিষেধ অগ্রাহ্য করে সে কারখানায় কাজ তো করেই, উঁচুতলার বাবুদের সামনে ধূমপান করে, লালমুখো সাহেবের সঙ্গে ইংলিশে কথা বলে, হেসে হেসে মেশে তাদের সঙ্গে, কাহার-সমাজের চিরায়ত প্রথা ও অকল্যাণের ভীতিকে নস্যাৎ করে সে নিজের দ্বিতল কোঠাঘর তোলে কাহারপল্লিতে।

করালীকে মধ্যমণি করে কাহারপাড়ায় এখন দু’টি দল। ধনী ও অভিজাত জমিদারের আশ্রয়ধন্য রক্ষণশীল বনওয়ারীর অনুগত অধিকাংশ কাহার। তবে তরুণ যুবকেরা করালীকে দলপতির জায়গা দিয়েছে। কারখানার কাজ ও চন্ননপুরের উদ্দাম জীবন তাদের ভাল লাগে। কিন্তু বনওয়ারীর মনে হয়, করালী পাপী, করালী সাক্ষাৎ ‘দানো’ অর্থাৎ দানব। কাহারকুলের অনেক পাপে হাঁসুলীবাঁকে ওর আবির্ভাব হয়েছে। তার ওই কোঠাঘরখানি “জিদের ধ্বজাই নয় শুধু, অধর্মের— কলিকালের ধ্বজা।”

করালী আজকের বৈদ্যুতিন হাতিয়ার। একই সঙ্গে সে খারাপ এবং ভাল। কেউ চাক বা না চাক, এই হাতিয়ার ব্যবহার্য ও অনস্বীকার্য।

সেই হাতিয়ার, যাকে বলে বৈদ্যুতিন মানচিত্র ও পথপ্রদর্শক— গুগল ম্যাপ নিয়ে, এবং ‘মেঞ্জার’বাবুর নির্দেশ সম্বল করে রওনা দেওয়া গেল হাঁসুলীবাঁকের উদ্দেশে। আগের রাতে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই ভ্রমণের দিনে রোদ ঝলমল করছে। গাড়ি চলেছে বোলপুরের মধ্য দিয়ে, প্রান্তিক স্টেশনের রেললাইন পেরিয়ে, সোনাঝুরির হাট পাশে ফেলে, মসৃণ পাকা সড়ক ধরে সিধে লাভপুরের দিকেই যাওয়া। পথের দুই পাশ অতি সবুজ ও সুন্দর। কোন সুদূর পর্যন্ত এই ফসলের খেতের ব্যাপ্তি। মাঝে মাঝে তাল-খেজুরের ঝোপ। ছোট ছোট খেজুরফলের ছড়া নেমেছে কত। অনেক বছর আগে, কয়েকজন মিলে বোহেমীয় আকর্ষণে হঠাৎ বোলপুরে আসা হয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলে সোনাঝুরির পথে চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। ফিরতি পথে, ঘুরে ঘুরে পৌঁছনো গেল এক ঘনান্ধকার ফসলের খেতে। অনতিদূরে টিমটিমে আলো আকৃষ্ট করছিল। বিশ্রাম চাইছিল পা দু’খানি। একখানি মেটেঘর। উঠোনে খাটিয়া পাতা। তাড়ির গন্ধ ভুরভুর করছে। তালের তাড়ির স্বাদ কেমন?

জনাকয়েক অঙ্গনে উবু হয়ে বসে স্টিলের গ্লাসে তাড়ি পান করছেন। ভান্ডার এসে ঠেকেছে তলানিতে। জুটল যা, তাতে স্বাদটুকুই বোঝা গেল, মৌতাত হল না। কিন্তু ওই তিমিরাচ্ছন্নতায়, তাড়ির মৌ-মৌ গন্ধে ভরা আঙিনায় খাটিয়ায় বসে স্টিলের গ্লাসে তাড়ির চুমুক আর গলা খুলে ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গেয়ে ওঠা, অন্তরে রয়ে গেল চিরন্তন হয়ে।

সঙ্গী বন্ধুদের সেই সন্ধ্যার কথা বলতে ভারী আনন্দ হচ্ছিল। কোলের ওপর সেলফোনে গুগল ম্যাপ খোলা। প্রয়োজনীয় নির্দেশ সত্ত্বেও এরই মধ্যে তিনটে লোকালয়ে হাঁসুলীবাঁকের সন্ধান নেওয়া হয়েছে। শস্যশ্যামল পশ্চিমবঙ্গের রূপে সকলেই মোহিত। মাঝে মাঝে পুকুর। তাতে অজস্র লাল শালুক। কোন মন্ত্রে বীরভূম কিছুক্ষণের জন্য হলেও শান্তি ও আনন্দের ব্রত নিয়েছে। মাঝে মাঝে সুন্দর, আলপনায় সাজানো মাটির বাড়িঘর দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠছে কেউ কেউ। আগে আরও কত মাটির বাড়ি ছিল, আস্তে আস্তে সব মুছে যাচ্ছে, এই বলে আক্ষেপ করছে কেউ। তারই মধ্যে একখানি ছোটনদী পেরিয়ে, মূল সড়ক ছেড়ে, বোলপুর থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে, একটি সরু রাস্তায় প্রবেশ করতে হল। লালমাটি আর পাথরের রাস্তা। দু’পাশে খেত আর খেজুরের গাছ। দূরে দূরে ইটভাটার চিমনির উত্তুঙ্গ মুখ। নানা জনের নির্দেশ ও বৈদ্যুতিন পথপ্রদর্শকের সাহায্যে এক সমৃদ্ধ গ্রামে পৌঁছনো গেল। মানচিত্র অনুযায়ী, কাছেই হাঁসুলীবাঁক। কিন্তু ঠিক কোথায়? তারাশঙ্কর বর্ণিত গ্রাম, মৌজা, জমির হিসেব, সকলই পরিবর্তিত। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’ একখানি উপন্যাস। তথ্যের সত্যাসত্যের দায় উপন্যাসের থাকে না। এখানে কল্পনার স্বাধীনতা সিংহভাগ। কিন্তু ওই যে একচিলতে যুক্তির জায়গা রইল, সেটুকুর গুরুত্ব অসীম। এই উপন্যাস বহুপঠিত ও সমাদৃত হওয়া সত্ত্বেও, যুক্তিবাদী সমালোচক প্রশ্ন তুলেছিলেন, সাপ আদৌ শিস দেয় কি না। বা, কোনও সাপের হিসহিসানি শিসের মতো হয়ে উঠতে পারে কি না।

সাপ শিস দেয় না, এ কথা কে না জানে। অনেকে এই সমালোচনার প্রতিযুক্তি দিয়েছেন, হাঁসুলীবাঁক রাতে এমনই নিঃশব্দ যে হিসহিস, শিস মনে হতে পারে। এর মধ্যে দুর্বলতা যে আছে, তা বোঝা যায়। শিসের মাধুর্য, অথবা তীক্ষ্ণতা, শিসের প্রলম্বিত সুদৈর্ঘ্য সাপের হিসহিস ফোঁসফোঁস কোনও কিছুর সঙ্গেই মেলে না। শুধু তা-ই নয়। যেখানে শিসের রহস্যভেদ হচ্ছে, সেখানে— “বাঁশের ঝাড়ের মাথা থেকে আগুনের উত্তাপে ধোঁয়ায় ক্লিষ্ট অবসন্ন হয়ে এলিয়ে নীচে পড়ছে একটা প্রকাণ্ড সাপ। পাহাড়ে চিতির মতো মোটা, তেমনই বিচিত্র তার বর্ণ, কিন্তু লম্বা খুব বেশি নয়।” এর পর সাপের পেটের মোটা ফোলা অংশ ফেটে বেরিয়ে এল একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা, যা, এই সাপটি আগের রাতে উদরস্থ করেছিল। এখন, প্রশ্ন হল, ওই খাদ্য পেটে নিয়ে সাপের পক্ষে বাঁশগাছের ডগায় আরোহণ করা কি বাস্তবে সম্ভব?

অর্থাৎ, প্রতিপাদ্য হল, যুক্তিনিষ্ঠতা উপন্যাসের একটি গুণ, তথ্যানুরাগ নয়। তথ্য স্বয়ং ভুলে ভরা হতে পারে। কিন্তু উপন্যাসের তথ্যানুগমন অন্য ভাবে অধিষ্ঠান করে। এ কালে ‘ডকুনভেল’ বা তথ্যভিত্তিক উপন্যাসের উপধারা তৈরি হয়েছে। তাতে তথ্য থাকবে একেবারে নথিসম্মত, কল্পনার রং তাকেই কেন্দ্র করে মেশাতে হবে, ফোটোগ্রাফের উপর রং বুলিয়ে চিত্রকলার মতো।

এই ডকুনভেল চিত্তাকর্ষক, নাকি বকচ্ছপ মূর্তি, সে কথা কালের বিচারে স্থির হবে, তবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি যতই সমাজনিষ্ঠ হোক, একটিও তথ্যকেন্দ্রিক উপন্যাস নয়। এর ফলে, ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’য় যে গ্রামের নাম পাওয়া যায়, তা চিহ্নিত হতে পারল না। মানচিত্রে একটি বড় নীল গোল্লা পড়ল, এত ক্ষণের সঙ্গিনী শ্রীকণ্ঠ ঘোষণা করল, “ইউ হ্যাভ রিচড দ্য ডেস্টিনেশন।”

গ্রামটির নাম কাদিপুর। গেরস্তের বাগানে ঘন গাছপালা, তার পেছনে একটি নদীর অস্তিত্ব অনুমিত হয়। তেমুখো সরু চলপথ ছাড়া অন্য রাস্তা নেই গাড়ি নিয়ে নদীর পাড়ে যাওয়ার। তা হলে কি হাঁসুলীবাঁকের সন্ধানে ওই গরমে, রোদ্দুরে হেঁটে যেতে হবে? শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির মধ্যে এত ক্ষণ গরমের কথা মনে পড়েনি কারও। গাড়ি থেকে নেমে তার প্রতাপ মালুম করা গেল। চালক চার দিক দেখে গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়ার অনুমতি চাইল। তাকে সম্মতি দিয়ে, ঝাঁকড়া আমগাছের তলায় ছায়া ছায়া ভিজে ভিজে অঙ্গে প্রবাহিত সরু গলির প্রান্তে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলা গেল। একটি মন্দির। তার দাওয়ায় সাদা ধবধবে শাড়ি পরা, পাকা সোনার বর্ণের এক নাতিবৃদ্ধা। অগ্রসর হয়ে পরিচয় সম্পন্ন করতে তিনি মুখে ঝকঝকে হাসি ভরিয়ে বললেন, “হাঁসুলীবাঁকের পথ আমি বুঝিয়ে দেব। গাড়ি যাবে। রাস্তা আছে।”

অতি প্রাচীন ভগবতীমন্দির ও এক ধারে লাল ইটের ভাঙা বাড়িটি বৃদ্ধার শ্বশুরের ভিটে। অন্য পাশে তিনশো বছরের পুরনো, মাটির রাধাগোবিন্দ মন্দির, সম্প্রতি সংস্কার করে সিমেন্ট ও টালি দিতে হয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখালেন বিশাল দিঘি, নাম বাঁধাপুকুর। এক ধারে সুপ্রাচীন পোড়ামাটির শিবমন্দির। ভিতরে পাথরের শিবলিঙ্গ, বাইরে, মন্দিরের গায়ে বটের ঝুরির আলিঙ্গন। বৃদ্ধা সগর্বে বললেন, “এ বাড়িতে তিনি একাধিক বার এসেছেন। শাশুড়ির কাছে শুনেছি, এই মন্দিরের দাওয়ায় বসে শ্বশুরের সঙ্গে তামাক খেতেন।” এঁরা চৌধুরী। বর্তমানে শরিকেরা ভাগ হয়েছেন, শুধু মন্দিরগুলি অবিভক্ত।

বৃদ্ধা চৌধুরীর নির্দেশিত পথে অগ্রসর হওয়া গেল। সে ভাবে পাকাপোক্ত পথ বলে কিছু নেই। একটি মাঠের উপর দিয়ে, গাঁয়ের এর-তার ঘরের গা ঘেঁষে, হেলতে দুলতে গাড়ি ঢুকে গেল উলুখাগড়ার বনে। মাঝে মাঝে খেজুরের গাছ, ফল পেকে টুসটুস করছে, আর বড়শ্যামা, সিয়াকুল, রেড়ি, উলুঘাসের মধ্যে থেকে সন্ধান চলছে, একটি খুব বড় বটগাছ ও তার পাশেই ইটভাটার চিমনি, বৃদ্ধা চৌধুরী বলে দিয়েছেন, সেখানেই হাঁসুলীবাঁক। বটগাছের নীচে বসে থাকেন ইটভাটার ‘মেঞ্জার’। তাঁকে চৌধুরীদের কথা বললেই হাঁসুলীবাঁক ঘুরিয়ে দেবেন।

ঘাসজঙ্গলের মধ্য দিয়ে এক সময় দেখা দিল চিমনি। এক পাশে ঘাসবন বেড় দিয়ে নদী, অন্য পাশে কাঁটাগাছে ভরা উঁচু ঢিবি। গরু-ছাগল চরছে, এক পাল ভেড়াও দেখা গেল। তাদের পেরিয়ে এক মনোরম খেজুরবীথির মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল গাড়িটি। থামল গিয়ে ঝাঁকড়া বটগাছের তলায়, ইটভাটার চিমনির পাদদেশে।

এক সারে গায়ে গায়ে গুটিকয়েক ছোট ছোট পাকা ঘর। এখানে ওখানে ইটের পাঁজা। কোথাও নেই কোনও সুসজ্জিত বাগান। নেই অতিথিভবন। ইটভাটার ‘মেঞ্জার’ এক সঙ্গী নিয়ে সবে পানের আসর খুলে বসছিলেন, সেই সব গুটিয়ে নিলেন হাসিমুখে। বললেন, “উ দেখ্যেন কেন্যে শিলান্যাস হঁইছে। মন্ত্রী এস্যে বল্যেন কী পার্ক হব্যেক, হাঁসুলীবাঁক্যে বোট্যিং হব্যেক।”

কবে হবে? কেউ জানে না। ন্যস্ত শিলায় শেওলা জমেছে। আগাছায় ঢেকে গিয়েছে জায়গাটি। বর্ষা এসে যাওয়ায় ইটভাটা বন্ধ। ‘মেঞ্জার’ এই স্তব্ধ সম্পদ পাহারা দিয়ে চলেছেন। উৎসাহ ভরে তিনি চললেন হাঁসুলীবাঁক দর্শন করাতে। তাঁর অনুসরণে প্রবেশ করতে হল সেই উলুখাগড়া, সিয়াকুল আর শ্যামা-ভরা জঙ্গলে। তিনি বীরবিক্রমে চলেছেন, হাওয়ায় দুলছে ঘাসের মাথা, মোটাসোটা শুঁয়োপোকা ঘাসের ডগায়। আরও কত কীটপতঙ্গ। ট্রাউজ়ারে লেগে যাচ্ছে অগণিত চোরকাঁটা। মনে পড়ল ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’য় কাহারপল্লির সেই বর্ণনা, “রোমাঞ্চটা আরও প্রবল হয়ে উঠল বাবাঠাকুরের থান পরিষ্কারের সময়। সেয়াকুলের ঝোপ কাটবার সময়, ওই ঝোপগুলির ভিতরের উইঢিপি থেকে বেরিয়ে পড়ল তিন-তিনটে আল-কেউটে। কেউটেকে ওরা খুব ভয় করে না। কোপাইয়ের তীরে, জাঙালের মাঠে আল-কেউটের বাস চিরকাল।”

আলের মতোই সামান্য উঁচু ইটের নির্মীয়মাণ নর্দমার গায়ে গায়ে পা ফেলে চলা। আবাদি জমি নেই বললেই চলে। বহু দূর পর্যন্ত লম্বা লম্বা ঘাসের বন শুধু। কিছু ক্ষণ চলার পর হঠাৎ এক খাদের কিনারায় থেমে যেতে হল। উঁচু পাড় থেকে অনেকটা নীচে তিন নদীর মিলন। এই বিন্দু থেকে ঘাসবনের উপর দিয়ে হংসীগ্রীবা কোপাইয়ের বাঁক পুরোপুরি দেখা যায়। উত্তর থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে ঘুরেছে সে দক্ষিণে। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে প্রবাহিত হয়ে আসছে শীর্ণ বক্রেশ্বর। এই মিলিত স্রোত বয়ে যাচ্ছে পুবে, এই সোঁতাকে স্থানীয় লোকেরা বলেন কুয়ো নদী। তার চলমানতায়, খানিক দূরে, মিশছে এসে কোপাইয়ের এক শাখা, যে ছোট নদীটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আসার পথে। দূর দিগন্তে একটি কারখানা নজরে আসে। মনে হয়, এই তো সেই চন্ননপুরের কারখানা, যেখানে কাজ করে করালী।

সূর্য উঠে এসেছে মধ্যগগনে। চড়া, চোখ-ঝলসানো রোদ্দুর। কোপাইয়ের ধারে, ঘাসের জঙ্গলে কোথাও গ্রামের চিহ্নমাত্র নেই। কখনও কি এই হাঁসুলীবাঁকে গ্রাম ছিল? জনবসতি? ‘মেঞ্জার’ হেসে বলেন, “কেমন করে থাকবে? এ তো বরাবরের অনাবাদি জমি। নিষ্ফলা জমিতে কি মানুষ বসতি গড়ে? তা ছাড়া প্রতি বছর এখানে বন্যা হয়। আরও খানিক বর্ষা নামলেই ওই ইটভাটা ভাসিয়ে দেবে কোপাইয়ের জল।”

“এই হাঁসুলীবাঁক নিয়ে বই লিখেছেন বীরভূমের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। নাম শুনেছেন?”

“শুন্যেছি বট্যে। বীরভূম লিয়ে অন্যেক বই লিখ্যেছেন। উন্যি তো লাভপু‌র‌্যের। তব্যে লিখ্যার জন্য কলকাত্যায় চল্যে গিয়েল্যেন। সেই বাস্যা এখ্যন ফাঁকা। কেও থাক্যার নাই।”

হয়তো এই তথ্য ঠিক, হয়তো নয়। তবে লাভপুর ছেড়ে তারাশঙ্কর কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন বলে আজও যেন এখানকার মানুষের মধ্যে চাপা অভিমান। নিজের জনের প্রতিই এমন অভিমান হয়, হয় গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থাকলেও।

এক ঝুলি নরম সুগন্ধী ও মিষ্টি স্থানীয় খেজুর উপহার দিলেন ‘মেঞ্জার’। ফেরার পথে আর বৈদ্যুতিন পথনির্দেশ দরকার হল না। চালক পথ বুঝে নিয়েছেন। বীরভূম বড় মনোরম। ভারী সুন্দর ওই হাঁসুলীবাঁক। তাকে নিয়ে আন্তর্জালে ওই মিথ্যে ছবি ও ভুল তথ্যই যা বেমানান।

সরাইয়ের ‘মেঞ্জার’বাবু বলেছিলেন, নেটে সব সত্যি থাকে না। ‘সত্যি’ নয়, বলতে হত ‘ঠিক’। এমনকি সাহিত্যকীর্তি নিয়েও মিথ্যের জাল সেখানে অনায়াসে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

tarashankar bandyopadhyay

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy