Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

১৯৭৬। সোনাদা থেকে রোজ টয়ট্রেনে করে দার্জিলিংয়ে স্কুলে যাই। তখন কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ডেলি প্যাসেঞ্জারদের জন্য রোজ একটা টয়ট্রেন চলত। কার্শিয়াং‌ থেকে সকাল সাতটায় ছেড়ে দার্জিলিং পৌঁছত দশটায়, আবার বিকেল পাঁচটায় ছেড়ে রাত আটটায় কার্শিয়াং। সকালের ট্রেনের নাম ‘নাইন আপ’, বিকেলের ‘টেন ডাউন’।

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০০:০৮

আমার শৈশবের দার্জিলিংটা

১৯৭৬। সোনাদা থেকে রোজ টয়ট্রেনে করে দার্জিলিংয়ে স্কুলে যাই। তখন কার্শিয়াং থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ডেলি প্যাসেঞ্জারদের জন্য রোজ একটা টয়ট্রেন চলত। কার্শিয়াং‌ থেকে সকাল সাতটায় ছেড়ে দার্জিলিং পৌঁছত দশটায়, আবার বিকেল পাঁচটায় ছেড়ে রাত আটটায় কার্শিয়াং। সকালের ট্রেনের নাম ‘নাইন আপ’, বিকেলের ‘টেন ডাউন’। কার্শিয়াং-টুং-দিলারাম-সোনাদা-জোরখোলা-রংবুল-জোরবাংলো-ঘুম, সব জায়গার অফিসযাত্রী, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা এই ট্রেনে দার্জিলিং যেত-আসত। আমিও সকাল সাড়ে আটটায় সোনাদাতে ট্রেন ধরতাম। কখনও দেরি হয়ে যেত। ট্রেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেছে, ছুটতে ছুটতে ড্রাইভারকে হাত দেখাতে পারলেই হল। ট্রেন স্লো হয়ে যেত, উঠে পড়তাম। তিন কামরার ট্রেন, শনিবার বাদে ঠাসা ভিড়। আমরা কচিকাঁচারা অফিসযাত্রী কাকা-মামা-মাসিদের কোলে বসে চলে যেতাম। ওঁরা কিছুতেই দাঁড়াতে দিতেন না। মান্থলি টিকিট ছিল চোদ্দো টাকা। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে রোজ নানান রূপে দেখতে দেখতে যাওয়ার স্মৃতি এখনও তাজা। টয়ট্রেন ছাড়া ছিল ব্রিটিশ আমলের লেফ্‌ট-হ্যান্ড ড্রাইভ উইলিস জিপ আর ল্যান্ডরোভার। ’৭৮-এ চালু হল নাকহীন বিচ্ছিরি-দেখতে মিনিবাস। স্থানীয় মানুষ নাম দিলেন ‘লক্‌জরি’ (লাক্সারি) বাস। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ের দূরত্ব দশ ঘণ্টা থেকে কমে চার ঘণ্টা হল, টয়ট্রেনেরও কদর কমতে থাকল।

এক দিন হঠাৎ রংবুলের কাছে সকালের ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। নেমে দেখি, ইঞ্জিনটা লাইন থেকে বেরিয়ে এসেছে। কী হবে! স্কুলে কি আজ আর যেতে পারব, না কি হেঁটে বাড়ি রওনা দেব? হেঁটে যাতায়াতের অভ্যেস ছিল। কোনও কারণে স্কুল হঠাৎ ছুটি হয়ে গেলে আমরা হেঁটেই ফিরতাম। দার্জিলিং থেকে সোনাদা হেঁটে তিন ঘণ্টা, সঙ্গী কেউ থাকলে দৌড়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চার ঘণ্টাও লেগে যেত।

ট্রেনে দুজন ড্রাইভার ছাড়াও প্রতি কামরায় এক জন করে লোক থাকত। ট্রেন যখন চড়াইয়ে উঠত, ওরা ইঞ্জিনের সামনে বসে রেললাইনে বালি ছড়াত, যাতে ইঞ্জিন লাইন থেকে হড়কে পেছন দিকে চলতে শুরু না করে। ট্রেন উতরাইয়ে নামার সময় ওরা আবার প্রত্যেক কামরার পিছনে ব্রেক হ্যান্ডেলের ওপর দাঁড়িয়ে ঢালু পথে কামরার গতি নিয়ন্ত্রণ করত, নইলে সেগুলো গতিজাড্যে ইঞ্জিনকে রামঠেলা দিয়ে বসলে বিপদ। শীত-বর্ষা সব সময় তারা ইঞ্জিনের সামনে বা কামরার পিছনে দাঁড়িয়ে এই কাজ করত, দেখতাম।

গাড়ি-রাস্তাকে কখনও এক পাশে রেখে, কখনও তারই
বুক চিরে ছুটত টয়ট্রেন। পাহাড়ি পথের প্রিয় বন্ধু।

ইঞ্জিন লাইন থেকে নেমে যেতে, যাত্রীদের মধ্যে মাতব্বর-গোছের কেউ কেউ ড্রাইভারদের সঙ্গে পরামর্শ করছিল। তাদেরই ক’জন খুঁজেপেতে একটা বড় কাঠের গুঁড়ি নিয়ে এল। সে সময় টয়ট্রেনের ইঞ্জিনের দু’পাশে দুটো ক্ল্যাম্পে দুটো লম্বা শাল-বল্লা রাখা থাকত। ক’জন মিলে সেই দুটোকে নামাল। কাঠের গুঁড়ি আর শাল-বল্লা দিয়ে তৈরি হল লিভার, আর তাই দিয়ে ড্রাইভার আর যাত্রীরা মিলে হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে মিনিট পনেরোর মধ্যেই ইঞ্জিনকে ফের লাইনে তুলে দিল। স্কুল পৌঁছতে সে দিন আধ ঘণ্টা দেরি হয়েছিল, ক্যাপ্টেন গম্ভীর বেত হাতে গেটের সামনে। অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে দেরির কারণ বললাম। মুখ দেখে হয়তো বিশ্বাস হল, পিঠে আলতো একটা বেতের বাড়ি মেরে রাস্তা ছেড়ে দিল।

দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে তখন ‘এ’ সেকশনে বাংলা আর ‘বি’ সেকশনে নেপালি মিডিয়ামে পড়ানো হত। বাংলা মিডিয়ামে হাতে গোনা দার্জিলিংয়ের স্থায়ী বাঙালি বাসিন্দাদের ছেলেরা পড়ত। বেশির ভাগ ছাত্রই বদলি হয়ে আসা সরকারি চাকুরেদের ছেলে। তাই ঘন ঘন বন্ধুবিচ্ছেদ হত। ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। প্রত্যেকের সঙ্গে অল্প দিনেই বেশ গভীর সম্পর্ক তৈরি হত। বাঙালি-নেপালি মাস্টারমশাইরা মিলেমিশে সব সেকশনেই ক্লাস নিতেন। চারটেয় স্কুল ছুটি, ট্রেন পাঁচটায়। এই এক ঘণ্টা আমরা, নানা স্কুলের ডেলি-প্যাসেঞ্জার ছেলেমেয়েরা, স্টেশনের পাশে লোকো শেডে রাখা ইঞ্জিন আর কামরাগুলোর মধ্যে লুকোচুরি খেলতাম। সে-সময়ের দেখা ৭৮০ নম্বর ইঞ্জিনটা বোধহয় এখনও চালু আছে। কখনও চলে যেতাম অল্প দূরে, এখন ইতিহাস হয়ে-যাওয়া ভিক্টোরিয়া ফল্‌স-এর ধারে।

এক দিন ছুটির পর দেখি, চকবাজারের কাছে রাস্তায়, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক জন লোক মাইকে বক্তৃতা দিচ্ছেন, হিন্দিতে। এগিয়ে দেখি, আরে, এ তো জ্যোতি বসু! খবরকাগজে ছবি দেখেছি আগেই, চিনতে অসুবিধে হয়নি। কী শুনেছিলাম মনে নেই। হয়তো কিছুই শুনিনি, ক’হাত দূরত্বে দাঁড়ানো এক জন বিখ্যাত লোককে দেখেছিলাম শুধু। তখন সিপিএম-এর উত্থান-কাল। পাহাড়ে বেশ মিটিং-মিছিল হত। আনন্দ পাঠক থাকতেন সোনাদার ভালুটার গ্রামে। তাঁর স্ত্রীকে দেখতাম বাজারে পাইকার মহাজনের কাছে বাড়ির দুধ পৌঁছে দিতে যেতে। আনন্দ পাঠককে সবাই ‘পাঠক বাজে’ বলত। নেপালি ভাষায় সম্মাননীয় মানুষকে ‘বাজে’ সম্বোধন করা হয়। এর আর এক অর্থ ‘দাদু’। ব্রাহ্মণদের সবাইকেও ‘বাজে’ ডাকা হত। আনন্দ পাঠক ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাই তিনিও ‘বাজে’।

এক দিন স্কুলে যেতে শুনি, আজ মিছিলে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী চকবাজারে সভা করতে আসবেন। দার্জিলিংয়ের সব স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করে এসেছিল। ইন্দিরা গাঁধী কী বলেছিলেন, মনে নেই। শুধু মনে আছে, সভার শেষে বললেন, ‘জোরসে বোলো, জয় হিন্দ!’ আমরাও চেঁচিয়ে উঠলাম, জয় হিন্দ! মন পড়ে ছিল কখন সভা শেষ হবে, আর পড়ে-পাওয়া ছুটির মজা লুটতে চলে যাব ম্যাল-এর পেছনের রাস্তায়। চারটে গরম গরম মোমো, আট আনা প্লেট।

জাতীশ্বর ভারতী, শিয়ালপাড়া, জলপাইগুড়ি

সৎতরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

বনহুগলি ইকো অ্যাডভেঞ্চার গ্রুপ বানিয়ে ফেলল ‘ভার্চুয়াল মাউন্টেনিয়ারিং স্টুডিয়ো’। তাদের বক্তব্য: পর্বতাভিযানে খরচ, দুর্ঘটনা, মৃত্যু, দূষণ ভীষণ ভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষত গত দশ বছরের লাগাতার ভূমিকম্পে খোয়া গেছে অসংখ্য অভিযাত্রীর প্রাণ। বারে বারে এসেছে তুষারঝড়, ধ্বংস হয়েছে বিভিন্ন বেসক্যাম্প। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযান বন্ধ থেকেছে দীর্ঘ কাল। এই সব সমস্যার সমাধান ভার্চুয়াল স্টুডিয়ো। গ্রুপের কর্ণধার রুদ্র সাহা বলেছেন, স্টুডিয়োতে বাস্তবের মতোই কঠোর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে অভিযাত্রীকে শৃঙ্গে পৌঁছতে হবে। ফলে অভিযানের রোমাঞ্চ কমবে না। গিনেস বুকও এই অভিযানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পুরো ব্যবস্থার পেটেন্টও তাঁরা পেয়ে গেছেন। তবে, প্রথম পর্যায়ে কেবল এভারেস্ট অভিযানই চলবে, পরে আল্পস‌ ও কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানেরও ব্যবস্থা হবে। আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে পালটাতে থাকবে স্টুডিয়োর পর্বতগাত্র। ঠিক এভারেস্টে ওঠার মতো। তেমনই উচ্চতার পরিবর্তনের সঙ্গে বদলাবে আবহাওয়াও। এভারেস্টের আবহাওয়া যে দিন যেমন থাকবে, স্টুডিয়োর পরিবেশও তেমন করে পালটাবে। বায়ুপ্রবাহের বেগ, বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত সংক্রান্ত তথ্য তৎক্ষণাৎ পাওয়ার জন্য এভারেস্টের পথে বিভিন্ন স্থানে সেন্সর বসানো হয়েছে। ওঠার সময় যদি অভিযাত্রী পড়ে যান, তবে সেই ‘ফল’ ২০০ মিটারের মধ্যে ‘অ্যারেস্ট’ (সামলে নেওয়া) করতে না পারলে, ভিডিয়ো গেমের মতোই গেম ওভার (যাত্রা শেষ) হয়ে যাবে। আবার প্রথম থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু খরচ অনেক কমে যাবে এবং জীবনের ঝুঁকি শূন্য, সেহেতু ভার্চুয়াল ক্লাইম্বিং জনপ্রিয় হবেই। অনেকেই আসবেন শুধু এভারেস্টে বেড়াতে। গ্রুপটি নিয়মিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এই স্টুডিয়ো বানিয়ে দেওয়ার বায়না পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের শিল্পে জোয়ার আনবে এই স্টুডিয়ো।

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

sunday magazine darjeeling toy train siliguri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy