Advertisement
E-Paper

কান্না হাসি কাজের মাসি

কোনও কাজের মাসি শিখিয়েছে গালাগাল, কেউ বিড়ি খাওয়া। কেউ শিখিয়েছে আভিজাত্য, কারও ঘটনায় খসে গেছে ভদ্দরলোকের পরদা।ইতিহাস বইয়েরও অনেক আগে কাজের মাসিই প্রথম আমাকে হিন্দু-মুসলিম ভেদ শেখায়। তখন আমাদের বাড়ির বৃদ্ধা দাই-মা কাজ ছেড়ে দিয়েছে। শেষ কয়েক বছর তার ছানি আর কামাইয়ের চোটে মা’কে বাসন মাজার ওভারটাইম করতে হত হামেশা। দিনের বেশির ভাগেই মা ডাঁই বাসন নিয়ে কুয়োপাড়গামী— এ ছিল চেনা দৃশ্য, আর ঠাকুমা প্রতি বার একই রকম দীর্ঘশ্বাস-সহ নতুন-নতুন প্রতিবেশীদের ধরে বলে চলেছেন, দাই-মা’টাও চলে গেল।

নীলাঞ্জন

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০০:০৬
কাজের মহিলাদের জীবন নিয়ে তৈরি শেখর দাশ-এর ছবি ‘নয়নচাঁপার দিনরাত্রি’র দৃশ্য।

কাজের মহিলাদের জীবন নিয়ে তৈরি শেখর দাশ-এর ছবি ‘নয়নচাঁপার দিনরাত্রি’র দৃশ্য।

ইতিহাস বইয়েরও অনেক আগে কাজের মাসিই প্রথম আমাকে হিন্দু-মুসলিম ভেদ শেখায়। তখন আমাদের বাড়ির বৃদ্ধা দাই-মা কাজ ছেড়ে দিয়েছে। শেষ কয়েক বছর তার ছানি আর কামাইয়ের চোটে মা’কে বাসন মাজার ওভারটাইম করতে হত হামেশা। দিনের বেশির ভাগেই মা ডাঁই বাসন নিয়ে কুয়োপাড়গামী— এ ছিল চেনা দৃশ্য, আর ঠাকুমা প্রতি বার একই রকম দীর্ঘশ্বাস-সহ নতুন-নতুন প্রতিবেশীদের ধরে বলে চলেছেন, দাই-মা’টাও চলে গেল। একটা কাজের লোক পাচ্ছি না। ভাল কেউ থাকলে দেখো না। তবে দেখো বাপু, বুড়ি-টুড়ি যেন না হয়।

গুগ্লসম সার্চ এঞ্জিন হয়ে আমি খবর আনলাম, ‘আমার বন্ধু বুবাইদের বাড়িতে ফাতিমা কাজ করে, ওকে বলবে?’ খাবার টেবিলে এটা শুনতেই ঠাকুমা ‘রাম রাম’ করতে করতে খাবার ছেড়ে উঠে পড়ল। ছোটকাকা বলল, ‘মুসলমান রাখলে তো সমস্যাই ছিল না রে। বুবাইদের বাড়িতে রাখা গেলে আমাদের রাখা যাবে না কেন?’ এই নিরামিষ প্রশ্নটা মা’কে করতেই মা ঘ্যাসঘ্যাস করে বাঁধাকপি কাটতে কাটতে বলল, ‘বুবাইয়ের তো ঠাকুমা নেই, ওরা মুসলমান কাজের লোক রাখতে পারে। এখানে রাখলে ঠাকুমার অসুবিধা হবে।’ অসুবিধার বিস্তারিত জানতে চাইলে পাছে কে সি নাগ নিয়ে বসতে হয়, তাই টিফিনে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করলাম। বিনয় খুব গম্ভীর মুখে বলল, ‘আসলে মুসলমানরা তো আমাদের মতো করে মুরগি কাটে না। ওরা মুরগিকে পিছন থেকে জবাই করে, তাই সমস্যা।’ আমি ভ্রু কুঁচকে বিনয়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মুরগিকে পাছু থেকে কাটলে ঠাকুমার কী? ঠাকুমা তো পাঁঠা ছাড়া খায় না।’ টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়ে যাওয়ায় বিনয় উত্তর দেয়নি। শেষমেশ ক্লাস সেভেনে সিপাহি বিদ্রোহে গিয়ে বিষয়টা ফাইনালি জেনেছিলাম।

সেই থেকে কাজের মাসি সাক্ষাৎ উইকিপিডিয়া। জগতে যা কিছু অজানা, নিষিদ্ধ, স্পর্শকাতর, তা কাজের মাসিগত সূত্রে ঠিক জেনে নেব, এই বিশ্বাস আমার তদ্দিনে হয়ে গেছে। যেমন বোকার পরে হাঁদা বা গাধা ছাড়াও যে শব্দ বসতে পারে, সেটা ক্লাস থ্রি-তে সুমন সবাইকে বলবার আগেই তো আমি জানতাম। সৌজন্যে নন্দরানি। কালো কড়াই, বাড়িতে অতিরিক্ত অতিথি কিংবা উঠোন ধোওয়ার প্রস্তাবের সম্ভাবনা দেখলেই তিনি চার-অক্ষর পাঁচ-অক্ষর সহ গজগজ করতেন। এবং বলা বাহুল্য, আমার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হত। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো নন্দপিসিকে ‘পাতলি গলি’ বললেই তিনি খেপে যেতেন। পাড়ার মোড়ে এই ইনফরমেশনটি ছিল, এবং নন্দরানি মোড় পেরোতে না পেরোতেই পিছনে সমস্বরে ‘পাতলি গলি, পাতলি গলি’ চিৎকার। আর তার পর নন্দরানির শব্দবৃষ্টি শুরু। যারা চিৎকার করছে, তাদের পিতৃপুরুষেরা কোন গলি দিয়ে কার সঙ্গে গেলে কী বংশধর হওয়া সম্ভব, তার বিবরণ ওই সময় তিনি গড়গড় করে বলে যেতেন। এবং ওই গরু-মানুষ, কুকুর-মানুষ, ছাগল-মানুষ বংশধরদের বিবরণ শুনে আমার মনে হত, হাঁসজারুর সুকুমার রায়’কেই শুধু বাংলা সাহিত্য চিনল! নন্দপিসি রইলেন নিষ্ফলের হতাশের দলে।

ভোলার ঠাকুমা অবশ্য চূড়ান্ত হতাশ করলেন। সাত কুলে তাঁর ভোলা ছাড়া আর কেউ নেই, বাঁচেন দুটি মাত্র আশা নিয়ে। এক, ভোলা চাকরি করে তাঁকে বসে-বসে খাওয়াবে; আর দুই, তাঁর পেনশনটি সরকারি অফিস থেকে পাশ হবে। এখন, চার বাড়ি কাজ করে সরকারি পেনশন পাওয়া আর বিনোদ কাম্বলিকে অমিতাভ বচ্চন বানানো একই ব্যাপার। এটা পাড়ার বহু মানুষ তাঁকে বোঝাতে গিয়ে ঠকে ঠ হয়েছেন। কারণ, ভোলার ঠাকুমার অটল বিশ্বাস, অফিসের সেজোবাবু তাঁর কাছে যে ঘুষ চেয়েছে, সেটা ভোলা তাঁর হাতে পৌঁছে দিলেই তাঁর পেনশন ঠেকায় কে! ফলস্বরূপ গোটা মাস হাপিশ থাকা ভোলা মাসের শুরুর দিকে পাড়ার মোড়ে উদয় হত সেজোবাবুকে ভোলার ঠাকুমার টাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এ ভাবে দু’বছরে ভোলার ছেঁড়া জামা থেকে বাহারি শার্ট হল, বড়দার দেওয়া ফুলপ্যান্ট বদলে জিন্স হল, পেনশনটা টেনশনই রয়ে গেল। ইতিমধ্যে আমার প্রথম ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাতে গিয়ে বাবা ভোলার উদাহরণ টেনে, দালালচক্র, ডকুমেন্টের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাকে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন ব্যাংক ম্যানেজারকে কার্যত কথা বলতে না দিয়েই। আমিও ততোধিক উৎসাহিত হয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের উপকারিতা বিষয়ে ভোলার ঠাকুমার ক্লাস নিয়েছিলাম। তাতে ভোলার মা সব শুনেটুনে একগাল হেসে বলেছিলেন, ‘এ বারেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলব দাদাবাবু। এই তো গত হপ্তাতেই সেজোবাবু ভোলাকে মেজোবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়েছে, এ বার মেজোবাবুকে কিছু টাকা দিলেই পেনশনটা এসে যাবে, তখনই অ্যাকাউন্টটা খুলব...’

কৃষ্ণার ব্যাপারটা আবার শুরু থেকেই বিপ্লবসম্মত। প্রথমত, কাজের মাসি মানেই অমুকের মা, তমুকের পিসি— এই অভিন্ন নোমেনক্লেচারের ইতি ঘটল। উনি নাকি পড়াশুনো-জানা, অবস্থার ফেরে হ্যালির ধূমকেতুর মতো কাজের মাসির বৃত্তে তাঁর আবির্ভাব। কোনও এক ইঞ্জিনিয়ার-বাড়ি আর আমাদের বাড়িতে কাজ ধরেছেন, শুধু রান্না আর টুকটাক ঝাঁট দেবেন। আমরা সেই থেকে জানলাম যে, কৃষ্ণা নামের কেউ কলেজে না গিয়ে ও-কাজ করতে পারেন। প্রথম দিন মহিলা ঘড়ি আর পাওয়ার-চশমা পরে কাজ করতে ঢুকতেই বিশ্বসুদ্ধ লোক ট্যারা। ঠাকুমা দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘যত সব লপচপানি’, কৃষ্ণা আর কাউকে পাত্তা না দিয়ে চটি ফটফটিয়ে বাথরুম থেকে বেরোলেন। কাজের মাসি, সে কিনা বাথরুম ব্যবহার করছে! হিরোশিমা-উত্তর যুগে অভূতপূর্ব এই ঘটনাটা মা-কাকিমারা বিস্ফারিত নয়নে উঁকি মেরে দেখছেন আর আমি চোখ বুজে প্রাণপণে লপচপানি দিয়ে বাক্য গঠন করে চলেছি। সঙ্গে ভেবে চলেছি, আগেকার কাজের মাসিদের তো হিসু পেত না, তা হলে এঁর কেন? ইনি কি তা হলে পূর্বসূরিদের মতো থেকে থেকে ঠাকুমাকে ‘ক’টা বাজল গো মা’ বলবেন না? ফল হল সুদূরপ্রসারী। ঠাকুমা কাজের মাসিদের ১৫ মিনিট কমিয়ে সময় বলার পাপ থেকে মুক্ত হলেন। রান্না করার আর বাসন মাজার আলাদা লোক রাখার প্রস্তাব ঘরোয়া কনফারেন্সে গৃহীত হল, আর মা-কাকিমারা উঠোন পেরিয়ে বাথরুমে চটি পরে যাওয়ার রেওয়াজ চালু করলেন।

রাজীব আবার বলত, ওদের কাজের মেয়ে সাক্ষী রাজসাক্ষী হলেই বিপদ। সে নাকি হেব্বি বুদ্ধিমান। চিলেকোঠার ঘরের পাশে যে লুকিয়ে বিড়ি খাওয়া যায়, সেটা রাজীবের আগে তো সে-ই আবিষ্কার করে ফেলে, তার পর এক দিন দুজনে দুজনকে বিড়ি ধরাতে দেখে ফেলে। আমাদের শিউরে ওঠা মুখগুলোকে আশ্বস্ত করে রাজীব বলেছিল, কাজের লোক বিড়ি খাচ্ছে, এটাই নাকি বেশি শকিং, জানলে বাবা ছেড়ে কথা বলবে না, আর সে তো শুধু বিড়ি ধরিয়েছিল, টানে তো নি, সুতরাং সে বেঁচে যাবে। তবে সমস্যা হবে, যদি সেই কাজের মাসি, সোফার পিছনে রাখা বইগুলোর কথা বাবাকে বলে দেয়। বাবাকে বলার দরকার পড়েনি, কারণ রাজীবের সারা জীবন ধরে সঞ্চিত হলুদ বই সেই লক্ষ্মীমন্ত সাক্ষী কোনও সাক্ষী না রেখেই বেচে দেয়। রাজীবের দয়ার শরীর, গরিব মানুষের কথা ভেবে সে টুঁ শব্দটিও করেনি।

রতন অবশ্য এতটা মহান নয়। দীর্ঘ দিন সে তার বিস্কুট চুরির দায় তার কাজের মাসি পদ্মর ওপর চাপিয়ে এসেছে, এটা জেনে যে পদ্ম আঁচলের তলায় শুধু তেল আর বেসনই নিয়ে যায়। তদ্দিনে আমাদের এ দিকে সমস্যা বদলে গেছে। জবাপিসি হেব্বি বড়ি দিতে পারত, শুক্তোটাও করত ফাটাফাটি। তবে দাদু আবার কাজের লোকের হাতের খাওয়া পছন্দ করতেন না, তাই দাদুর রান্নাটা ছোটকাকিমাই রাঁধত। অবাক করা ব্যাপার, আমি ছোটকাকার বিয়ের সময় পষ্ট শুনেছি, ছোটকাকা বর সেজে ঠাকুমাকে বলেছিল ‘মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।’ দাদু সেই দাসীর খাবার খেতেন অবলীলায়।

কেউ দেখে শেখে, কেউ ঠেকে শেখে। ঘুমিয়ে আছে শাইনি আহুজা সব বাড়িরই অন্দরে— এই সত্যটা ঠাহর হয়েছিল পাশের বাড়ির পলাশদাদের বাড়ি দেখে। ছেলেবেলায় অবশ্য অতশত বুঝিনি, চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝে কমলার ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বেরিয়ে আসা দেখেছিলাম আর কানে এসেছিল ‘পেটে ডিম হয়েছে, নষ্ট মেয়ে’— ভাসা-ভাসা শব্দগুলো। বহু দিন পর্যন্ত ধারণা হয়েছিল, পলাশদারা বুঝি পোলট্রির ব্যবসা করে আর কমলা ডিমটা নষ্ট করে দিয়েছে।

তখনও বুঝিনি, চেনা বাঙালি পরিবারগুলোর মূল্যবোধের পরদাটা আস্তে আস্তে খসে পড়ছিল। সাড়ে পাঁচটার বনগাঁ লোকালে পিলপিল করে আসা মানুষগুলো ধীরে ধীরে ছুঁতে চাইছিল আমাদের। আমরাও বড় হচ্ছিলাম বা বড় হওয়ার ভান করছিলাম। শিশুশ্রমের রচনা মুখস্থ করতাম আর দেখতাম, ছোটকাকিমার ছেলেকে খাওয়াচ্ছে আমারও চেয়ে ছোট তানি। ভাইফোঁটাতে লাইন দিয়ে ফোঁটা নিতাম, তানি জমানো টাকা থেকে পেন গিফ্টও দিত। জুলজুল করে দেখতাম ওদের, ওদের ছেলেদের বেড়ে ওঠা, ব্যবসা করে দাঁড়িয়ে যাওয়া, ঝপ করে বাড়ি করে ফেলা, ভাল বিয়ে। বুকের ভিতরটা চিনচিন করত।

এমন এক টলোমলো সময়ে ঠাকুমা মৃত্যুশয্যায়। ডাক্তার বললেন, ‘আজকের রাতটা ভাইটাল, রোগীর সঙ্গে কেউ থাকলে ভাল হয়।’ থাকবে কে? বাবার হাই প্রেশার, ছোটকাকার ফিট আছে। তা ছাড়া ছেলে ছোট, আমার উচ্চ মাধ্যমিক। ফলত, ঠাকুমার সেবা করা, খাবার খাওয়ানো, জল দেওয়া— সব ছেড়ে আসতে হল আয়ার হাতে। অবস্থাটা নিঃশব্দে মেনে নিয়ে, মানে মেনে নিতে শিখলাম সে দিন। আসার সময় সবাই বলেও এলাম, রাতে দরকারে ফোন কোরো নাজনীন।

royalneil@gmail.com

rabibasariya anandabazar nayanchanpar dinratri nilanjan Shekhar Das pension Hiroshima
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy