নভেম্বর, ১৯৫১। তখনও ছিল অন্ধকার, তখনও ছিল বেলা। শীতের হালকা আমেজ শালে জড়িয়ে বিদায় নিলেন প্রিন্স বড়ুয়া। আড়ালের কুয়াশা একটু কেটে গেলেই পরের বছর প্রখর দহনে, ফুটে উঠলেন উত্তমকুমার। ‘বসু পরিবার’ মধ্যবিত্তদের সুরম্য কাহিনি। পরবর্তী ত্রিশ বছরে নক্ষত্রেরা দল বেঁধে আসেননি এমন নয়। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার রকমফেরে এ রকম দাবি করা যায়, ‘চাঁদ আসে একলাটি’। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত উত্তমকুমারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বাংলা সিনেমার অধিবেশনের নিঃশর্ত সভাপতি। আজ যখন বাংলা সিনেমার ‘ডেকাডেন্স’-এর আভিজাত্যটুকু হারিয়েছে, যখন বাংলা ছবির ভদ্রবিত্তরা ভাবের ঘরে নিয়ত চুরি করেন আর অন্দরমহলের সাজানো গরাদের আড়াল থেকে জামিন পান, তখন বাঙালির নস্টালজিয়া-সাধনে এটুকুই বলতে ইচ্ছে করে, তিনি, উত্তমকুমারই ছিলেন নিমজ্জমান আমাদের পক্ষে নোয়ার ভেলা বা অন্তিম পোতাশ্রয়। বস্তুত তাঁর অনামিকায় এমন ভাবে ধৃত ছিল একটি শকুন্তলার আংটি যে, সে দিকে তাকিয়ে উত্তর-স্বাধীনতা পর্বের বাঙালির আত্মপরিচয় উদ্ধার করতে দ্বিধা থাকত না।
তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম তাঁর যে ছবিটি আমি দেখি, তা ‘প্লট নাম্বার ফাইভ’— বাংলা নয়, হিন্দি ছবি। সেখানে তিনি পঙ্গু এক খুনি। ‘শ্রাবণঘন গহন মোহে’ তিনি, চতুর ঘাতক। সবার দিঠি এড়ায়ে একটি খুন করে এলেন। হিচককের একটি সাদামাটা অনুকরণ। কিন্তু আমি খেয়াল করেছিলাম, স্বভাবের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে উত্তম কী সাবলীল ভাবে অন্যের জন্য নির্দিষ্ট ভূমিকাতেও শিখরে পৌঁছে যাচ্ছেন। আর কী আশ্চর্য, তখনই যেন দৈবাদেশে আমার মনে পড়ে কমলকুমার মজুমদার প্রণীত ‘বঙ্গীয় শিল্পধারা’ প্রবন্ধের কতিপয় চরণ— “যে ক্ষমতা নিজের কাছেও গোপনে থাকে, সেই গোপনতা যখন একজনের কাছে সম্যকরূপে তাঁহার সমস্ত লক্ষণ লইয়া দেখা দেয়, এবং সেই একজন যখন আমাদের সে কথা বলেন, তখনই তিনি শিল্পী বলিয়া পরিগণিত হন।”
তিনি শিল্পী। মাঝে মাঝেই মনে হয় উত্তমকুমারের প্রতিভা এমনই অলৌকিক, যখন তিনি নিজের স্বাভাবিক চৌহদ্দি ছাড়িয়ে অন্যত্র সফর করতে যান, তখনও কী অনায়াসে চরিত্রলিপি ও গ্ল্যামার সরিয়ে দিয়ে হয়ে ওঠেন একমেবাদ্বিতীয়ম্। ‘যদুবংশ’ (১৯৭৪) ছবির গণনাথ যে যন্ত্রণার সারাৎসার উপহার দিয়েছেন ক্লোজ়-আপ শটে, তা প্রায় আধ্যাত্মিক। পরিত্যক্ত, পরাজিত মানুষের স্বরলিপি উত্তমের ভ্রুপল্লবে, নাকের পাটায়। ‘চিরদিনের’ (১৯৬৯) নামের একটি ছবিতে তিনি সিঙ্গল ফুল শটে জনাকীর্ণ রাজপথে এমন একাকী হয়ে যান, যেন মনে হয় উদ্ভ্রান্ত দেবদূত! বাস্তবিক উত্তমকুমারের স্বর্গীয় হাসি নিয়ে যত আলোড়ন, তাঁর বিষাদ নিয়ে তেমন গভীর মন্তব্য পাই না। তিনি এমন অভিনেতা, যাঁর ক্লোজ়-আপসমূহ সঙ্কলিত হলে মুখমণ্ডলের উপর একটি তথ্যচিত্র হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন হলেই তাঁর হাসির উচ্ছলতা অমিত্রাক্ষরের মতো বিষণ্ণতায় থমকে যায়। উত্তম যখন অভিনয় করতেন তখন মুখই অভিনয়ের কেন্দ্র। একটু সাহস করে আমি বলব, যখন তিনি নির্ধারিত প্রেমিক সত্তার বাইরে, ষাট-সত্তর দশকে তাঁর মুখের রেখায় ছড়িয়ে পড়ত অস্তায়মান সৌরকরের মতো এমন বিষাদ, যা আধ্যাত্মিক। যা কত কাছে তবু কত দূর!
তিনি ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ি খেতে পছন্দ করতেন না অথবা গোপনে হর্ষবর্ধনের চাইতেও উজ্জ্বল দানবীর ছিলেন— এ সব কুয়াশা উত্তমকুমারকে এত গহন ভাবে ঘিরে আছে যে তাঁর জীবনাধিক জীবন ও অভিনয়কর্ম সম্বন্ধে প্রায় কথাই বলা হয় না। যা হয় তা গুজব, স্তুতি ও কেচ্ছা। অথচ চলচ্চিত্রে তিনি যে গিরিশ ঘোষ ও শিশির ভাদুড়ির সমতুল্য, সে সম্বন্ধে গভীর আলোচনা প্রায় নেই। এমন হতে পারে, শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্ত এমন একটি শিল্পধারার সঙ্গে মূলত যুক্ত যা কয়েক হাজার বছর প্রাচীন, ফলে তাঁদের নিয়ে মন্তব্য করা সহজ। অন্য দিকে উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় মঞ্চসফল নট হলেও তাঁর প্রতিভা মূলত স্বাক্ষরিত চলমান চিত্রমালায়, যা মাত্র সোয়াশো বছর পুরনো একটি প্রযুক্তির অবদান। সুতরাং উত্তমকুমার যতটা খ্যাতিমান, ততটা ধীমান কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তিনি তা হলে কে ছিলেন? অনেক রকম উত্তর পাওয়া যেতে পারে। তার মধ্যে নায়ক বা অভিনেতার ভূমিকা সব থেকে গৌণ। চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করার বিশ বছরের মধ্যেই তিনি বাঙালির মিথোলজির অন্তর্ভুক্ত হন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ (১৯৬৬) ছবিতে ফিল্ম সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবী বাঙালির ইগো-কে প্রতিস্থাপিত করে উত্তমকুমারের রূপকথা। খেয়াল করার যে, এই ছবির ভূমিকালিপিতে উত্তম কোথাও নেই। অন্দরমহলে সাংসারিক দুপুরের অবসরে হালকা সিনেমা-পত্রিকা থেকে ‘উত্তমচরিতমানস’ গঠন করেন দুই মহিলা আর এই বাড়িরই তরুণতম ভাই ফিল্ম সোসাইটির আদলে ‘ত্রুফো’ নামের বিকৃত উচ্চারণ করে। উত্তম-রহস্য এ ভাবেই সংস্কৃতির অচেনা স্তর থেকে স্তরান্তরে ছড়িয়ে যায়।
যে কোনও চরিত্রই অতিকথার জন্ম দিতে পারে, যদি তা কোনও সন্দর্ভের প্ররোচনা পায়। উত্তমকুমার আমাদের সমাজের গল্পে, গুজব ও মশকরায়, কেশবিন্যাস ও চালচলনে শুধু ‘স-জীবনী’ অভিনেতা নন, তিনি যে অতিকথার জন্ম দিলেন, তা তাঁর অভিনয়-পারিপাট্যের জন্যও নয়। বরং সেই মুহূর্তমালার জন্য, যা এই অভিনয়কে বাস্তবায়িত করে। ফরাসি মনস্বী রল্যাঁ বার্থ থাকলে বলতেন, “মিথ এমন একটি বাচন যা ইতিহাসের দ্বারা নির্বাচিত। কিংবদন্তিরও ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে।” আসলে যে কারণে সুভাষচন্দ্র স্বাধীনতার পর অমর নেতাজি হয়ে গেলেন, উত্তমকুমারও প্রায় অনুরূপ কারণেই মহানায়ক হয়ে গেলেন। সত্যি বলতে কী, তথাকথিত বিমান-দুর্ঘটনার পরে সুভাষচন্দ্রের আর কোনও দায় রইল না ইতিহাসের কাছে জবাবদিহির। সেই কারণেই তিনি বিভাজনোত্তর দেশে অন্তত পশ্চিম বাংলা ও পঞ্জাবে যে কোনও বঞ্চনা ও অত্যাচারের প্রেক্ষাপটেই সামরিক উর্দি-পরিহিত নেতাজি হিসেবে দেখা দেন। তিনি আছেন, এই তো যথেষ্ট! এক দিক থেকে অকালমৃত্যু উত্তমকুমারকেও ইতিহাস থেকে অন্তর্ধানের সুযোগ দিয়েছিল। উত্তমকুমারের সাংস্কৃতিক কৌলীন্য না থাকাই তাঁর প্রধান ছাড়পত্র, তিনি জনসাধারণেরই এক জন।
‘অপরাজিত’-এর (১৯৫৬) নায়ক অপূর্বকুমার রায়ের মতো ‘শাপমোচন’-এর (১৯৫৫) নায়কের সাংস্কৃতিক আভিজাত্য নেই, কিন্তু প্রায় একই সময়ে সে অপুর মতো কলকাতায় আসে। গ্রাম থেকে শহরে আসার এই আখ্যানে উত্তমকুমার প্রায় অস্টারলিটজ়-ফেরত নেপোলিয়নের মতোই জনসাধারণের মন লুট করে নেন। শহরের মধ্যে এক অলীক গ্রাম তৈরি হয়, এবং উত্তমকুমার সেই নগরপল্লিতে লোকগাথার অবিসংবাদিত সম্রাট হয়ে ওঠেন। উত্তমকুমার বিধানচন্দ্র রায় বা জ্যোতি বসুর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন যে, তাঁর কোনও সামাজিক অডিটিং থাকবে। তাঁর ক্যারিশমা একের পর এক সঙ্কট অনায়াসে পার হয়ে যায়। উপরন্তু শেষ-পঞ্চাশ ও ষাট দশকের সামাজিক দোলাচলের দিকে তাকালে মনে হয়, ছবির পর্দায় এমন এক শান্তিনিকেতন তিনি গড়তে পারছিলেন, যেখানে স্থিতাবস্থাই সত্য। ‘শাপমোচন’ ও ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ (১৯৬৭) এবং ‘দেয়া নেয়া’ (১৯৬৩) গানের ছদ্মবেশের প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত প্রেমের আদর্শকেই তুলে ধরে। তাঁর গরিব চরিত্ররা বড়লোক হওয়ার শর্তেই নায়িকাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়। মূল মতাদর্শ তাঁর উপস্থিতিতে কখনওই বিপন্ন বোধ করে না। যতই তিনি বড় অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করেন, ততই তাঁর দিকে শিল্প-সিনেমার উপেক্ষা বঞ্চনার সত্য হিসেবে গ্রহণ করে জনসাধারণ বরণমালা নিয়ে এগিয়ে যায়। তাঁর রাজ্যপাট নিরঙ্কুশ হয়ে যায়।
বস্তুত উত্তমকুমারকে ‘বাংলার মুখ’ বলা যদি অতিশয়োক্তিও হয়, তিনি মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানার এক ধরনের মুদ্রা। যে আংটি দেখে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চেনেন, আমাদের উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে বাঙালিকে চেনার সে রকম আংটি, সে রকম হারানো সুর নিশ্চিত ভাবেই উত্তমকুমার। অথচ উত্তমকুমার বাঙালির মানসপটে অনুপস্থিতির সত্য, জীবৎকালে সংস্কৃতির নীল রক্ত তাঁর ললাটে টীকা হয়ে দেখা দেয়নি। আপাতভাবে এই কারণ তাঁকে বার বার জয়ী করে চলেছে। যেন তিনি বনেদি আর্টের বিচারশালায় সত্যিই প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু। আসলে গরিবের ছেলের বঞ্চনার একটা প্রতিকার গরিবরা চাইবেনই। এই প্রতিকার্য হিসেবে উত্তমকুমার আজও রোল মডেল টালিগঞ্জে। ইহলোকে তিনিই উত্তম। প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সকলেই ছদ্মবেশী দেবতা। সুতরাং কাহিনি পাল্টে দেওয়ার দায় নিয়ে রাজশেখর বসু-কৃত মহাভারতের সারানুবাদ থেকে একটু উদ্ধৃত করি, “দময়ন্তী দেখলেন তাঁদের গাত্র স্বেদশূন্য, চক্ষু অপলক, দেহ ছায়াহীন। তাঁদের মাল্য অম্লান। অঙ্গধূলিশূন্য। ভূমি স্পর্শ না করেই তাঁরা বসে আছেন। কেবল একজনের এই সকল দেবলক্ষণ নেই। দেখে দময়ন্তী বুঝলেন তিনিই নল।”
টালিগঞ্জের রাজ্যসভায় দর্শক উত্তমকে যথার্থই চিনেছিল। বুদ্ধিজীবীরা পারেননি। তাঁরা বুঝতেই পারেননি, সুচিত্রা-উত্তম জুটি ইতিহাসের অংশমাত্র, ইতিহাস ছাড়া উত্তমকুমারের স্থায়ী সঙ্গিনী কেউ নেই। পাউন্ডের অবমূল্যায়নের পরে যে বাঙালি তরুণ তিরিশ দশকের কলকাতার গলি-উপগলি চষে বেড়ায়, সে গোত্রে রাজ কপূরের ভবঘুরেটির থেকে ভিন্ন। বাঙালি আধুনিকতার ইতিহাস অন্য রকম। আলোকপ্রাপ্তির সীমানা যত ছোটই হোক, বাঙালির উনিশ শতক আছে। সাহেবি মেলোড্রামার নীল নকশাও উত্তমচরিতমানসে অত সহজে তাই প্রয়োগ করা যাবে না। আমাদের বঙ্গীয় সভ্যতায় শহরায়ণ ও সিনেমার গল্প অনেকটাই আলাদা। বিভূতিভূষণের অপু ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে কলকাতার মতো অপরিচিত শহরে পা রেখেই সিনেমার কথা ভেবেছিল। বাঙালির মন্থর গ্রামীণ সমাজে শিল্পের দিক দিয়ে ভাবলে, ছাপাখানার চেয়েও চলচ্চিত্র আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্বে অনেক সক্রিয় কারিগরি হস্তক্ষেপ। অপূর্ব এ কথা জানত। তাই আশ্রয়দাতা অখিলবাবুকে সে প্রথম সুযোগেই জিজ্ঞাসা করে, “বায়োস্কোপ যেখানে হয়, তা এখান থেকে কত দূর?” ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র শশী যেমন আধুনিকতার একটি মাত্রা, তেমন বিষ্ণু দে-র কবিতার আর্থিক দোলাচলের জন্য যে মেসবাড়ি ও বেকারবিহঙ্গের দেখা মেলে, তা অন্য মাত্রা। বিষ্ণুবাবুর ‘জন্মাষ্টমী’ কবিতার চতুর যুবকটি ভাবে, “এই যে অলকা তোমার পাশে কে পারে থাকতে স্ফূর্তিহীন?” আর চল্লিশ দশকের শুরুতেই তিনি যে ঈর্ষাকাতর যুবকটির দেখা পান, “ওই কি লিলির টেনিসের জুড়ি খসরু বেগ?” সে যদি লঘুচিত্ত জনপ্রিয় কথকতার মধ্যেও পরবর্তী কালে ‘বিচারক’ (১৯৫৯) বা ‘সপ্তপদী’-র (১৯৬১) কৃষ্ণেন্দু হয়ে দেখা দেয়, তা তো স্বাভাবিক। কল্লোল যুগ থেকে যে মেসবাড়ি মধ্যবিত্ত নাগরিকতার অঙ্গভূষণ, সমর সেন-সহ চল্লিশের কবিতায় যে রোমান্টিক দীর্ঘশ্বাস, জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পড়েছিল। উত্তমকুমার চিত্রজগতে সেই ঐতিহ্যের অনুবর্তন।
একটা যুগের মুখে ইতিহাস নানা রকম ব্রণের দাগ রেখে যায়। পণ্ডিতেরা যাকে ‘মাস-অর্নামেন্ট’ বলেন। দেখা যাবে, কল্লোল যুগের মধ্যবিত্ত যুবকের বিক্ষোভ, সময়ের চাপে প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথায় কী ভাবে জুড়ে গেল। স্বপ্নের নানা সিঁড়ি, পৌরাণিক স্মৃতি ও নতুন স্বাধীনতার আঁকিবুঁকি পেরিয়ে নির্মল দে, অজয় কর, অগ্রদূত প্রমুখ পরিচালকের সৌজন্যে উত্তমকুমার ক্রমশ শহরের দিনপঞ্জির অঙ্গ হয়ে উঠেছেন। উত্তমকুমারের ছায়াছবির দিকে তাকালেই ধরা পড়বে, জনপ্রিয় ধর্মীয় আখ্যান তাঁকে প্রায়ই সাহায্য করে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সাক্ষী হতে। ‘ফিউডাল’ বাতাবরণের পারিবারিক যৌথতা থেকে ব্যক্তির একক মুক্তিকে বুর্জোয়া যুগে সম্মুখবর্তী করার সময় বিস্মরণ ও গান্ধর্ব-বিবাহের গচ্ছিত দলিল তিনি কখনওই উপেক্ষা করেননি। বরং তাঁর চলচ্চিত্রপঞ্জি এক ধরনের ‘ফেনোমোনোলজি অব দ্য সারফেস’। মলাট খুলে ফেললেই বোঝা যাবে, নাগরিক সভ্যতার চলন তিনি রপ্ত করে চৈতন্যে উল্কি আঁকছেন। যে যুবক মেসবাড়ি ও যৌথ সংসারের বাসিন্দা ছিল, সে যখন গাড়ি, সুরা, রোদচশমা ও নারীতে স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে, তখন টের পাই শহরবাসের ইতিকথা। দৃষ্টান্ত ‘মন নিয়ে’ (১৯৬৯), ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ (১৯৭৪), ‘শঙ্খবেলা’ (১৯৬৬) বা ‘মৌচাক’ (১৯৭৫)।
যে মধ্যবিত্ত উত্তর-ঔপনিবেশিক আবহচরিত্র পাচ্ছিল, যে গণতান্ত্রিক সংস্থাসমূহ সিভিল সোসাইটির স্বীকৃতি প্রত্যাশা করেছিল, ব্যক্তিমানুষের সততা ও কঠোর শ্রমের যে কিংবদন্তি নবীন প্রজাতন্ত্রের রক্ষী দল আকাঙ্ক্ষা করেছিল, তিন দশক উত্তম-কাহিনি নিবেদন করলে তার একটি সদুত্তর নিশ্চয়ই মিলবে, কেননা বাংলা ছায়াছবির তিনি প্রথম অভিনেতা, যিনি তারকার স্তরে উন্নীত হন। মূলত মুদ্রণ মাধ্যম তাঁকে নির্মাণ করে, অথচ স্বীকৃত মিডিয়ার বাইরে ভক্তদের গল্পকথায়, নানা রকম দায়িত্বহীন জীবনীতে, আলোকচিত্রে তিনি সম্প্রসারিত করে চলেন সেই নক্ষত্রপাঠ। তিনি স্বপ্নের, কিন্তু বাস্তব সেই স্বপ্নের যতিচিহ্নসমূহ সম্পাদনা করে। উত্তম এমন কিছু করেন না বা ঘটান না, যা বাঙালির পক্ষে অপরিচয়ের।
দু’টি কথা একেবারে আদি সত্য— উত্তমকুমার চলচ্চিত্র সংসদ অনুমোদিত আর্ট-পুতুল কোনও দিনই ছিলেন না। প্রথম যুগে তিনি পারিবারিক কাহিনির মধ্যে বিস্তৃত হতেন। স্থান-কালের পরপারে প্রেমের জাদুবিদ্যাই দেখাতেন বৈষ্ণব পদাবলির নবীন কিশোরের শাহরিক কটাক্ষে। আর আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। জ্যোতি বসুর সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচে ও মহাকরণে তাঁর ছবি থাকলেও তিনি কোনও সামাজিক আন্দোলনের পুরোভাগে থাকতে চাননি। দু’-একটি ত্রাণ সংগ্রহের মিছিলে থাকলেও প্রদর্শনযোগ্য সমাজ-সচেতনতা তিনি উপহার দেননি। কোনও বিবৃতিতে তাঁর নাম থাকেনি। ফলে নাক-উঁচু বামপন্থী প্রবক্তারা তাঁকে অপাঙ্ক্তেয় কেউ ভেবে গেছেন আজীবন। নিয়তির পরিহাস যে মৃত্যুর পরেও প্রথম ‘ভরত পুরস্কার’ প্রাপ্ত নায়ক রাষ্ট্রীয় করুণা থেকে বঞ্চিত হন। যদিও শোকমিছিলে যোগ দিতে জনতার হৃদয়ে কোনও কার্পণ্য দেখা যায়নি। কোনও সন্দেহ নেই, শিল্পের কৌলীন্য যে পরিমার্জনা দাবি করে, উত্তম তার সুযোগ কমই পেয়েছেন। তাঁর সমগ্র জীবননাট্যই জনমনোরঞ্জনের প্রতি নিবেদিত। চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিবেশে টালিগঞ্জের গড়পড়তা পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেই তাকে লোকলক্ষ্মীর বরমাল্য জয় করে নিতে হয়েছে।
“মেরিলিন প্লেড দ্য বেস্ট গেম উইথ দ্য ওয়র্স্ট হ্যান্ড অব এনিবডি আই নো”— শ্রীমতী মনরো সম্বন্ধে যা বলা হত, উত্তমবাবু সম্বন্ধে তা নানা স্তরেই প্রযোজ্য। এমনকি অনুজ সহকর্মী অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ বা সৌমিত্র, এমনকি বসন্ত চৌধুরীর তুলনায় তাঁর মুখচ্ছবি অসুন্দর— এ কথা বলা যদি অতিশয়োক্তি হয়, তা হলে বলব, অনার্য। রূপের দিক থেকে উত্তম দেবদুর্লভ নন, শালপ্রাংশু মহাভুজ শারীরিক সুষমা তাঁর মধ্যে নেই, তবু তিনিই নক্ষত্র, তিনিই নায়ক। এমনকি উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতির চিহ্নায়নও এই অভিনেতাটিকেই ম্যাটিনি বিগ্রহের গুরুত্ব দেয়। বলা বাহুল্য, সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমকুমারকে অবলম্বন করেই চলচ্চিত্রের বাণিজ্যব্যবস্থা বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন। হলিউডে যৌনতার সহর্ষ প্রতিলিপি মে ওয়েস্ট একদা সকৌতুকে বলেছিলেন যে, তাঁর দীর্ঘ ও রঙিন জীবনকাহিনির একটি জিনিসই সত্য যে, তাঁকে ভুল বোঝা হয়েছে। টালিগঞ্জে বিষাদগ্রস্ত হয়ে এই কথাটা বলার অধিকার যাঁর আছে, তিনি উত্তমকুমার। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর মতো নবতরঙ্গ উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্র স্রষ্টা এখানে কোনও মেরিলিন মনরোর শরীরের উচ্ছ্বসিত তটরেখার প্রতি স্তুতি করবেন না। উল্টো দিকে, এমনকি সত্যজিৎ রায় হলেও, সাবধান থাকবেন। তাঁর জীবনীকার অ্যান্ড্রু রবিনসনকে জানাবেন, বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠীতে অন্তত প্রেসিডেন্সির ছাত্রীদের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। আমাদের এলিট বিদ্বজ্জন বার বারই উত্তমকুমারকে ‘স্বভাবকবি’ বিবেচনা করে আলোচনা এড়িয়ে গেছেন— আমার মতে, এ এক ধরনের রক্ষণশীল মানসিকতার দৈন্য। বাঙালি ভাবুকরা ভাবতেই পারে না যে, উত্তমকুমার হলিউড সিনেমা নিয়মিত দেখেন। তবে ফিল্ম ক্লাব তার গন্তব্যস্থল নয়। তিনি পল মুনি, মার্লন ব্র্যান্ডো ও রিচার্ড বার্টনের অনুরাগী নাইট শো-তে। বিশেষত বার্টনের কণ্ঠস্বরের ওঠানামা উত্তমের অনুধাবনীয় ছিল। ‘নায়ক’ (১৯৬৬) যিনি এক বারও দেখেছেন তিনিই বুঝবেন, ইটালীয় নক্ষত্র মার্চেল্লো মাস্ত্রোইয়ান্নি কী প্রবল ভাবে চোখ ও নাকের নানা মুদ্রায় আচ্ছন্ন করে রেখেছেন উত্তমকুমারকে। কণ্ঠ বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর উত্তমকুমার রিচার্ড বার্টনের স্বরক্ষেপণ ও মাস্ত্রোইয়ান্নির মুখের বিন্যাসকে তন্নিষ্ঠ ছাত্রের মতো পাঠ্য ভেবেছেন। রাতের প্রেক্ষাগৃহ ছিল মধ্য কলকাতায় উত্তমকুমারের পাঠশালা, যার খবর শুচিবায়ুগ্রস্ত বাঙালি সাংবাদিক ও শিল্প-সিনেমার কলমচিরা রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি।
না, বিনয় মজুমদার সমীপে ঋণ স্বীকার করে বলা যায়, বিদেশি ভাষায় কথা বলার মতো সাবধানে এ বার উত্তম-প্রসঙ্গে আসি। এক দিন বিকেলে ম্যাটিনি-শো’তে উত্তমকুমার স্থির, দীর্ঘ, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন অপর্ণা সেনের দিকে। সলিল দত্তের ‘অপরিচিত’ (১৯৬৯) ছায়াছবিতে। একটি দীর্ঘ অবলোকনে, মুহূর্ত যেন অমরাবতীর দিকে ঝুঁকে পড়ল। পাপ ও পুণ্যের অন্তর্বর্তী আলো ফুটে উঠেছিল তাঁর চোখে। স্বর্গে পৌঁছনোর লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিল ভুলে— জীবনানন্দের সাহায্য ছাড়াই বুঝতে পারি— মিড ক্লোজ়-আপের অর্থ, স্তর থেকে স্তরান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে নির্জন নরকগামী উত্তমের মুখের রেখায়। একদা ‘মনিকার সঙ্গে গ্রীষ্মাবকাশ’ যাপনের সুযোগে গোদার-সহ সমস্ত নবতরঙ্গ বার্গম্যানের নায়িকা হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসন-এর দৃষ্টির একটি লং টেক থেকে খুঁজে পেয়েছিল আধুনিক বাস্তববাদের মহিমা। উত্তমকুমারের এই স্তব্ধ দৃষ্টিরেখা একটি মুহূর্তকে ব্যবহার করে উত্থানের বদলে বেছে নেয় পতন। অনেক পরে আমি বুঝতে পারি, উত্তম হয়তো অজানতেই পা রাখলেন আধুনিকতার নিজস্ব প্রদেশে। এ-ই তো নৈতিকতার সমস্যাপট: পাপ-পুণ্য, মঙ্গল ও অমঙ্গল সবই সমান। সত্যের উপলব্ধিতে অশুভ শুধু ভ্রান্ত নির্বাচন। অথবা আরও পরিণত, বলা ভাল, উত্তরকালের উত্তমকুমারের দিকে নজর রাখলে বুঝতে পারি, তিনি চিত্রনাট্যের অতিরিক্ত হয়ে উঠেছেন; যত দুর্বলই হোক, কাহিনির নাটকীয় লক্ষ্য থেকে নিজের অভিনয়ের ভঙ্গি আলাদা করে নেন। এত দূর পর্যন্ত তিনি পৃথক হয়ে যেতে পারেন যে, ‘রাতের রজনীগন্ধা’ (১৯৭৩) বা ‘দুই পৃথিবী’ (১৯৮০) জাতীয় ছবিতে তাঁকে চট করে ‘কাস্টিং এরর’ বলে মনে হতে পারে। তিনি ক্যামেরাকে গুরুত্বই দিতে চান না। এক দিক থেকে দেখলে তাঁর অভিনয় সমগ্র বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে ক্রমশই উদ্ধৃতির মতো হয়ে দাঁড়ায়। যেন স্বগতোক্তি, যেন একান্ত ব্যক্তিগত কয়েকজন অনুপস্থিত দর্শকের জন্যই তিনি অভিনয় করে যাচ্ছেন— হয়তো নিজেকেই দেখানোর জন্য— যার ফলে ঠোঁট বা ঘুরে তাকানোর মুদ্রাও কোরিয়োগ্রাফিতে রূপ পেয়ে যায়। ভাবলে অবাক লাগে, জীবনের শেষ পাঁচ বছর, যখন তিনি আর নির্মল দে, অজয় কর বা অগ্রদূতের ছবি করেন না, তাঁর জন্য নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে আছে অক্ষমের অনুরোধ, তখনও তিনি চরিত্রে কী অসমসাহসে চক্ষুদান করেন। আমাদের হাতের সামনেই তো আছে ‘বাঘবন্দী খেলা’ (১৯৭৫) জাতীয় অকিঞ্চিৎকর ছবি, যেখানে চিত্রনাট্য তাঁকে অনুসরণ করে রচিত হয়েছে বলাই যথেষ্ট নয়, উত্তমকুমার সেখানে কাহিনি ছাপিয়ে সর্বব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। তাঁর কটাক্ষ, সংলাপ, উচ্চারণ সব কিছুই স্বাক্ষরিত। আমার লোভ হচ্ছে, ‘ফরাসি রেনেয়া’ প্রবন্ধ থেকে আঁদ্রে বাঁজার একটি বাক্য চুরি করতে— “দিস স্টাইল ইজ় অ্যাডেড টু দ্য স্ক্রিপ্ট লাইক রিচ পেন্ট লিবারালি অ্যাপ্লায়েড টু আ লাইন ড্রয়িং; অফন দ্য কালার ইজ় অবস্কিয়োর অ্যান্ড স্পিল ওভার দ্য লাইনস।” হয়তো চিত্রনাট্য, গল্প ও চরিত্র যে ভাবে উত্তমকুমারকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল, কারণ তিনি ইন্ডাস্ট্রি, তাঁকে বন্দনা করছিল, এমনকি পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়, নড়বড়ে ও পলকা আখ্যানগুলি তাঁর সঙ্গে যে ভাবে সানন্দে সহমরণে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাতে অভিনয়-ভিত্তিক ‘অতরিজ়ম’-এর আলোচনা কত দূর সম্ভব, তা ভাবা যেতেই পারে। কিন্তু আপাতভাবে বলা থাক এই যে, চিত্রনাটের পরিধি থেকে উপচে পড়ার প্রবৃত্তি— এই স্বভাবই তাঁকে সময়ের শ্রেষ্ঠ মুখপাত্র হিসেবে বর্ণনা করে যাবে।
এক জন আধুনিক তাত্ত্বিক, রল্যাঁ বার্থ— গ্রেটা গার্বো ও অড্রে হেপবার্নের মুখের তুলনা করে বলেছিলেন, গার্বোর মুখ যদি ধারণা হয়, হেপবার্নের মুখ তবে ঘটনা। আগের নায়কদের প্রসঙ্গ টানলে প্রমথেশ বড়ুয়ার মুখ যদি ঘটনা হয়, উত্তম তবে চিন্তা-পরিসর। কন্দর্পনিন্দিতকান্তি প্রিন্স বড়ুয়া যদি দেবতা হন, তবে পরে পরেই ভারী ঠোঁট ও চাপা নাক-সহ উত্তমকুমার নিতান্ত মৃত্তিকার জীব ও নশ্বর।
অত রূপ যেন আকাশের দেবতাদেরই মানায়। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়ারা আমাদের বিভক্ত বাংলার হতশ্রী জীবনে আটপৌরে ভাবে নেমে আসেননি। তাঁদের বিষয়ে আমরা কৌতূহল বোধ করেছি, কিন্তু আত্মীয়তা নয়। অন্য দিকে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর জুড়ে উত্তমকুমার নক্ষত্র হলেও আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের যাবতীয় মুগ্ধতা নিয়েই উত্তম বাংলা ছবিতে প্রথম রক্তমাংসের পুরুষ। পঞ্চাশ দশকের শুরুতে তিনি যে বাঙালির হৃদয় জয় করে নিতে পারলেন, তাঁর অনভিজাত মুখ অতীত সময়ের এমন এক সেতু যা ওই রল্যাঁ বার্থেরই ভাষায় ‘অ্যাশিয়োরস দ্য প্যাসেজ ফ্রম অ টু চার্ম’। এই তো মুহূর্ত— “চণ্ডীদাস কয় নব পরিচয় কালিয়া বঁধুর সনে”। উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে উত্তম নানা দিক থেকে আমাদের জীবনে আশ্বাস ও সুবাতাস। হেমন্ত-কণ্ঠে, সুচিত্রার আহত ভ্রু-বিলাসে, অজয় করের সফ্ট ফোকাস-আলোয় উত্তম উপমারহিত হয়ে রইলেন— “হি ডাজ় নট ট্রাই টু বি আ ফেয়ারিটেল প্রিন্স বাট অ্যান অ্যাভারেজ মিডল ক্লাস বয় রেইজ়ড টু দ্য এনথ পাওয়ার।” তারকা নির্মাণে হলিউড আর টালিগঞ্জ আলাদা সড়কের যাত্রী নয়। প্রদর্শনবাদেরও সামাজিক ভিত্তি থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে মার্কিন অর্থনীতির টানাপড়েন, ওয়াল স্ট্রিটে আমেরিকার নৈতিক ভিত্তির যে দৈন্য, পণ্ডিতরা বলেন, তা নির্মাণ করেছিল মেরিলিন মনরোকে। এই যৌন বিদ্যুল্লতা— তাঁর আকস্মিক উদয়, শরীরের ক্ষমাহীন সন্ত্রাস ও পূরবীবিধুর অস্ত— শেষ পর্যন্ত আমেরিকান সমাজব্যবস্থার ফাঁকফোকর মেলে ধরে। উত্তমকুমার স্থিরতর সভ্যতার মানুষ। কিন্তু দেশবিভাগ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভক্ত বাংলায় সামাজিক অবদমনের জন্যই দাবি জমেছিল স্বপ্নের পরিসর রচনার। সেই স্বপ্নের পরিসরে ছায়াছবি-আকাশে স্বভাবতই তারা ফুটবে। যেমন উত্তমকুমার। তিনি শুধু অভিনয়ে নয়, কেশবিন্যাস ও বাচনভঙ্গিতে, কেচ্ছায় ও কোলাহলে, কত কাছে তবু কত দূর!
এক জন নট কখন তারকায় রূপান্তরিত হন? প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি যখন মাধ্যমের সমান্তরাল আর একটি জীবন রাখতে পারেন। সে জীবনের প্রতি সমাজের অদম্য কৌতূহল থাকে, সে জীবন পর্দার বাইরে উপচে পড়ে। সে জীবনে স্ক্যান্ডাল, থানা-পুলিশ থাকে, বিয়ারের ফেনা যেমন গ্লাস থেকে চলকে পড়ে, তেমনই। উত্তম নিশ্চয়ই বাঙালি মধ্যবিত্তের একটি চিহ্নায়ন, কিন্তু আজ আর তিনি ব্যক্তি না নট হিসেবে তত অভিনিবেশ দাবি করেন না, যতটা বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে তাঁর ‘স্টার’ হিসেবে উপস্থিতি ‘স্ট্রাকচারড পলিসেমি’র দাম পেতে চায়।
উত্তমকুমার কেন স্টার হয়ে উঠলেন? কেন তাঁকে দেখে মনে হল, একটি নক্ষত্র আসে? প্রকৃত সত্য হল, যে দ্বন্দ্বের নিরসন সামাজিক ও ঐতিহাসিক স্তরে করা সম্ভব ছিল না, তার নিরসন ঘটেছিল চলচ্চিত্রায়িত জীবনে। রিচার্ড ডায়ার তাঁর তারকাতত্ত্বে দেখাতে পেরেছেন, তারকাদের আবেদন অনেকটাই নির্ভর করে থাকে জনসাধারণের বাসনাকে তাঁরা কতটা প্রামাণ্য রূপ দিতে পারছেন, তার মাপকাঠিতে। তারকার এই যে দুর্নিবার আকর্ষণ, যাকে আমরা বলে থাকি ‘ক্যারিশমা’, সে প্রসঙ্গে বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার জানান যে তা কার্যকরী বিশেষ ভাবে তখনই, যখন সামাজিক পরিবেশে অস্থিতি ও অনিশ্চয়তা আছে। আর ওই দোলাচলের মধ্যে এক ধরনের স্থিতি, শৃঙ্খলা ও সাম্যাবস্থার ছোঁয়া আনেন এই ক্যারিশমাটিক চরিত্র। এ বার যদি স্বাধীন ও বিভক্ত বাংলার দিকে তাকাই, তবে স্পষ্ট হয়ে যাবে উত্তমকুমারের সাফল্যের রহস্য। দাঙ্গা, মন্বন্তর ও দেশভাগ আমাদের কাছে এত বড় বিপর্যয় ছিল যে, চল্লিশ দশকের শেষে ও পঞ্চাশ দশকের শুরুতে নবীন প্রজাতন্ত্রের খুব বর্ণসমারোহ ছিল না তরুণ প্রজন্মের বিচারে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও নানাবিধ সরকারি উদ্যোগকে বরং মনে হতে থাকে স্বাধীনতার ফাঁকি। পশ্চিম বাংলায় এই মলাটের মধ্যেই উত্তমকুমারের আবির্ভাবলিপি। স্বাধীন ভারতের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বছরেই মুক্তি পায় তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ছবি ‘বসু পরিবার’। একটি সামন্ততান্ত্রিক দেশের শিল্পায়ন ও নাগরিকতা গ্রামীণ যৌথতার জলবায়ুতেই ব্যক্তির নিজস্বতাকে নিম্নরেখ করতে চাইলেও, জনমানস এই ব্যক্তিকে ইতিহাসের মধ্যে অনুপস্থিত দেখছে। যখন ক্ষুদিরাম, সুভাষ বসুদের শূন্যস্থান পূর্ণ করা অসম্ভব, তখন এক জন নক্ষত্রের উদয় হওয়ার সময়। পঞ্চাশ দশকের শহর ও মফস্সলের অজস্র তরুণ-তরুণীর কাছে সেই নক্ষত্রই উত্তমকুমার।
উত্তমকুমার কাউকে হতাশ করেন না। যে হেতু সংস্থা-স্বীকৃত ক্ষমতা তাঁর নেই, যা রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসকদের থাকে, ফিউডাল সভ্যতার সামাজিক স্তরে যে নিভৃত কূজন ও দাম্পত্য অসম্পূর্ণ থাকে, তা উত্তম-সুচিত্রা মেলোড্রামাতে একটি অন্য পরিসরে সম্পন্ন হয়। উত্তমকুমারের অবস্থানে একটি বিনীত, সংরক্ত অথচ উদাসীন ‘মুশকিল আসান’ আশ্বাস আছে, যা নক্ষত্রোচিত। ‘হারানো সুর’-এর (১৯৫৭) শেষে তিনি যখন বিস্মরণের অবসানে নায়িকাকে সম্বোধন করেন ‘ডাক্তারবাবু’ বলে, নায়িকা তাঁর বক্ষলগ্না হওয়ার প্রাক্ মুহূর্তেই বুঝে যান বক্তা দুনিয়ার সব ডাক্তারের থেকে বড়, আর ওই বক্ষপটেই সব দুর্যোগের অবসান। উত্তমকুমারই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পারিবারিক চিত্রলেখাটি বিপর্যস্ত না করে সমাধানের মোহনা খুঁজে পান। এই সমাধান পরিবার, সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করে না, আকাদেমিয়া বা শাসনযন্ত্র বিপন্ন হয় না, কিন্তু ইচ্ছাপূরণের অলীক সত্য প্রতিষ্ঠা পায়। আরও প্রবল ভাবে যা পল্লবিত হয়ে ওঠে, তা স্থিতাবস্থার সত্য। হারবার্ট মার্কইউজ যে অযথা স্টার-সিস্টেমকে সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার ইতিবাচক পদক্ষেপ মনে করেছেন তা নয়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের আন্দোলন-অশান্তির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, উত্তম-আখ্যান প্রায়ই মূল মতাদর্শের পক্ষে ব্যবহারযোগ্য একটি আধার হিসেবে কাজ করেছিল।
যদি চট করে সত্যজিৎ রায়-কৃত ‘নায়ক’ (১৯৬৬) ছবির কথা ভাবি? একটি দৃশ্যে ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিতে উত্তম ব্রজেশ্বরের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। উত্তম এখানে নবীন অভিনেতা হিসেবে পুরনো অভিনেতার সঙ্গে কথা বলছেন। প্রাচীন অভিনেতা বলছেন, “এ কী! তোমার গলা যে শোনা যাচ্ছে না! জোরে গলা তুলে বলো।” এ-ই তো নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। এক আত্মোপলব্ধি সত্যজিৎ রায়ের সৌজন্যে আমরা জানতে পারছি। শব্দের ভূমিকা পর্দায় ও নাটমঞ্চে এক নয়। সিনেমার অভিনয় যে অবিচ্ছিন্ন নয়, বিমূর্ত আর কণ্ঠস্বর এখানে ভিন্ন স্বরলিপি অনুসরণ করে, উত্তমকুমারই তা বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম উপলব্ধি করেন। থিয়েটার ‘শ্যামলী’র উত্তমকুমার আর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর (১৯৫৩) উত্তমকুমার কণ্ঠস্বরের দিক থেকে আকাশপাতাল আলাদা। মঞ্চ আর চলচ্চিত্র যে আলাদা, তা তো শম্ভু মিত্রের মতো অবিস্মরণীয় নটও ভুলে যেতেন। একই ভাবে সিনেমাটিক মিতমাত্রার অভিনয় দিয়ে তিনি তাঁর রোমান্টিক নায়িকাদের আতিশয্য ঢেকে দিয়েছেন। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১) পর্যন্ত সুচিত্রা সেনের চাউনি, গ্রীবাভঙ্গি ও উচ্চারণে যে অতিরঞ্জন, তা পয়ারের মতো প্রেমের স্বাভাবিক ছন্দ হয়ে ওঠে উত্তমের তুলনামূলক চাপা অভিনয়ে। কর্তৃত্বময়ী সুপ্রিয়া চৌধুরী, বাসনামদির কাবেরী বসু, চপলা কিশোরী অপর্ণা সেন, ব্যক্তিত্বের রেখাচিত্র অরুন্ধতী বা পাড়ার চেনা মেয়ে মাধবী, মায়াহরিণীর মতো সাবিত্রী, এমনকি সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় বা অঞ্জনা ভৌমিক উত্তম-সান্নিধ্যে স্বচ্ছন্দে গীতিকবিতার মতো হয়ে উঠছেন, কেননা উত্তমকুমার বাঙালি সমাজ-বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেননি। তিনি শেষ পর্যন্ত প্রেমিক, বৈষ্ণব পদাবলি থেকে যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্নেহ ও ক্ষমাশীলতার প্রতিচ্ছায়া। পাহাড়ে ও সমুদ্রে, পতন ও সাফল্যে উত্তম নির্ভেজাল বাঙালি বলেই পোর্ট কমিশনারসের এই কনিষ্ঠ কেরানিটিকে আমাদের মনে হয় ছদ্মবেশী রাজকুমার।
অর্থাৎ নক্ষত্রের যে প্রামাণ্যতা দরকার, উত্তমকুমার আপন দেশ-কাল-সময় সমীক্ষায় তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। বরং তাঁর পোশাক, তাঁর ঘটি উচ্চারণরীতি, তাঁর অভিমান, তাঁর আভিজাত্য, তাঁর দারিদ্র, তাঁর সংলাপ, সব কিছুতেই আছে প্রমাণিত হওয়ার অলঙ্কারশাস্ত্র। অলঙ্কার যত ক্ষণ পর্যন্ত অশনাক্ত থাকে, তত ক্ষণ পর্যন্ত তা বিশ্বস্ত ও আন্তরিক উচ্চারণ, আমৃত্যু উত্তমকুমারের এ কথা জানা ছিল। তিনি প্রথমত এবং শেষত দর্শকেরই। তাঁর অভিনয়ের সাফল্য ও সীমানা এখানেই। উত্তমকুমার মাতালের অভিনয় করেছেন, কিন্তু এই জেনে যে, তাঁর দর্শকের রুচি মত্ততার সীমারেখা জানে। তিনি স্থানবিশেষে স্থূল, কিন্তু কদর্য নন, কেননা মধ্যবিত্ত রুচির মাত্রা তাঁর করতলধৃত আমলকী। পয়ার যেমন বাংলা কবিতার মূল ছন্দ, উত্তম কুমারের লাজুক ও অভিমানী মুখচ্ছবি তেমনই মধ্যবিত্ত বাঙালির ছাড়পত্র। যে জন্য দর্শক যখন প্রেমিকের বদলে তাঁকে শয়তান হিসেবে দেখেছে, তখনও সে বিচলিত হয়নি, কারণ উত্তমের হাসিটুকুই তাঁর প্রায়শ্চিত্ত।
সত্যজিৎ রায় যে ম্যাটিনি-আইডল হিসেবে উত্তমকুমারকে বেছে নিয়েছিলেন, তা প্রায় নির্বিকল্প হয়েই। বস্তুত অরিন্দমের জন্য কোনও অন্য অভিনেতা থাকা সম্ভব নয়। বাঙালি যে যে কারণে তারার দিকে তাকায়, তার প্রায় সব ক’টি উত্তম পূরণ করতে পারতেন। নায়কের ‘নায়ক’ অভিনয় বাঙালি সবচেয়ে প্রামাণ্য শংসিত বাস্তব। সত্যজিৎ রায় শিল্পী বলেই জানতেন, উত্তমকুমার যখন শিল্পী নন, তখনও নায়ক। দিগন্তের ঈষৎ দূরে, যেন দেবদাস, আমাদের চেতনায় প্রায়শ্চিত্তের অপর বিন্দু। মদ, নারী ও নরক, দেবদাস বা উত্তমকুমারের পা টলায় না। উপন্যাস ও সিনেমার পরপারে তারা আমাদের জীবন্ত রূপকথা।
আমাদের শৈশবে পাড়ার নিউ বনফুল সেলুনে, নেতাজি ও উত্তমের পাশাপাশি দু’টি ছবি, তলায় লেখা থাকত— ‘দেশের জন্য নেতাজী, চুলের জন্য উত্তম’। ভুলে এক বার সেখানে চুল কাটিয়ে তোতলা চন্দন বাবার কাছে বিস্তর মার খায় ও তিরস্কার হিসেবে ‘ক্যারেক্টারলেস’ শিরোপা উপহার পায়। কিন্ত সত্যজিৎ রায় তো তাঁর বিখ্যাতছবি শুরুই করেন ওই ভুবন ভোলানো ইউ-ছাঁট দেখিয়ে। বাঙালি বুদ্ধির নায়কেরা আজও এই ধাঁধার জবাব পায়নি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)