Advertisement
E-Paper

সন্দাকফুর বাঙালি ভোটার

পাহাড়ের ছোট্ট গ্রাম সিরিখোলা। দু’দশকের বেশি সময় ধরে এই গ্রামে থাকেন শুভাশিস ও শর্মিষ্ঠা। কলকাতা থেকে যাওয়া বাঙালি দম্পতি। সেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। পাকা রাস্তা সবে হয়েছে। পাহাড়ের ছোট্ট গ্রাম সিরিখোলা। দু’দশকের বেশি সময় ধরে এই গ্রামে থাকেন শুভাশিস ও শর্মিষ্ঠা। কলকাতা থেকে যাওয়া বাঙালি দম্পতি। সেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। পাকা রাস্তা সবে হয়েছে।

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৯ ০৫:৪৮
স্বপ্নপূরণ: সিরিখোলায় নিজের বাড়ির সামনে ছেলে শোভরাজের সঙ্গে শুভাশিস সেনগুপ্ত

স্বপ্নপূরণ: সিরিখোলায় নিজের বাড়ির সামনে ছেলে শোভরাজের সঙ্গে শুভাশিস সেনগুপ্ত

দু’কিলোমিটার দূরে একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, সেখানে শুধু মাত্র শিশুদের পোলিয়ো ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। বড় জোর মাসান্তে এক বার খোলে। ২২ কিলোমিটার দূরে আর একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রধানত স্বাভাবিক প্রসবের জন্য। রামমাম হাইড্রাল প্রোজেক্টের কাছে একটা হাসপাতাল ছিল। গত বছর সেটা পুড়ে যায়। জানেন তো, খুবই লজ্জা করে ভাবতে যে এখানে একটা পশু চিকিৎসালয় আছে, কিন্তু মানুষের জন্য কিছু নেই,’’ গলায় ক্ষোভ শুভাশিস সেনগুপ্তের। দার্জিলিং জেলার বিজনবাড়ি ফুলবাজার ব্লকের একমাত্র আবাসিক বাঙালি ভোটার শুভাশিস সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী শর্মিষ্ঠা সেনগুপ্ত। দার্জিলিঙে এক মাস আগে ভোট হয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু শুভাশিসবাবুদের ট্রাজেডি এখনও বহমান। ভোট-উৎসবের দিনক্ষণে কী আসে যায়?

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে সিরিখোলা গ্রাম। সন্দাকফুর রাস্তায়। এক দিকে সবুজ পাহাড়, অন্য দিকে সিরিখোলা নদীর কোল ঘেঁষে সেনগুপ্ত দম্পতির গেস্ট হাউস।

শুভাশিস, শর্মিষ্ঠা দু’জনেই খাস কলকাতার ছেলে-মেয়ে। বছর বাইশ-পঁচিশ আগে দমদমের মতিঝিল কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্র শুভাশিস আর সরোজিনী নাইডু কলেজের ছাত্রী শর্মিষ্ঠার মধ্যে প্রেম শুরু পাহাড়কে ভালবেসে। দু’জনের ইচ্ছে একটাই। পাহাড়ে ঘর বাঁধতে হবে।

কলেজের পাট চুকিয়ে তড়িঘড়ি বিয়ে। বিয়ের পর শুভাশিস-শর্মিষ্ঠা চলে এলেন এখানে। কোথায় থাকবেন, কী খাবেন, কেমন করে চলবে সংসার— নবদম্পতির কাছে পুরোটাই অজানা। শুভাশিসের কাছে তখন মাত্র ২৫ হাজার টাকা আর তাঁর মায়ের কিছু জিনিস। তখন জীবনটা অ্যাডভেঞ্চার। ধীরে ধীরে বুঝলেন টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু হাল ছাড়লেন না।

প্রথমে তাঁরা আবাসিক হলেন। ভোটার কার্ড হল। তার পর জমি কিনে ধীরে ধীরে হল নিজেদের বাড়ি। ‘‘কিছুটা আমাদের ইচ্ছে, কষ্ট করার ক্ষমতা আর বাকিটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ। প্রথমে ছোট বাড়ি। তার পর ধীরে ধীরে বাড়ি আয়তনে বড় হয়েছে। ২০০৩ থেকে ছেলে শোভরাজের নামে গেস্ট হাউস চালু করেছি,’’ বললেন শুভাশিস।

শিলিগুড়ি থেকে সিরিখোলা পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ছ’ঘণ্টা। কিন্তু আড়াই বছর আগেও এই গ্রামে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা ছিল না। সিরিখোলা থেকে দু’কিলোমিটার দূরে সেপি গ্রাম পর্যন্তই গাড়ি আসত। তার পর হাঁটাই ভরসা। ২০১৬-তে সিরিখোলা পর্যন্ত রাস্তা পাকা হয়। একই সময় আসে বিদ্যুৎ। গ্রামে আলো ও রাস্তার জন্য গ্রামবাসীদের নিয়ে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন শুভাশিস। আলো-রাস্তা হলেও পানীয় জলের ব্যবস্থা এখনও হয়নি। পাহাড়ি মানুষেরা অভ্যস্ত ঝরনার জলেই। শুভাশিসরা পরিশোধিত পানীয় জলের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছেন।

এই ‘নেই’-এর জায়গা একমাত্র ভোটের সময় কেমন পাল্টে যায়। গমগম করে সরকারি আমলাদের যাতায়াতে। যখন গাড়ির রাস্তা ছিল না, তখন তাঁরা আসতেন ঘোড়ায়। ‘‘সরকারি লোকজন আমার এখানেই থাকেন। এ বছরও তাই হয়েছে।’’ আপনাকেই তাঁরা বেছে নেন কেন? বাঙালি বলে? ‘‘বোধহয় আমার গেস্ট হাউসের বৈধ কাগজপত্র আছে, ফুড লাইসেন্স আছে বলে। যা এখানকার অধিকাংশ হোটেল বা গেস্ট হাউসে নেই। তবে কোনও রাজনৈতিক পার্টির কাজের জন্য কোনও দিন গেস্ট হাউস দিইনি আর দেবও না,’’ জোরালো গলা শুভাশিসের।

পাহাড়ে ঘর বাঁধার পরে এক্কেবারে পাহাড়ি মানুষদের সঙ্গে মিলে মিশে যেতে চেয়েছিলেন শুভাশিস ও শর্মিষ্ঠা। ছেলে শোভরাজ ও মেয়ে শুভাঙ্গী বড় হতেই স্কুলের খোঁজ করে শুভাশিস দেখেন কাছাকাছি কোনও স্কুল নেই। যা দু’-একটা আছে, সেখানে বাড়ির মা-বৌদিরাই ছেলে-মেয়েদের পড়ান। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগের অনুমতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের ছাড়পত্র নিয়ে নিজেদের বাড়িতেই স্কুল খুলেছিলেন তাঁরা। প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয়, পরে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। সেই স্কুলে নিজের ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে পড়ত গ্রামের আরও কুড়ি জন শিশু।

পাকেচক্রে এক দিন বন্ধ করতে হল সেই স্কুল। কিন্তু নিজের ছেলে মেয়েকে এখনও বাড়িতেই পড়ান শুভাশিস-শর্মিষ্ঠারা। ছেলে-মেয়ে পরীক্ষা দেয় প্রাইভেটে।

পাহাড়ের মানুষেরা ফুটবল বেশ পছন্দ করে। বিশেষ করে মেয়েরা। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রামের ছেলে মেয়েদের নিয়ে একটা স্পোর্টস ক্লাবও করেছিলেন শুভাশিস। অনেক টুর্নামেন্ট জিতেছে তাঁর ক্লাব। কিন্তু তাঁর কথায় বিষণ্ণতা, ‘‘আমরা তো এখানে একা।’’

একা মানে? শুভাশিসদের আশপাশের মানুষেরা হয়তো বাংলাভাষী নন, কিন্তু বাংলার ভূমিপুত্র। পাহাড়ের এই হিন্দিভাষী মানুষগুলিকে তাই গোর্খা-বাঙালি বলতেই পারি। বাংলাতেই এঁদের জন্ম, বাস। কলকাতার শখের ট্রেকারদের কী যে হত গাইড বা পোর্টার হিসেবে এঁরা না থাকলে!

শহুরে বাঙালি অবশ্য শুভাশিসের এই প্রতিবেশীদের বাঙালি ভাবে না, ভাবে নেপালি। সেখানেই জন্ম বিচ্ছিন্নতাবোধের। রিম্বিক, সন্দাকফুর রাস্তায় তথাকথিত বাঙালির যতটা অধিকার, এই হিন্দিভাষী গোর্খা বাঙালিদেরও ততটাই। তাঁরাই এখানকার ভোটার।

বঙ্গসন্তান শুভাশিস তাঁদের পাশে এসেই দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবেশী হিসেবে, এলাকার একমাত্র বাঙালি ভোটার হিসেবে। মধ্যবিত্ত বাঙালির কূপমণ্ডুকতা ছেড়ে অক্লেশে বেরিয়ে এসেছেন অচেনা পাকদণ্ডীতে।

সেখানেই এই দম্পতির জয়!

Sandakphu Voter Bengali Couple
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy