কো য়ালিটি লাইফ, কোয়ালিটি টাইম।’ এটা বেশ কয়েক বার শুনলাম। ‘এখানে লোকে ফালতু অন্যের ব্যাপারে মাথা দেয় না। তার মানে এই নয় যে তারা কনসার্নড নয়। মেলামেশার ধরনটা আলাদা। জায়গাগুলো আলাদা। এরাও আড্ডা মারে। তবে রকে বসে নয়, পাবে। আই কোয়াইট লাইক দিস কান্ট্রি।’ হালকা তুষারপাতের মধ্যে ইস্ট মিডল্যান্ড এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম। বেরতেই জয়দীপ, আমার ছোটবেলার বন্ধু। ডাক্তার। দু’যুগেরও বেশি সময় গ্যাঁট হয়ে বসে আছে ইংল্যান্ডে। বহু বার বলেছে— আয় এক বার। সেই আসা হল শেষ পর্যন্ত। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঠান্ডায় জমে গেলেও মনের আর্টারিতে ভীষণ গরম রক্ত সার্কুলেট করছে টের পাচ্ছিলাম। গাড়ির ভেতরে হিটার চলছে। আরামের গরম। কলকাতার মতো অসহ্য প্যাচপেচে নয়। বলে বসলাম, ‘ইংল্যান্ডের কেসটা কী বল তো?’ তখন ওই সব কথা বলল। বিলিতি আদবকায়দা আর বড়লোকির আমি যে ভয়ানক বিরোধী সেটা জেনেও। ‘বাড়ি পরে যাব, আগে চল, তোকে ফিশ অ্যান্ড চিপ্স খাওয়াই।’
কয়েক দিনের মধ্যেই কতগুলো ব্যাপার বুঝে গেলাম। ট্রেন বা ট্যাক্সির ভয়ানক খরচ। তাই লোকে গাড়ি চালায়। কড়া ট্রাফিক আইন। লোকজন ভদ্র ভাবে চলে, ভদ্রতাই স্টাইল। মাসিমা প্রথম বার ছেলের কাছ থেকে দেশে ফিরে খুব গর্ব করে বলেছিলেন, ‘ওখানে সবাই জয়কে চেনে।’ প্রসঙ্গটা তুলতেই অট্টহাসি। ছোটখাটো রাস্তার ক্রসিংয়ে সবাই দাঁড়িয়ে যায় অন্য গাড়ি আসতে দেখলে। তার মানে হল, ‘আমার তাড়া নেই, তুমি যাও।’ আবার সেও দাঁড়িয়ে যায়, ‘পহলে আপ’ ইশারা করে। শেষ পর্যন্ত এক জনকে যেতেই হয়। যাওয়ার সময় কাচের মধ্য দিয়ে দেখা যায় সে হাত তুলল ছোট্ট করে। অর্থাৎ থ্যাংক ইউ। কেউ কাউকে চেনে না। এটাই রীতি। সবার হাত তোলা দেখে মাসিমার ওই ধারণা হয়েছিল। স্বাভাবিক। এই সব দেখতে দেখতে প্রাক্-স্বাধীনতা আমলের ঐতিহাসিক ব্রিটিশ নীচতার গল্পগুলো ভুলেই যাচ্ছিলাম।
লন্ডনের মতো নয়, লেস্টার মাঝারি মাপের শহর, প্রচুর এশিয়ান থাকে। তবে ঘিঞ্জি নয়। শহর থেকে বেরতে বেশি সময় লাগে না। বেরলেই বিউটিফুল কান্ট্রিসাইড, ঢেউ খেলানো সবুজ জমি। পাথরের দেওয়াল। সাদা কালো কটেজ। ঠিক যেমন নার্সারি রাইম্স-এর বইতে, ছোটবেলায়। বুঝতে পারছিলাম, ভেতরে ভেতরে একটা বিগলিত ভাব জেগে উঠছে আস্তে আস্তে। রান্নাঘরে প্লেট ধোবার সময়ে লিকুইড সাবানের গন্ধটা অবধি ভাল লাগছিল।
জয়দীপ হাসপাতালে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করে। যথেষ্ট চাপ আছে। টেনশনও। কিন্তু সেটা বুঝতে দেবে না। কাজে বা ব্যবহারে পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। পেশেন্ট অভিযোগ করলেই আইনের খড়্গ চকচক করে উঠবে। এটাকে ট্যাক্ল করা একটা আর্ট। নিজের ফেকলু বন্ধুকে সাধ্যমত বিলেত দেখানো, খুশি করার ইচ্ছেটা দেখে বার বার চমকে উঠছিলাম। ‘হ্যাঁ রে, স্টিম ইঞ্জিন দেখবি তো?’ বলে একটা স্বর্গীয় হাসি দিল। ওই সবে আমার দুর্বলতা আছে, জানে। ইংল্যান্ডে বহু জায়গায় হেরিটেজ ট্রেন চলে। কয়লার ধোঁয়া, স্টিমফাটা হুইস্ল, ক্র্যাংক শ্যাফ্টের আওয়াজ— দেশে তো আর পাওয়া যাবে না। রথলি বলে ছোট্ট একটা স্টেশনে যাওয়া হল। ছবির মতো ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম। টি-রুম, ঘড়ি। সময়মত চারখানা লাল রঙের কোচওয়ালা ট্রেন এল ভোঁস ভোঁস করে। আমাদের মতো গুটিকয় টুরিস্ট বাদ দিলে সবটাই যেন আইভরি মার্চেন্ট-এর সিনেমার একটা পিরিয়ড পিস। সত্তর বছরের নতুন ঝকঝকে কালো আইভ্যাট সিরিজ-এর ইঞ্জিন দাপটে এসে দাঁড়াল গম্ভীর ভাবে। গায়ে নিখুঁত লাইভারি। মোনোগ্রাম। নম্বর প্লেট চকচক করছে নীল আকাশের নীচে। একই নীলাকাশ নয়। অন্য মাটি জল এ দেশের। এক রাশ নিস্তব্ধতা ফেলে রেখে ট্রেন চলে যেতে কানের কাছে শুনলাম, ‘কী রে, বলেছিলাম না!’
একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। সম্পূর্ণ দাবিহীন, ভয়ানক বন্ধুবৎসলতার প্রতিদান দেওয়ার কোনও উপায় নেই আমার। প্যাকেট ভরা টোব্যাকো আর হাতে বানানো সিগারেটের ছোট্ট রোলার যন্ত্রটা অবধি দিয়ে গেছে আমাকে। সস্নেহে বলেওছে, ‘বেশি খাস না।’ বললাম, ‘আমি এ বার একটু নিজের মতো ঘুরি, বুঝলি?’ বলতেই বাজে ভদ্রতা না করে বলল, ‘পারফেক্ট। তোকে সিটি সেন্টারে নামিয়ে দিচ্ছি, খুব হ্যাপেনিং প্লেস। সারা দিন ঘুরঘুর কর, বিকেলে পিক আপ করে নেব। ডট চারটে। দেরি করিস না। আর এটা রাখ। স্যামন স্যান্ডউইচ। খাস কিন্তু।’ এই প্রথম বিলিতি রাজপথে আমি হেমন্তের গোস্টম্যান। অদ্ভুত একটা সাদা রোদ মেখে ভূতের মতোই আমি হাঁটতে লাগলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। জানি, এখানে কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামায় না, অকারণে। সময়ও নেই। কোয়ালিটি লাইফ। কোয়ালিটি টাইম। ঢুকে পড়লাম শপিং মলে। উপচে পড়ছে প্রাচুর্য। তবে কলকাতাতেও এমন আছে। তফাত হল, দেশের মলে কেমন যেন একটা বাটার মসালা মটর পনির মার্কা গন্ধ থাকে। এখানে যেন সবই আইভি আর ড্যাফোডিল। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে এসে নিজের সঙ্গে নিজেই একটা নির্লজ্জ আদিখ্যেতা করতে ভালই লাগছিল। খেলনার দোকানে ঢুকে ছোট্ট হেলিকপ্টার আর ড্রোন ওড়ানো দেখলাম। মিউজিক শপে ঢুকে লক্ষ করলাম স্ট্যানলি কুব্রিকের সিনেমার ডিভিডি’তে বিপুল ডিসকাউন্ট। মনিহারি দোকানে কোলগেট টুথপেস্টও পাওয়া যাচ্ছে। ‘পাউন্ড স্টোর’-এ সব কিছুর দাম এক পাউন্ড। এক জোড়া প্লাস্টিকের চটি কিনে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। খিদে পাচ্ছিল।
বিকেলবেলা ঠিক সময়ে যথাস্থানে দাঁড়ালাম। দেখি, রাস্তায় একটা লোক বসে আছে, ময়লা জামা, সামনে খালি কফির গ্লাস। কেউ কেউ পয়সা দিচ্ছে। এর পরেই একটা পুলিশ এল। বন্দুক, লাঠি কিছু নেই। ফুটফুটে গোলাপি চেহারা। বুঝতে পারলাম, ওকে উঠে যেতে বলছে, কিন্তু সে রাজি নয়। এতটুকু রাগারাগি না করে অনেক ক্ষণ ধরে তাকে বোঝানো চলল। এক সময় লোকটা উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে আমি পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওখানে ওর বসার গণতান্ত্রিক অধিকার নেই? তুলে দিলে কেন?’ এতটুকু রাগ না করে, গভীর মমতামাখা গলায় পুলিশ বলল, ‘এর পর সন্ধে হবে, ঠান্ডা পড়বে, ওর গরম জামা নেই, মরে যেতে পারে। পড়ে থাকবে, সকালে বাচ্চারা স্কুলে যাবে, এ সব দেখবে। সেটা কি ভাল?’ আমি কিছুই বলতে পারলাম না, একটু দূরে গিয়ে সিগারেট পাকাতে লাগলাম। ঠিক সময়ে জয়দীপের সবুজ ফোক্সওয়াগন প্যাসাট দেখতে পেলাম, টুক করে উঠে পড়লাম। দাঁড়ানোর ব্যাপারই নেই। গাড়ি স্টার্ট করেই মিউজিক সিস্টেম চালু করে দিল, হেমন্তর ভেলভেট গলা— ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’। আমি উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলাম ভিখিরির ব্যাপারটা। স্টিয়ারিং-এ আঙুলে তাল দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল, মুখটাও গম্ভীর। খেয়াল করলাম, ভিখিরি শব্দটা ব্যবহার করছে না, বলছে হোমলেস। সরকার এখনও এদের দায়িত্ব নিয়ে চলেছে। খাওয়াদাওয়া। রুম হিটিং। থাকার জায়গা। শহরের একটু বাইরে, খুপরি খুপরি ফ্ল্যাটবাড়ি। যার বড় ফ্যামিলি, বেশি বাচ্চাকাচ্চা, তার বড় ফ্ল্যাট। ট্র্যাফিক লাইটে থামলাম আমরা। গানটা শেষ হওয়ার আগেই থামিয়ে দিয়ে উত্তেজনায় ফেটে পড়ল জয়দীপ।
‘এরা কিস্যু করে না, জাস্ট নাথিং। ড্রাগ নেবে। ক্রাইম করবে। গভর্নমেন্ট আদর করে ফিডিং বট্লে ভরে দুদু খাওয়াবে। ব্রিটেনের আদরের সিটিজেন এরা, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, এই এত খরচ আসছে কোথা থেকে? রানির রাজকোষ? নো ম্যান, সেটা বহু দিনই ঢু-ঢু। আসছে আমাদের হার্ড আর্নড রাজকোষ থেকে। জানিস কত ট্যাক্স? আমরা নাকি হাই ইনকাম গ্রুপের লোক। দ্যাটস হোয়াই। দিস ইজ আনঅ্যাক্সেপ্টেড। দিস ইজ আনবেয়ারেব্ল। উফ, হোয়াট আ স্ট্রেঞ্জ কান্ট্রি!’
suvolama@gmail.com