Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতা তুমি...

ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস: পর্ব ১৫ ঝন্টুর কথার কোনও জবাব না দিয়েই বাড়ির পথ ধরেছে গৌরাঙ্গ। চাদরের তলায় বন্দুক। একটা অজানা আশঙ্কা মনের আনাচে-কানাচে শীতের কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তার সঙ্গেই দাপাদাপি করে উঠছে অন্ধ রাগ। বাড়িতে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বুধুয়ার উপর।

সঞ্জয় দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ঝন্টুর কথার কোনও জবাব না দিয়েই বাড়ির পথ ধরেছে গৌরাঙ্গ। চাদরের তলায় বন্দুক। একটা অজানা আশঙ্কা মনের আনাচে-কানাচে শীতের কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তার সঙ্গেই দাপাদাপি করে উঠছে অন্ধ রাগ। বাড়িতে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বুধুয়ার উপর।

মায়ের মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে এখন। চোট খুব বেশি না। বেশি হলে এ ভাবে কথা বলতে পারত না মা। ঝন্টু আছে। বিল্টুও এসে হাজির হয়েছে। ওরা সামলে নেবে। বুধুয়ার থেকে কথা বার করতে পারেনি গৌরাঙ্গ, ছেলেটার এত জেদ। কিন্তু ছোটন যেটুকু বলেছে, সেটুকুই ঘুম কেড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট। চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় করাটা ঠিক হল না। আরও কেউ এসে পড়ার আগেই বন্দুকটা সরিয়ে ফেলা দরকার। এখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। চিত্তরঞ্জন স্টেশনে পৌঁছে গেলে রাতে কোনও না কোনও ট্রেন ধরা যাবে কলকাতার। কলকাতাই ভাল। হয় একেবারে ফেরত দিয়ে আসবে মাল, না হয় তুলসীর ঘরে দিন দুয়েকের জন্য রেখে দেবে। পরে তুলসীকে কিছু টাকা দিয়ে দিলেই হবে।

ঝন্টু আর বিল্টু মিলে মায়ের মাথার এক দিকে যত্ন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে।

‘আমায় মাল সরিয়ে ফেলতে হবে। কলকাতা যাচ্ছি।’ অলকাকে চাপা স্বরে কথাটা বলেই রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ল গৌরাঙ্গ।

বেশ কয়েক দিন বৃষ্টি হয়নি। জমাট বাঁধা, চাপা অন্ধকারের থমথমে গোপনীয়তা ঢেকে দিয়েছে শিউলিবাড়ির রাস্তা, মাঠ, বাড়ির উঠোন। দূরে কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে টেলিভিশনের খবর পড়ার হালকা আওয়াজ। হেলথ সেন্টারের বারান্দায় টিমটিম করে আলো জ্বলছে।

আজ শালা নেশাটাও ভাল করে জমল না। স্বাধীনতা দিবসের লাফড়াটা না থাকলে হয়তো পুলিশের ভয়টা তেমন থাকত না। কয়েকটা দিন সময় পাওয়া যেত অস্ত্রটা সরিয়ে ফেলার। কিন্তু আজ যা শুনে এল মালের ঠেকে, তার পর আর রিস্ক নেওয়া যায় না! শালা যত লাফড়া জোটে তার কপালেই। কোথায় ভাবল হাতে পাওয়া গেছে একটা ভাল জিনিস, বেশ টু-পাইস কমানো যাবে, কিছু দিনের জন্য নিশ্চিন্তি, তার মধ্যে শালা এই। স্বাধীনতা দিবস! যত্ত শালার ফ্যাকড়া। এ দিকে ছেলে আবার ভেবে বসে আছে, বন্দুক হাতে বাওয়াল করার নামই স্বাধীনতা! একরাশ বিরক্তির মধ্যেও হাসি পেল গৌরাঙ্গর।

স্টেশনের দিকে দ্রুত পা চালাল সে।

আঘাতের প্রজন্ম-পরিখা

‘স্বাধীনতা দিবসের কোনও অনুষ্ঠানে আমি দীর্ঘকাল অংশগ্রহণ করি নাই, আর জীবনের সায়াহ্নে আসিয়া সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার কোনও হেতুও দেখিতেছি না। দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন আমি ষড়বিংশতি বর্ষীয় যুবক। আমরা তখন অনেকেই ভাবিয়াছিলাম দেশ স্বাধীন হইয়াছে, এক্ষণে আমাদিগের কর্ম সমাপ্ত। যে সব দেশনায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁহারাই নিজ দায়িত্ব এবং বিপুল কর্মতৎপরতায়, দেশকে সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা করিয়া তুলিবেন। সর্বোপরি দ্বিখণ্ডিত, দ্বিধাবিভক্ত মাতৃভূমির গভীর ক্ষতে শান্তির প্রলেপ লেপন করিতে তৎপর হইবেন। প্রতি ক্ষেত্রেই আশাহত হইয়াছি। পরে উপলব্ধি করিয়াছি, আমরা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলাম। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেশব্রতীর নূতন দায়িত্বের সূচনা হয়, দায়িত্ব সমাপ্ত হয় না। কিন্তু যখন এই সত্য উপলব্ধি করিলাম, তখন আমার যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব অতিক্রান্ত, আমি বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে। সেই বয়সে নূতন কোনও কর্মোদ্যোগে প্রবল উৎসাহে ঝম্প দিয়া পড়িলে পদস্খলনের সমূহ সম্ভাবনা, তাই সে পথে অগ্রসর হওয়ার কোনও সংকল্প আমি গ্রহণ করি নাই। এতকাল পরে হঠাৎ এই অশীতিপর বৃদ্ধের কথা কেন সরকার স্মরণ করিলেন, এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর অন্বেষণ করার প্রয়াসও আমি করি নাই।

ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে বিলাতবাসীদিগের মনোভাব কীরূপ? এই বিষয়ে কোনও চর্চা সে দেশে হয় কি? নাকি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিবার পর, উহারা ভারতবর্ষের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়াছে? প্রসঙ্গত জিজ্ঞাসা করি, জেমস পেডির ইতিবৃত্ত কিছু উদ্ধার করিতে পারিলে কি?

তোমার খুল্লতাত এবং সহোদর ভ্রাতা, দুই জনেই তোমার ব্যবসায়িক প্রস্তাবের বিষয়ে খুবই আগ্রহী। আমি তোমার পরিকল্পনার বিষয়ে অবগত নহি, কিন্তু অন্য সকলের উৎসাহ থাকিলে আমি কোনও অন্তরায় সৃষ্টি করিব না। তোমরা যাহা ভাল বুঝিবে, তাহাতেই আমার সম্মতি আছে।

ভারতে আসিয়া তোমাকে নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে একটি আকস্মিক মৃত্যুর সাক্ষী হইতে হইল, এই ঘটনা আমাকে বিশেষ পীড়া দেয়! তোমার প্রতি সমবেদনা তো আছেই, কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে ট্রেনযাত্রাকালে এক জন নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটিল, অথচ কেহই কিছু বুঝিতে পারিল না, সেই মর্মান্তিক ঘটনা কী করিয়া ঘটিল, তাহার কোনও অনুসন্ধানও ঘটিল না, এই অবস্থা কি গ্রহণযোগ্য?

অনতিকাল পরেই সাড়ম্বরে স্বাধীনতার ষষ্টিতম বর্ষ পালিত হইবে। পত্রিকায় পড়িলাম যে কোনও দেশ নাকি অর্ধশতকের স্বাধীনতা উপভোগ করিলে সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয়। অর্ধশতকের স্বাধীনতার পর, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে আরও একটি দশক অতিক্রান্ত। স্বাধীন দেশের এক জন নাগরিক, প্রকাশ্য দিবালোকে, বিনা কারণে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হইবে এবং তাহার প্রতিকার দূরে থাক, কোনও অনুসন্ধানও ঘটিবে না? এক জন সুস্থ সবল নাগরিক, মুহূর্তের মধ্যে একটি নামহীন, গোত্রহীন মৃতদেহ? মলিন শ্বেতবস্ত্রের আচ্ছাদনের অন্তরালে, জনাকীর্ণ রেলস্টেশনে চিরতরের মতো হারাইয়া যাওয়াই কি স্বাধীন দেশের নাগরিকের ভবিতব্য? তাহা হইলে আর...’

‘গুডমর্নিং মিস্টার মুখার্জি, হাউ আর উই টুডে?’

ঝকঝকে নীল পোশাক পরা নার্সটির হাবভাব বেশ চটপটে। কণ্ঠস্বরে প্রসন্ন তৎপরতা। মনঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হল অর্ণবের। মুখ তুলে তাকাতে বাধ্য হল।

‘উই আর ওয়েল!’

‘উই’ শব্দটার উপর সামান্য জোর দিয়ে টেনে টেনে বলল অর্ণব।

কাল সন্ধেবেলাতেই রঞ্জনা দিয়ে গেছে চিঠিটা। কলকাতার কোনও একটা ডাকঘরের ছাপ মারা। তার মানে বাবা এখন কলকাতায়। এত দিন পরে হঠাৎ বাবার সঙ্গে একটা বিষয়ে একমত হবে, অর্ণব এটা ভাবেনি। এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা অনুভূতি তার কাছে। ট্রেনে একটা অজ্ঞাতপরিচয় লোকের মৃত্যু। কিন্তু বিষয়টা তাকে এবং অমিয়ভূষণ মুখোপাধ্যায়কে সমান ভাবে ভাবাচ্ছে!

‘মিস্টার মুখার্জি, মিস্টার মুখার্জি, ইউ আর টার্নিং দ্য রং ওয়ে,’ ফের সেই নার্সটি। ক্যাথরিন।

বাবার চিঠিটা হাতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অর্ণব। যে দিকে ঘোরার কথা নয়, বাঁ দিকে ফিরে শুতে যাচ্ছিল সে। ভুলে গিয়েছিল যে বাঁ হাতটায় ব্যান্ডেজ করা, কাঁধে বাঁধা স্লিং-এর উপর চড়ানো।

এই নিউক্রস হাউস হাসপাতালটা কেনসিংটনে, তার বাড়ির থেকে খুব দূরে নয়। বেশ ব্যবস্থা। পরিপাটি, ছিমছাম, নিস্তব্ধ। ঠিক যেমন প্রাইভেট হাসপাতালের হওয়ার কথা। হালকা ক্রিম রঙের দেওয়াল উদ্ভাসিত প্রথম প্রভাতের সোনালি রোদ্দুরে। মাঝারি আকারের যে ঘরটিতে অর্ণব রয়েছে, তার চারিদিকে সযত্ন পরিচ্ছন্নতার ছাপ। কোনার ওয়াশ বেসিনটা ঝকঝকে পরিষ্কার। বেসিনের উপর দেওয়ালে সাঁটা আয়না। আয়নার তলায় কাঁচের তাকের উপর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা অর্ণবের শেভিং কিট। পাশে একটা সুদৃশ্য আধারে তরলীকৃত সাবান। খাটটা এক প্রান্তের জানলা ঘেঁষে। খাটের পাশে চাকা লাগানো টেবিলে কয়েকটি ওষুধের শিশি, ছোট-বড় আকার অনুযায়ী সাজিয়ে রাখা। একটা বাক্স, তাতে কয়েকটা ট্যাবলেট। খাটের এক দিকে উঁচু করা লোহার রেলিং। সেখান থেকে ঝুলছে স্যালাইনের স্বচ্ছ প্লাস্টিক প্যাকেট। প্যাকেট থেকে পরিষ্কার নল ঝুলছে। একটু পরে নার্স ক্যাথরিন তার বাঁ হাতের কবজির একটু তলায় যে চ্যানেল করা আছে সেখানে স্যালাইনের টিউব লাগিয়ে দেবে। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের নল দিয়ে অর্ণবের শরীরে ঢুকবে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ।

ঘরের অন্য প্রান্তের বেডটি ফাঁকা। গত চব্বিশ ঘণ্টায় অর্ণবই এ ঘরের একমাত্র বাসিন্দা।

জানলায় ধবধবে সাদা পরদার ফাঁক দিয়ে এক ফালি বাইরের জগৎ দেখতে পাচ্ছে অর্ণব। গভীর, সবুজ ঘাস। তার উপরে টলমলে পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে একটি শ্বেতাঙ্গ শিশু। পিছনে তার মা। বাচ্চাটির মতো তার মা’ও ব্লন্ড। ঘাড় পর্যন্ত চুলের ঢল নেমেছে। সোনালি চুলে সকালের রোদ পিছলে পড়ছে। বাচ্চাটিকে কিছু একটা বলছে তার মা। ডান দিকে মুখ ফিরল একটু। মেয়েটি বেশ সুন্দরী।

‘ডক্টর ফিলিপস ইজ হিয়ার টু সি ইউ, মিস্টার মুখার্জি। শ্যাল উই লিফট ইউ আপ আ উইই বিট?’

নার্স ক্যাথরিনের গলা। সচকিত হয়ে জানলা থেকে মুখ ফেরাল অর্ণব। এত সকালে ডক্টর ফিলিপসের তো আসার কথা না! ভাগ্যিস আজ ভোরে উঠেছে অর্ণব। সকালবেলাতেই সেরে ফেলেছে বাথরুমের কাজ, প্রাতঃকালীন ক্ষৌরকর্ম। এক হাত ব্যান্ডেজ বাঁধা অর্ণবের। কাকভোরে তাকে বেড থেকে উঠতে দেখে হাঁ হাঁ করে এসেছিল রাত্রের নার্সটি। অমায়িক দৃঢ়তায় তাকে নিরস্ত করেছে অর্ণব। হাতটাকে সাময়িক স্লিংমুক্ত করে শৌচালয়ে যেতে কোনওই অসুবিধা হয়নি অর্ণবের। এ দেশে সব কিছুই ব্যবহারিক উপযোগিতার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। কথায় কথায় যে শব্দবন্ধটা শোনা যায় এ দেশে, তা হল ‘ইউজার ফ্রেন্ডলি’।

‘গুড মর্নিং মিস্টার মুখার্জি।’

সকালবেলাতেই নিঁখুত পোশাকে ডক্টর ফিলিপস। ছাই রঙের উপরে গাঢ় নীলের ডোরাকাটা স্যুটটা দেখেই বোঝায় যায় বেশ দামী। ভিতর থেকে উঁকি মারছে হালকা হলুদ শার্ট। সাদার উপরে সাদা কাজ করা সিল্কের টাই’টা বেশ নজরকাড়া। সাদা রঙের টাই চট করে দেখা যায় না। জামার পকেট থেকে মাথা বের করে আছে তিনটি কলম— দুটি কালো, মাঝেরটা সোনালি। এই হাসপাতালের সবচেয়ে ব্যস্ত কনসালট্যান্ট সার্জেনদের মধ্যে এক জন ডক্টর ফিলিপস। কিন্তু এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, সকালে কাজে বেরোবার আগে বেশ অনেকটা সময় আয়নার সামনে ব্যয় করেন তিনি।

ডক্টর ফিলিপসের নাম সুপারিশ করেন অর্ণবের জিপি, বা জেনারেল ফিজিশিয়ান, ডক্টর গ্যাবি নিজেই। এ দেশের নিয়ম হল, যা কিছুই হোক না কেন, প্রথমে দেখাতে হবে তোমার জিপি’কে। প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করে তিনি ঠিক করবেন তোমাকে বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর দরকার আছে কি না, থাকলে ঠিক কী ধরনের চিকিৎসা দরকার। তাই বাঁ হাতে তীব্র ব্যথা নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরে, পরের দিনই ডক্টর গ্যাবির সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল অর্ণব। ডক্টর গ্যাবি এক ঝলক দেখেই অর্ণবকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

‘মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট সার্জারি করতে হবে, মিস্টার মুখার্জি। ঘাবড়াবেন না, মাইনর অপারেশন।’

(ক্রমশ)

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy