নতুন রিলিজ় হওয়া ছায়াছবির নায়কের নাম নাকি ছবি! পুরুষমানুষের নাম কখনও ‘ছবি’ হতে পারে? দর্শক পরিচয়লিপি দেখে ভেবেছিলেন হয়তো কোনও মহিলা চরিত্রাভিনেত্রীর নাম, অথচ দেখা গেল স্বয়ং নায়কেরই নাম ছবি বিশ্বাস। নাম যা-ই হোক, সুদর্শন সুপুরুষ নায়ককে দেখে বাঙালি দর্শক তখন আপ্লুত। সঙ্গে বলতে হবে নতুন এই নায়কের অভিনয়ের কথাও। কী দাপট! এমন নায়কের সন্ধানেই যেন এত দিন অপেক্ষা করছিল বাংলা ছায়াছবির জগৎ।
সেই সিনেমার নাম ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৬ সালের ১৩ জুন। সিনেমা আর নায়ক, দুই ‘ছবি’ই যথেষ্ট সফল, এ বার তবে পরিচালকদের লম্বা লাইন পড়বে তাঁর কাছে— এমনটাই বিশ্বাস জন্মেছিল ছবি বিশ্বাসের। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। কেন হল না? শুনলেন, তাঁর অভিনয়ের নানা খুঁত নিয়ে রীতিমতো প্রচার করছেন কমেডিয়ান নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। আর হতে পারেন চাটুজ্যেবাবু রোগা-প্যাংলা চেহারার, পার্শ্বচরিত্রে কমেডি করেই তাঁর যেটুকু নামডাক। কিন্তু সে কালের ইন্ড্রাস্ট্রিতে তিনিই নৃপতি-তিলক। প্রযোজক ও পরিচালকদের কাছে নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শ অত্যন্ত মূল্যবান। তাই পরিচালকরা ছবি বিশ্বাসকে ডাকছেন না আর। অথচ ছবিবাবু নৃপতিবাবুর সঙ্গে কোনও শত্রুতা করেননি, আলাপ পরিচয়টুকু নেই পর্যন্ত। তাও এক জন নবাগত অভিনেতার এ ভাবে ক্ষতি কেন করছেন— সেটা জানতেই এক দিন ছবি বিশ্বাস পৌঁছে গেলেন নৃপতি-দরবারে।
ছোটবেলা থেকেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের প্রতি অমোঘ টান। বিডন স্ট্রিটে তাঁদের বনেদি বাড়ি। সেই বাড়ির হলঘরে টান-টান করে পর্দা খাটাতেন। সেটা ব্যাকগ্রাউন্ড। তার সামনে চলত বালক ছবির অভিনয়। দর্শকাসনে বাড়ির সদস্য, পাড়ার লোক। মা হারানো ছেলেটির প্রতি তাদের ছিল অকৃত্রিম মায়া। রাজপুত্রের মতো দেখতে। বাড়ির দর্শকদের প্রশংসা পেয়ে উৎসাহী ছবি একটু বড় হয়ে যোগ দিলেন একটি শখের যাত্রাদলে— সিকদারবাগান বান্ধব সমাজ। তাদের ‘নদীয়া বিনোদ’ পালায় নিমাই সাজতেন তিনি। গৌরাঙ্গরূপী ছবিকে পালার শেষে প্রণাম করতে আসতেন অনেক ভক্ত-দর্শক। পরে ১৯৪১-এ ‘নিমাই সন্ন্যাস’ নামে একটি ছায়াছবি হয়, সেখানেও নামভূমিকায় অভিনয় করেন ছবি। ফণী বর্মা পরিচালিত এই দর্শকধন্য চলচ্চিত্র ছবি বিশ্বাসকে ফিরিয়ে দিয়েছিল আত্মবিশ্বাস। আর দেবকী বসুর ‘নর্তকী’ ছবিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয় সেই আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন।
“এর পর থেকে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ছবি— কোথাও নায়ক, আবার কোথাও নায়কের বাবা; কোথাও পলিশড ভিলেন আবার কোথাও কন্ঠীধারী বৈরাগী।… কত দুরূহ চরিত্রে যে তিনি রূপদান করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। স্যুট-টাই পরিহিত সাহেবি চরিত্রের পাশাপাশি কপর্দকহীন গাঁজাখোরের চরিত্র— সর্বত্রই তিনি সমানভাবে স্বচ্ছন্দ। হিং-বিক্রয়কারী কাবুলিওয়ালার চরিত্রে তিনি যেমন মানানসই, তেমনই মানানসই তৎকালীন জীবিত কিংবদন্তি দাদাঠাকুর শরচ্চন্দ্র পণ্ডিতের চরিত্রে।…বারবার তিনি পেয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা,” লিখেছেন রবি বসু, তাঁর ‘সাতরঙ’ গ্রন্থে। নিজের বায়োপিকে ছবি বিশ্বাসের অসাধারণ অভিনয় দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন দাদাঠাকুর স্বয়ং। তবে এই প্রশংসা নিজের কানে শুনতে পারেননি ছবি, তার আগেই যে পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন তিনি।
‘ছদ্মবেশী’, ‘জীবনসঙ্গিনী’, ‘সমাধান’, ‘মাটির ঘর’, ‘পরিণীতা’, ‘মিলন’, ‘বন্দে মাতরম্’, ‘দুই পুরুষ’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘সংগ্রাম’, ‘দম্পতি’, ‘অপরাজিতা’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাত্রির তপস্যা’, ‘পথে হল দেরি’, ‘সবার উপরে’, ‘শেষ পর্যন্ত’, ‘শশীবাবুর সংসার’— ছবি বিশ্বাসের দীর্ঘ ফিল্মোগ্রাফির মাত্র কয়েকটির নামই এখানে উল্লেখ করা হল। তপন সিংহ পরিচালিত ‘কাবুলিওয়ালা’ দেখে চোখের জল ফেলেনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া সম্ভব? ‘লেকিন খোঁকি তুমি সোসুরবাড়ি যাবে না, হামাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না’ এই আবেগী সংলাপ, ছোট্ট মিনিকে একটি বার দেখতে চাওয়ার আকুতিভরা চাহনি, সুদূর স্বদেশে রেখে আসা মেয়ের হাতের ছাপ দেখতে থাকা এক পিতার মর্ম-নিংড়ানো অভিনয়— ছবি বিশ্বাস কাবুলিওয়ালাদের বিষয়ে বাঙালির মন থেকে চিরকালীন ‘ছেলেধরা’ সন্দেহ ভুলিয়ে তার বদলে ঝুলিতে ভরে দিয়েছিলেন একরাশ ভালবাসা।
১৯৫৬-তে শম্ভু মিত্র এবং অমিত মৈত্রর পরিচালনায় তৈরি হল ‘একদিন রাত্রে’। ছবিটির প্রযোজক ও অভিনেতা, দুই-ই ছিলেন রাজ কপূর। সেখানে ছবি বিশ্বাসের লিপে সলিল চৌধুরী সুরারোপিত মান্না দে-র গাওয়া একটি গান বিখ্যাত হয়ে আছে আজও, ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি/ ঘুরিয়েই দুনিয়ার লাট্টু, ভগবান হারিয়েছে লেত্তি।’ জনশূন্য কলকাতার রাস্তায় মাতালরূপী ছবি বিশ্বাসের গলায় মালা, ঢুলুঢুলু চোখ, কণ্ঠে এই ব্যঙ্গগীতিটি আরও তীব্র হয়ে ওঠে রাজ কপূরের যোগ্য সঙ্গতে। ১৯৬১-তে বিজলীবরণ সেন পরিচালিত ‘মানিক’ ছবিটিতে ছবি বিশ্বাস আদ্যন্ত বিছানায় শুয়ে অভিনয় করেছেন। একটিও সংলাপ ছিল না। কেবল চোখ এবং মুখের অভিব্যক্তিতে চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি। ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’— সত্যজিৎ রায়ের এই তিনটি ছবিতে ছবি বিশ্বাসের অভিনয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের অহঙ্কার। সত্যজিৎ রায়ের কথায়, “ছবিবাবু না থাকলে ‘জলসাঘর’ আদৌ সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না। এক দিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃশ্যকারিতা, অন্য দিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সঙ্গীতপ্রিয়তা এবং সব শেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি— একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।” বেশ কয়েক বার তিনি বিএফজেএ-র পুরস্কার পেয়েছেন। নাট্যমঞ্চে অবদানের জন্য নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর এই সুযোগ্য শিষ্য ১৯৫৯ সালে ‘সঙ্গীত নাটক অকাদেমি’ সম্মানেও ভূষিত হন।
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে শিশিরকুমারের অভিনয় দেখে ছবি বিশ্বাস সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত পেশাদারি নাট্যমঞ্চে অভিনয় করে গেছেন। বিশ্বাস করতেন, মঞ্চে যদি জ্ঞানের আলো জ্বালানো যায়, তবে জাতির মনও জেগে উঠবে। আর বলতেন: “আমার যদি ক্ষমতা থাকত, আমি মঞ্চের সংস্কার করতে গিয়ে প্রথমেই প্রম্পটিং বন্ধ করে দিতাম।” ‘পরিণীতা’ নাটকে নরেন, ‘চরিত্রহীন’-এ সতীশ, ‘দেবদাস’, ‘কাশীনাথ’ এবং ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকে নামভূমিকায়, ‘শাজাহান’-এ ঔরঙ্গজেব চরিত্রে তাঁর অভিনয় অবিস্মরণীয়। “শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশিরকুমারের দুর্দিনে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে সেখানে অভিনয় করার জন্য এগিয়ে আসেন, অন্য জায়গায় মোটা টাকার প্রস্তাব ছেড়ে দিয়ে। শ্রীরঙ্গম মঞ্চে শিশিরকুমারের সঙ্গে ‘আলমগীর’ নাটকে রাজসিংহ চরিত্রে তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে,” লিখেছেন শঙ্কর ঘোষ।
বারাসতের পাশে ছোট জাগুলিয়া, সেখানে ছবি বিশ্বাসের ‘দেশের বাড়ি’। পূর্বপুরুষেরা ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার। পদবি ছিল ‘দে’, আর ‘বিশ্বাস’ নবাবি আমলে পাওয়া উপাধি। ছবির আসল নাম যেমন শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। ছোটবেলায় মায়ের আদরের ডাক ছিল ‘ছবি’। সেই ডাকনামে তাঁর নামডাক হবে, মা দেখে গেলে খুশি হতেন নিশ্চিত। দেশের বাড়িতে নিয়মিত যেতেন ছবি। জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজা ছিল দেখার মতো। গ্রামাঞ্চল, তাই সেখানকার উন্নতির জন্য ছবি বিশ্বাস নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করেছেন আন্তরিক ভাবে। মানুষের প্রতি এই দরদ শুধু দেশের বাড়ির ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না, বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে ছোট থেকে বড় যে কোনও অভিনেতা, টেকনিশিয়ান, অন্যান্য কর্মীর ব্যক্তিগত বিপদে বা সংগঠিত ন্যায্য অধিকারের দাবিতে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। এক শীতের রাতে বাড়ির সামনে ডিউটিরত পুলিশের এক কনস্টেবলকে ঠান্ডায় কাঁপতে দেখে নিজের দামি শালটা তার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৬২-র ১১ জুন। নিজের গাড়িতে চেপে যাচ্ছিলেন ছোট জাগুলিয়ার বাড়ি। কলকাতা থেকে রওনা দেওয়ার সময়ে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিলেন। মাঝপথে চালকের আসনে বসলেন ছবি। মধ্যমগ্রামের কাছে গঙ্গানগর মোড়। উল্টো দিক থেকে আসা একটি গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল গাড়িটি। আরোহীদের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। নিয়ে যাওয়া হল আরজি কর হাসপাতালে। মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের হস্তক্ষেপে ছয় ফুটের বেশি দীর্ঘ দেহটিতে কোনও রকম কাটাছেঁড়া করা হল না। এক কিংবদন্তি অভিনেতার অকালপ্রয়াণে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল গোটা বাংলা। জন্ম ১৯০০ সালের ১৩ জুলাই। প্রয়াণ মাত্র ৬১ বছরে। এ বছর তাঁর ১২৫ বছর পূর্ণ হল।
নৃপতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর জুবিলি পার্কের বাড়ির একটা বিছানায় কাউকে বসতে দিতেন না। কেউ ভুল করে বসতে গেলে শশব্যস্ত হয়ে তাঁকে সরিয়ে দিতেন, বসতে নিষেধ করতেন। তাঁর বাড়িতে এলে ছবি যে ওই বিছানায় বসতেন, ঘুমোতেন। সেই যে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ রিলিজ়ের পর ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের খুঁত ধরেছিলেন তিনি, ছবিও সেই জন্য হেস্তনেস্ত করতে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। ছবির অভিনয়ে যে যে দোষ ছিল, সব খুঁটিয়ে বলেছিলেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। মন দিয়ে সব শুনে সে দিনই নৃপতি চট্টোপাধ্যায়কে প্রণাম করেছিলেন ছবি বিশ্বাস, দিয়েছিলেন ‘ফ্রেন্ড, ফিলসফার ও গাইড’-এর আসন। আমৃত্যু সেই আসন থেকে নৃপতিদাকে সরাননি প্রিয় অনুজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)