Advertisement
০৮ মে ২০২৪
ছোটগল্প

বিপিন চৌধুরীর আত্মা

আজ অবধি এমন কখনও হয়নি। চিত্রগুপ্ত বারবার পাতা উল্টিয়ে রেজিস্টার দেখছিল। কিছু মাত্র ভুল ধরা পড়ছে না। প্রচণ্ড রেগে খাতাটা এত জোরে বন্ধ করল যে একটা মাছি চাপা পড়ে গেল।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ভবতোষ নায়েক
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ধর্মরাজ যম সিংহাসনে বসে। তাঁকে ঘিরে তাঁর দূতেরা। তার মাঝে এক জন ধর্মরাজের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। তার কুশ্রী চেহারা পরিশ্রমে, ভয়ে ও উৎকণ্ঠায় আরও বিকট হয়ে গিয়েছে। তার দু’দিকে দু’জন প্রহরী। ধর্মরাজের পাশে বসে চিত্রগুপ্ত, হাতে রেজিস্টার খাতা। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধর্মরাজ এত মানুষকে তার নিজের কুকর্ম ও সুকর্মের ভিত্তিতে নরকে ও স্বর্গে বাসস্থান অ্যালট করে আসছেন।

আজ অবধি এমন কখনও হয়নি। চিত্রগুপ্ত বারবার পাতা উল্টিয়ে রেজিস্টার দেখছিল। কিছু মাত্র ভুল ধরা পড়ছে না। প্রচণ্ড রেগে খাতাটা এত জোরে বন্ধ করল যে একটা মাছি চাপা পড়ে গেল।

‘‘মহারাজ, রেকর্ড সব ঠিক আছে। ভুল হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই। দু’দিন হল বিপিনবাবুর আত্মা দেহ ত্যাগ করেছে। যমদূতকে পাঠিয়েছিলাম ওকে আনার জন্য। কিন্তু ব্যাটা এখানে খালি হাতে ফিরে এসেছে,’’ রাগত কণ্ঠ চিত্রগুপ্তের।

‘‘এই কি সেই দূত?’’ প্রশ্ন করলেন ধর্মরাজ।

‘‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মহারাজ।’’

ধর্মরাজ যমদূতের দিকে তাকাতেই সে করুণ সুরে বলে, ‘‘মহারাজ, অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। এমন ধোঁকা আগে খাইনি কখনও। কিন্তু এ বার বিপিনবাবুর আত্মা ফাঁকি দিয়ে গিয়েছে। দু’দিন আগে যখন বিপিনবাবু দেহ ত্যাগ করে, আমি তাকে ধরে এই লোকে যাত্রা শুরু করি, শহরের বাইরে এসে ওকে নিয়ে তীব্র বায়ুতরঙ্গে সওয়ার হই। এমন সময় আমার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে কোথায় যে গায়েব হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারলাম না।’’

ধর্মরাজ রেগে গিয়ে বললেন, ‘‘মূর্খ, আত্মা আনতে আনতে বুড়ো হয়ে গেল। অথচ একটা মামুলি মানুষের আত্মা কি না তোর চোখে ধুলো দিয়ে পালাল?’’

দূত মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘‘মহারাজ, আমার সতর্কতায় বিন্দুমাত্র কমতি ছিল না। এত দিন এই হাত থেকে কোনও নেতা মন্ত্রী পার পায়নি। সে যতই ঘুঘু হোক না কেন। কিন্তু এ বার যে কী হয়ে গেল!’’

চিত্রগুপ্ত বলে ওঠে, ‘‘আজ্ঞে মহারাজ। ইদানীং পৃথিবীতে এই রকমের ঘটনা খুব ঘটছে। রেল গাড়ির ওয়াগন-কে-ওয়াগন পথেই কেটে নেওয়া হয়। ভোটের নমিনেশন জমা দিতে এসে লোকেরা মাঝপথে খালাস হয়ে যায়। শাসক দলের সঙ্গে বিরোধী দলের লড়াই তো রোজকার ঘটনা। এই লড়াইয়ে নেমে অনেকে হাওয়া হয়ে যায়। কে জানে হয়তো বিপিনবাবুরও তাই হয়েছে! অপোনেন্ট দল কিডন্যাপও করতে পারে।’’

‘‘তোমার কি রিটায়ার করার সময় হয়ে এসেছে না কি চিত্রগুপ্ত?’’ ব্যঙ্গের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করেন ধর্মরাজ। ‘‘বিপিনবাবুর মতো নিরীহ আত্মভোলা মানুষের প্রতি কার প্রতিহিংসা থাকতে পারে শুনি?’’

এমন সময় চারদিক বীণার সুরে মুখর হয়ে উঠল। ‘‘আহা, কার আবার এই ঝামেলার সময় রসবোধ জাগ্রত হয়ে উঠল?’’ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেন ধর্মরাজ।

‘‘নারায়ণ, নারায়ণ... ক্ষমা মহারাজ। আমি নারদ মুনি, যাওয়ার পথে মনে হল এক বার আপনার সঙ্গে দেখা করে নিই। আপনাকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। সব কুশল তো?’’

ধর্মরাজ বলেন, ‘‘সব ঠিক আছে। শুধু একটা সমস্যা বড় চিন্তায় ফেলেছে মুনি, দু’দিন আগে বিপিন চৌধুরী নামে এক বৃদ্ধ মারা গিয়েছেন। এই দূত তাকে নিয়ে আসতে গিয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে দূতকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় সে।’’

‘‘কোনও দেনাপাওনা বাকি ছিল না তো? হয়তো পাওনাদাররা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে! শোধ না করলে ছাড়বে না।’’ একটু থেমে তর্জনী ঠোঁটে রেখে আবার বলেন নারদ, ‘‘ব্যাপারটা খুব নড়বড়ে।’’ একটু ভেবে ধর্মরাজকে বলেন তিনি, ‘‘মহারাজ, আমায় তার নাম-ঠিকানা দিন। আমি পৃথিবীতে গিয়ে দেখি ব্যাপারটা।’’

রেজিস্টার চেক করে চিত্রগুপ্ত বলে, ‘‘বিপিন চৌধুরী খড়্গপুরের লোক। দুই মেয়ে ও এক ছেলে আছে। সরকারি কর্মচারী ছিলেন। কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছেন। গত এক বছর বাড়ি ভাড়া দেননি। সেই জন্য বাড়ির মালিক তাকে উৎখাত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে বিপিনবাবু পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।’’

ঠিকানা নিয়ে নারদ রওনা হলেন। মাঝপথে কান্নার শব্দ চিহ্নিত করে বিপিনবাবুর বাড়ির সামনে এসে বললেন, ‘‘রাম নারায়ণ।’’

আওয়াজ শুনে বছর সতেরো-আঠারোর একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে বলে, ‘‘এখন আসতে পারেন মহারাজ।’’

ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নারদ তাকে বলেন, ‘‘ভিক্ষের জন্য আসিনি বালিকা। বিপিনবাবু আছেন? ওঁর খোঁজেই এসেছি।’’

মেয়ে ও নারদের কথোপকথন শুনে ঘরের ভিতর থেকে বিপিনবাবুর স্ত্রী বাইরে বেরিয়ে আসেন। নারদের শেষের কথাগুলো তাঁর কানে গিয়েছিল। সে বলল, ‘‘আপনি ভুল সময়ে এসেছেন মহারাজ। আমার স্বামী আর আমাদের মধ্যে নেই।’’ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে আবার তিনি বলতে শুরু করেন, ‘‘আমরা গরিব। আমার স্বামী মানুষটা ছিলেন খুব নিরীহ। কয়েক বছর হল অবসর নিয়েছেন। কিন্তু পেনশন পাননি। পেনশনের জন্য আবেদনের পর আবেদন করেছিলেন। কোনও উত্তর মেলেনি। পেনশনের খোঁজে অফিসে গেলে তাঁকে ওরা শোনাত, তোমার পেনশন মামলা এখনও বিচারাধীন। শেষ কয়েক মাস তো আমার গয়না বিক্রি করেও সংসার চালিয়েছি। এখন সম্বল বলতে থালাবাসনগুলো। ’’

‘‘কী আর করা মা, এইটুকুই তার আয়ু ছিল।’’

‘‘অবসর নেওয়ার পর তিনি আবার কাজ করার কথা ভেবেছিলেন। পেনশনের টাকাগুলো পেলে একটা ব্যবসা শুরু করবেন ঠিক করেছিলেন। কিন্তু পেনশনই তো চালু হল না। সেটা পাওয়ার জন্য পরিশ্রম করতে করতে শরীর ভেঙে গেল।’’

নারদ বিদায় নিলেন বিপিনবাবুর বাড়ি থেকে। তার পরে চলে এলেন সরকারি অফিসে। সেখানে এসে বিপিনবাবুর পেনশনের ব্যাপারে কথা জিজ্ঞেস করতে অফিসার গোছের এক জন তাঁকে ডেকে পাঠাল। নারদের কাছ থেকে সব জানার পরে তিনি বললেন, ‘‘বিপিনবাবুর পেনশন চালুর আবেদনপত্র পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি হয়তো ঠিকঠাক মাল্লু ফেলতে পারেননি, তাই আটকে রয়েছে। এমনই অন্য বাবুদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলে দেখুন।’’

নারদ অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘মাল্লু? ওটা আবার কী?’’ অফিসার হেসে বলে, ‘‘যেমন ধরুন ভারী কিছু। যা রাখলে আবেদনপত্রটি ফট করে উড়ে যেতে না পারে।’’

নারদ আরও অবাক হয়ে পড়ে, ‘‘ওই যে ওইখানে পেপারওয়েট রাখা আছে, ভারী বটে, সেটা রাখলেই তো পারতেন!’’

অফিসার হেসে ওঠে, ‘‘আপনি সাধুপুরুষ। এই দুনিয়ায় সব আদবকায়দা বোধহয় আপনার জানা নেই। যাকগে, আপনি ভিতরের ঘরে বসে থাকা বড় অফিসারটির সঙ্গে দেখা করুন।’’

নারদ তার কাছে গেলেন। সে আবার দ্বিতীয় জনের কাছে পাঠাল। দ্বিতীয় জন তৃতীয় জনের কাছে... এই ভাবে প্রায় সাত-আট জনের কাছে চক্কর কাটলেন নারদ। শেষে এক কেরানি তাঁকে ডেকে বলল, ‘‘সারা বছর ধরে চক্কর কাটলেও কোনও কাজ হবে না মশাই। এক কাজ করুন, সরাসরি বড়সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন। তাকে খুশি করতে পারলে আপনার কাজ এখনই হয়ে যাবে।’’

নারদ বড়সাহেবের ঘরের কাছে গিয়ে দেখলেন, বাইরে চাপরাশি ঘুমোচ্ছে। কোনও বাধা না পেয়ে সোজা এসে দাঁড়ালেন বড়সাহেবের সামনে। হঠাৎ কেউ ঢুকে আসায় সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘এটা কি মন্দির না মসজিদ? সোজা ঢুকে পড়লেন! চিঠি পাঠাননি কেন?’’

নারদ বলে, ‘‘পাঠাব কাকে, বাইরে চাপরাশি ঘুমোচ্ছে।’’

চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বড় সাহেব বলল, ‘‘তা কী কাজে এসেছেন?’’ নারদ বিপিনবাবুর পেনশনের ব্যাপারটা জানান। সব শুনে সাহেব বললেন, ‘‘অফিসের নিয়মকানুন আপনি কী জানেন? আপনি বৈরাগী মানুষ। তবে এটা নিছক সরকারি অফিস নয়, বলতে পারেন এটাও একটা মন্দির। এখানেও প্রণামী দিতে হয়। তা আপনাকে দেখে বিপিনবাবুর নিকট আত্মীয় বলে মনে হচ্ছে। শুনুন, বিপিনবাবু এই প্রণামীর ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি বা বুঝেও বোঝেননি। বিপিনবাবুর আবেদনপত্র ওড়াউড়ি করছে। তার উপর মাল্লু ফেলুন, ঠিক পেয়ে যাবেন।’’

আবার সেই মাল্লু। মাল্লু জিনিসটা কী! খায় না মাথায় দেয়? মনে মনে ভাবেন নারদ। তাঁদের স্বর্গে তো এই শব্দটা শোনেননি তিনি।

সাহেব বলে চলে, ‘‘দেখো ভাই, সরকারি টাকার ব্যাপার। অনেকগুলো দফতর ঘোরে ফাইল। তাই সময় লাগে। তবে সেটা তাড়াতাড়িও হয়, যদি...’’ থামেন সাহেব।

নারদ জিজ্ঞেস করেন, ‘‘যদি?’’

সাহেব কুটিল হেসে বলে, ‘‘ওই যে বললাম, মাল্লু...’’

নারদ বুঝতে পারে ‘মাল্লু’ শব্দেই লুকিয়ে আছে সমাধান। তাই শব্দটার অর্থ আগে বুঝতে হবে। ‘‘আজ্ঞে, মাল্লু জিনিসটা কী যদি বলেন!’’

নারদের কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকায় সাহেব, তার পর একচোট হেসে নিয়ে বলে, ‘‘আপনি বুঝতে পারেননি? বেশ, আমি সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। যেমন ধরুন ভারী কিছু। তা আপনি বৈরাগী মানুষ, মাল্লু কোথা থেকে পাবেন! আপনার সুন্দর বীণাটাই ধরুন। এর ওজন বিপিনবাবুর আবেদনপত্রের উপর রাখা যেতে পারে। আমার মেয়ে গান শেখে। এটা আমি তাকে দেব। মেয়ে ভাল গান গাইতে পারলে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে সুবিধে হবে।’’ বীণার কথায় নারদ একটু ঘাবড়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই বীণাটি টেবিলের উপর রেখে বলে, ‘‘এই নিন। এ বার অর্ডারটি পাশ করে দিন।’’

সাহেব প্রসন্নচিত্তে নারদকে চেয়ার এগিয়ে দেয়। এক কোণে বীণা নামিয়ে রাখে। হাতের সামনে ঘণ্টি বাজায়। চাপরাশি এসে হাজির। সাহেব হুকুম দেয়, ‘‘আলমারি থেকে বিপিন চৌধুরীর পেনশনের ফাইলটা নিয়ে এস তো।’’ কিছু ক্ষণ পরে চাপরাশি ফাইল নিয়ে আসে। সাহেব ফাইলের উপরে লেখা নাম দেখে। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘কী নাম যেন, সাধুবাবা?’’

নারদ জোরে বলে, ‘‘বিপিন চৌধুরী।’’

‘‘কে? কে আমার নাম ধরে ডাকে? পোস্টম্যান না কি? পেনশনের অর্ডার এসেছে?’’ সহসা ফাইল থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সাহেব চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ে। নারদ চমকে উঠলেও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে, ‘‘বিপিনবাবু না কি?’’

‘‘হ্যাঁ’’, আবার স্বর ভেসে আসে।

নারদ বলেন, ‘‘আমি নারদ মুনি। তোমায় নিতে এসেছি। তোমার জন্য ধর্মরাজ অপেক্ষা করে আছেন।’’

‘‘আমি যাব না। পেনশনের আবেদনপত্রের তলায় চাপা পড়ে আছি। এ সব ফেলে আমি কিছুতেই যাব না। যত দিন না পেনশন চালু হয়, তত দিন আমি কোথাও যাব না। যমরাজ এলেও না...’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bhabatosh Nayak Short Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE