মুকুট খসে গেল সুন্দরবনের। বাঘশুমারিতে দেখা গেল, সুন্দরবনে আর একটিও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বেঁচে নেই। অতএব ফলে গেল কয়েক যুগ আগে করা বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী। সত্যিই এ বার থেকে শুধু ছবিতেই বাঘ দেখতে হবে। ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন— ‘বামফ্রন্ট সরকারের চৌত্রিশ বছরের কুশাসনের ফল বেচারা বাঘেদের প্রাণ দিয়ে চোকাতে হল। সেই জমানাতেই তো বাঘেদের মৃত্যুমিছিল শুরু।’ পরিবেশবিদ এবং পশুপ্রেমীরা অন্য পশুদের বাঁচাবার জন্য সুন্দরবনকে ২০ ফুট পাঁচিল দিয়ে ঘেরার কথা ভেবেছেন। কিন্তু সুন্দরবনে যাঁরা কাঠ-মধু সংগ্রহ করেন, তাঁরা অনশনে বসেছেন। তাঁদের দাবি, এতে তাঁদের জীবিকায় প্রচুর অসুবিধে হবে, তাই সুন্দরবনকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরলে তাঁদের পরিবারের এক জনকে চাকরি দিতেই হবে। অন্য দিকে, চিড়িয়াখানাগুলোর বৃদ্ধ বাঘেদের দেখার জন্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করছে। টিকিটের দাম এক লাফে দ্বিগুণ করা হয়েছে, তবু কমছে না ভিড়। পরিবেশমন্ত্রী কর্মীদের বলেছেন, ‘চিড়িয়াখানার বাঘগুলোকে ভাল করে যত্ন নিন। যত দিন সম্ভব টেনে বাড়ান তাদের আয়ু। তাদের বংশবৃদ্ধির চেষ্টা করুন। যত টাকা লাগে দেবে কেন্দ্রীয় সরকার।’ আপাতত সুন্দরবনের নানা জায়গায় মোমের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বসানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এই কথা শুনে, যে সব শিল্পী এতদিন মোমের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, উত্তম, সুচিত্রা গড়ছিলেন, তাঁরা আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন। মোমের বাঘগুিলকে পাহারা দেওয়ার জন্য বিশেষ বন্দুকধারী বাহিনী প্রয়োজন হবে, তাই বহু যুবকের চাকরি হবে। অন্য দিকে, কিছু কিছু সংগঠন চোরাশিকারিদের ভবিষ্যৎ নিয়েও খুব চিন্তিত। তাঁরা ফেক প্রোফাইল বানিয়ে টুইট করে চলেছেন, বর্তমান সরকার চোরাশিকারিদের কথাটাও এক বার ভেবে দেখুক। তাদের ছেলেপিলেরা খাবে কী?
সউদ আলি মোল্লা, মেটিয়াবুরুজ
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
এক দশকে দু-দুটো যুদ্ধ
১৯৬২। চিন-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ না বলে একতরফা আত্মরক্ষার চেষ্টা বলা যায়। বাবা মিলিটারি ডিপার্টমেন্টে অডিটর পোস্টে কাজ করতেন। শিলং-এর আর্মি ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টার্সে আমরা থাকতাম। আর্মি ডিপার্টমেন্টে কাজ বলে বাবা যুদ্ধের খবরাখবর সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারতেন। যুদ্ধ কী, তা আমরা জানতাম না, তাই যুদ্ধ শুরু হতে আমরা নতুন উত্তেজনায় ফুটছি। ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে ভাবছি, যুদ্ধ তো হচ্ছে সেই কোন হিমালয়ের কোলে, আমাদের কীসের ভয়?
কিন্তু ভয় আমরাও পেলাম, যে দিন বাবা অফিস থেকে ফিরে মা’কে বললেন, ‘খবর ভাল না। তুমি তোমার আর ছেলেমেয়েদের খুব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো, আর ওদের রেজাল্ট কার্ড গুছিয়ে হাতের কাছে রাখো।’ কেন, জিজ্ঞেস করতে বাবা বললেন, চিন যে রকম দ্রুত এগিয়ে আসছে, তাতে সকলেই ভয় পাচ্ছে। তেজপুরের পরেই রঙ্গিয়া স্টেশন। রঙ্গিয়া দখল করে নিলে মেঘালয়, অরুণাচল, অসম, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মানে গোটা পূর্বাঞ্চলটা ভারতের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তখন অবশ্য মেঘালয় অসমের মধ্যেই ছিল, খাসি জয়ন্তিয়া অঞ্চল নামে। এই সব শুনে আমাদের যুদ্ধের উত্তেজনা আশংকায় পরিণত হল। বাবা আরও বললেন, যে কোনও মুহূর্তে হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে এক ঘণ্টার মধ্যে জিনিসপত্র গুছিয়ে পুরো পরিবারকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসার জন্য নির্দিষ্ট প্লেনে উঠতে হতে পারে। আমরা বলে উঠলাম, বাবা, তুমি থাকবে না সেখানে? বাবা বললেন, ‘না, তোমাদের রেখে আমাকে ফিরতে হবে শিলংয়ে।’
পর দিন বাবা অফিসে গেলে, মা’কে দেখলাম, আমাদের জামাকাপড়ের সঙ্গে মায়ের ‘ঊষা’
সেলাই-মেশিনের ওপরের অংশটা গোছাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করতে বললেন, জানি না ভাগ্যে কী আছে। সেলাই-মেশিনটা থাকলে অন্তত নুন-ভাতের জোগাড়টুকু যদি করতে পারি। বুঝলাম, মা সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার কথাটাই ভাবছেন। আরও ভয় পেয়ে গেলাম। সন্ধেবেলা বাবা একটু দেরি করে, থমথমে মুখে ফিরলেন। বললেন, ‘আমাদের টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ডিউটি ডিক্লেয়ার হয়েছে। আমি তোমাদের কথা ভেবে চলে এসেছি। জানি না কখন এসে আবার ডেকে নিয়ে যাবে। ভয় পেয়ো না তোমরা।’ বাবার আশংকাই সত্যি হল। রাত দুটোর সময় মিলিটারি জিপ এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে গেল। বাবা সিভিলিয়ান কর্মী হওয়া সত্ত্বেও ইমার্জেন্সির সময় আর্মির অনেক অফিশিয়াল কাজও করতে হত। মা’কে বলে গেলেন, ‘দু-এক দিন বোধহয় আসতে পারব না। রেডিয়ো শুনো, যুদ্ধের খবর পাবে।’
তেজপুর, ১৯৬২। চিন-ভারত যুদ্ধের আবহে নিরাপদ ঠিকানার সন্ধানে মানুষের যাত্রা।
আমাদের দিন কাটতে লাগল এক অবর্ণনীয় অবস্থায়। দু’দিন বাদে বাবা মিলিটারি জিপে করে এসে এক ঘণ্টা বাড়িতে থেকে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, ‘চিন তেজপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। রঙ্গিয়া অবধি আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। জানি না কী হবে। সব কিছুর জন্য তৈরি থেকো।’ মা, দাদা, দিদি, আমি খাওয়াদাওয়া ভুলে রেডিয়োয় খবর শুনছি শুধু। ঘুমোতামও না। তার পর, উদ্বেগের চরম সীমায় যখন, সেই খবরটা এল। আকাশবাণীতে ঘোষণা— চিন তেজপুরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। মানে, রঙ্গিয়া স্টেশনের দিকে আর এগোচ্ছে না। আমরা সব্বাই মা’কে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এই আনন্দের মধ্যেও বাবার মনে পড়ল এক মিলিটারি বন্ধুর কথা, যুদ্ধ ঘোষণার দিনেই মেয়ের প্রথম জন্মদিনের উৎসব ছেড়ে যাকে তেজপুর ফ্রন্টে যুদ্ধে যেতে হয়েছিল চোখের জল মুছতে মুছতে। অনেক বছর পর একটা ছবি দেখেছিলাম, ‘বর্ডার’। সেখানে সুনীল শেট্টিকে যেমন তুলে নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সে রকম ভাবেই। তখন ফোন-টোনের প্রশ্নই নেই, তাই যুদ্ধে যাওয়ার পর ওই কাকুর সঙ্গে কাকিমার কোনও যোগাযোগ হয়নি। আমি ভাবছিলাম, কাকিমাও নিশ্চয়ই আনন্দে তাঁর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছেন!
১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আর এক অভিজ্ঞতা। বাবা শিলং থেকে বদলি হয়ে এলেন বর্ধমানের পানাগড় মিলিটারি
বেস-এ। বেস-এর এক প্রান্তে আমাদের কোয়ার্টার্স। এর পরেই বিশাল কাশবন, তার পর কাঁটাতার, কাঁটাতারের ও-পারে গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। দিনরাত গাড়ি যেত-আসত। আমাদের এলাকার নাম ছিল কেরেন লাইন। লক্ষ্মীপুজোর আগে-পরে এক রাতে কেরেন লাইনের অনেকের চোখে পড়ল, আকাশ থেকে ছোট-ছোট, কালো-কালো কী যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কাশবনের মধ্যে নামছে। এক জন বলে উঠল, কাশবনের ডান দিকে ভেহিকেল ডিপোতে আর্মির পেট্রল-ডিজেল স্টোর আছে। ওই কালো জিনিসগুলো প্যারাশুট নয় তো? স্টোর জ্বালাবে বলে পাক সেনারা নামছে না তো? ব্যস, আমার বাবা, পাড়ার কাকু-জেঠুরা ছুটলেন হেডকোয়ার্টার্সে খবর দিতে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ছেলেছোঁড়ারাও ছুটল কাশবনের দিকে, একটু পরে উত্তেজিত ভাবে বেরিয়েও এল। মা-কাকিমারা ছুটে গেলেন— কী? কী হয়েছে? ওরা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, সবাই ঘরে চলুন, নইলে বলব না। আমরা ফিরে এলাম। জানা গেল, কাশবনের মধ্যে এলাকার অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা প্রেম করছিল। আমাদের ঘরে ফেরানোর অছিলায় পাড়ার ছেলেরা আসলে ওদের নির্বিঘ্নে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছিল! ও-দিকে বাবা-কাকারা ফিরতে জানা গেল, রেডারে দেখা গেলেও কোনও প্যারাশুট খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু, ভেহিকেল ডিপোর কাছে সত্যিই দুজন শত্রু-সেনাকে ধরা হয়েছে!
যুদ্ধের দামামার মধ্যে এক দিকে তৈরি হচ্ছিল নাশকতার পরিকল্পনা, আর এক দিকে ভবিষ্যতের, ঘর-বাঁধার প্রস্তুতিও। জীবনযুদ্ধের কী বিচিত্র সহাবস্থান!
গীতা বিশ্বাস, মাঝিপাড়া রোড, ঠাকুরপুকুর
ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy