সারা পৃথিবীর নার্সদের অনুপ্রেরণা তিনি। আগামী ১২ মে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের দু’শো বছরের জন্মদিন। করোনা-ক্রান্তিকালের এই সময়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ২০২০ সালকে ‘ইয়ার অব দ্য নার্স অ্যান্ড মিডওয়াইফ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ঘোষণা এক, জনসংস্কৃতি আর এক। এ দেশের সংবাদপত্রে এখন প্রায়শ বিভিন্ন খবর। যেমন, করোনা-রোগীদের চিকিৎসা করছেন বলে বাড়িওয়ালা চলে যেতে বলছেন ভাড়া বাড়িতে থাকা সেবিকাকে, আবাসনে ঢোকার মুখে বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন অনেকে। এ বড় সুখের সময় নয়।
অক্টোবর, ১৮৫৩। ইউরোপের কৃষ্ণসাগরের চার পাশের দেশগুলো শীতে কাঁপছে। সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ। জ়ারের রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্স, ব্রিটেন, তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের সম্মিলিত শক্তির তিক্ততা চরমে। চলছে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। হাসপাতালগুলো থিকথিক করছে আহত, অসুস্থ সৈনিকে। হাজার হাজার সেনা প্রতিদিন হাসপাতালেই মারা যাচ্ছে। চার দিকে পড়ে আছে নিথর দেহ। মাটি দখলের লড়াইয়ের গায়ে গায়ে প্রাণঘাতী চোট-আঘাত, বিষাক্ত সংক্রমণ, মৃত্যুমিছিল। সৈনিকদের মৃত্যুর হার বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। ব্রিটেনের যুদ্ধ-সচিব সিডনি হার্বার্ট কালবিলম্ব না করে আটত্রিশ জনের একটি অভিজ্ঞ নার্স-দলকে ক্রিমিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। গুরুতর আহত সেনার শুশ্রূষায় অবিলম্বে তাঁরা যোগ দিলেন ক্রিমিয়ার ব্রিটিশ মিলিটারি হাসপাতালে। দলের সুপার একটি মেয়ে, নাম ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
মধ্য-তিরিশ ছুঁই-ছুঁই মেয়েটি শান্ত, বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ। এমন মেয়েরই নেতা হওয়া সাজে। ফ্লোরেন্সই প্রথম মহিলা নার্স, যিনি সৈন্যদলের হাসপাতালে সুপার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তা বলে অসুবিধে ছিল না, তা নয়। উনিশ শতকের সেনা কর্তৃপক্ষ এই ঘটনা ভাল চোখে দেখেনি। ফ্লোরেন্সকে তাই নিজের ‘মিশন’ সফল করতে ক্ষমতার সঙ্গেও লড়তে হয়েছিল। হাসপাতালে পৌঁছে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে ইতিকর্তব্য স্থির করলেন তিনি। প্রথমে কর্তব্যরত ডাক্তারদের অধীনে কয়েক জন করে নার্স নিয়ে কয়েকটি দল তৈরি করলেন। তার পর প্রতিটি হাসপাতালে তাঁদের পাঠিয়ে দিলেন নার্সিংয়ের কাজে। পুরো নার্সিংয়ের বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব ফ্লোরেন্সের নিজের কাঁধে, তাই নার্সদের একটি দল নিয়ে নিজেও বেরিয়ে পড়লেন হাসপাতাল পরিদর্শনে। কিন্তু হাসপাতালগুলোর পরিবেশ দেখে একই সঙ্গে অবাক ও হতাশ হলেন তিনি। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নোংরা জঞ্জালে ভর্তি। দেখলেন, অসুস্থ সৈনিকদের জন্য বিছানা, চাদরের বালাই নেই। সামান্য আসবাবপত্র যা লাগে, নেই তাও। রান্নার ব্যবস্থা, খাবারের মান কহতব্য নয়। নার্সিংয়ের কাজে যে জিনিস সবার আগে চাই, সেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটেশন বা স্যানিটাইজ়েশনের নামগন্ধও নেই। সর্বত্র ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, মাছির ভনভন। মিলিটারি হাসপাতালের এ রকম বিশ্রী অবস্থা! আরও পর্যবেক্ষণ করে ফ্লোরেন্স বুঝতে পারলেন, হাসপাতালগুলোর মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই। অসুস্থতার, রোগের হিসেব দিতে পারছে না কেউ। শ’য়ে শ’য়ে সৈনিককে প্রতিদিন সমাধিস্থ করা হলেও তার কোনও রেকর্ড রাখা হচ্ছে না। এই চূড়ান্ত অব্যবস্থা আর বিশৃঙ্খলা সামলে, সেবার মন নিয়ে আহত আক্রান্ত মানুষকে সুস্থ করে তোলার সাহস দেখানোও বিরাট একটা কাজ। সেই সাহস দেখিয়েছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। ছাত্রজীবনে গণিত এবং পরে রাশিবিজ্ঞান ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়। এ বার তাঁর নিজস্ব পরিসংখ্যানে ধরা পড়ল, যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বেশি সৈনিক মারা যাচ্ছে হাসপাতালে।