Advertisement
E-Paper

একটা শটেও বেসুরো নন

এক জন অভিনেতার কি কোনও এক জন প্রিয় অভিনেতা থাকতে পারে? বা থাকাটা কি আদৌ স্বাস্থ্যকর? এক জন অভিনেতা তো প্রাথমিক ভাবে অভিনয়ের ছাত্রও। এবং বিশ্বচলচ্চিত্রে শিক্ষকের যে বিশাল সম্ভার, তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে মাত্র এক জনের কাছে নাড়া-বাঁধা কি নিজেকে বঞ্চিত করা নয়? তবু মাথাটা সুস্থির করে একটু ভাবলে, একটা নাম হারিয়ে-যাওয়া রাংতার খেলনার মতো চকচক করে ওঠে বার বার। ডাস্টিন হফম্যান।

অরুণোদয়

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩

এক জন অভিনেতার কি কোনও এক জন প্রিয় অভিনেতা থাকতে পারে? বা থাকাটা কি আদৌ স্বাস্থ্যকর? এক জন অভিনেতা তো প্রাথমিক ভাবে অভিনয়ের ছাত্রও। এবং বিশ্বচলচ্চিত্রে শিক্ষকের যে বিশাল সম্ভার, তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে মাত্র এক জনের কাছে নাড়া-বাঁধা কি নিজেকে বঞ্চিত করা নয়? তবু মাথাটা সুস্থির করে একটু ভাবলে, একটা নাম হারিয়ে-যাওয়া রাংতার খেলনার মতো চকচক করে ওঠে বার বার। ডাস্টিন হফম্যান।
হফম্যানের কাছাকাছি সময়েরই অন্তত পাঁচ জন অভিনেতা আছেন, আমি যাঁদের প্রবল ভক্ত। আল পাচিনো, রবার্ট ডি নিরো, জ্যাক নিকলসন, অ্যান্থনি হপকিন‌্স, মর্গ্যান ফ্রিম্যান। মাইকেল কেন-কেই বা বাদ দিই কী করে? কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন হফম্যান। ‘মিডনাইট কাউবয়’ ছবিতে হফম্যান অভিনয় করেন এক জন এড্স-আক্রান্ত সমকামী যৌনকর্মীর ভূমিকায়। কতগুলো জিনিস মাথায় রেখে অভিনয়টা করতে হয়েছে ভাবুন! এড্স-রোগের ক্ষয়, সমকামের আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক লজ্জা, পেশাদার যৌনকর্মী হওয়ার বিষাদ ও সামাজিক অপমান, এবং সব মিলিয়ে এক জন পরাজিত, মার-খাওয়া, লাথি-খাওয়া লোকের নিঃসঙ্গতা। একটা দৃশ্য, একটা শটও দেখানো যাবে না, যেখানে হফম্যান বেসুরে বেজেছেন।
আমার ডেবিউ, মানে সিনেমায় আমার প্রথম অভিনয়টাই, খুব হইচই ফেলে দিয়েছিল। অনেকে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ দেখে বলেছিলেন, একদম গোড়াতেই এ রকম অভিনয় দেখাই যায় না। তাঁরা কেউ সম্ভবত ‘গ্র্যাজুয়েট’ দেখেননি। সারা পৃথিবীতে প্রথম অভিনয়েই যে রথী-মহারথীরা হইচই ফেলে দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রথম সারিতেই আছেন ডাস্টিন হফম্যান। ‘গ্র্যাজুয়েট’-এ কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভূমিকায় তিনিই। একটি ইয়াং ছেলে। তার নিজের থেকে অনেক বড় এক মহিলার সঙ্গে ও সেই মহিলারই সৎমেয়ের সঙ্গে প্রেমের মাঝখানে পড়ে যাওয়ার দ্বন্দ্ব নিয়ে বানানো ছবিটি। ডেবিউ-তেই বোঝা গিয়েছিল, এখানে শুধু অভিনয় হচ্ছে না, কিংবদন্তির জন্ম হচ্ছে!
‘স্ট্র ডগ্স’ আর একটা ছবি, যা আমাকে ঘাবড়ে দিয়েছিল প্রচণ্ড। এটা কী? এটা অভিনয় হলে আমি যেটা করি, সেটা কী? ‘স্ট্র ডগ্স’-এর শেষ দৃশ্যে ডাস্টিন হফ্ম্যানের অভিনয় থেকে অনেকটাই প্রভাবিত ‘নায়কন’-এ কমল হসনের পুলিশকে মারার অভিনয়টি। কমল হসনের হফম্যান-প্রভাব এখানেই শেষ নয়। ‘চাচি ৪২০’ ছবিটা হলিউডের ‘মিসেস ডাউটফায়ার’ থেকে নেওয়া হলেও, অভিনয়টা কিন্তু সেই ছবির নায়ক রবিন উইলিয়ামস-এর থেকে কমল ধার করেননি। বরং করেছেন ‘টুটসি’-র নায়ক ডাস্টিন হফম্যানের থেকে (সে কথা কমল নিজেই বলেছেন)। রবিন উইলিয়ামসও ‘ডাউটফায়ার’-এ মেয়ে সেজে অভিনয় করেছিলেন, ‘টুটসি’-তে ডাস্টিন হফম্যানও তা-ই। কিন্তু রবিনের ছবির গল্পটা থেকে ধার করে ছবি বানালেও, অভিনয়ের বেলায় কমল গেলেন অন্য ছবির ডাস্টিনের কাছে, কারণ মেয়ে সাজা মানে শুধু সাজপোশাক আর মেকআপ নয়, একটা মেয়ের তাবৎ বডি ল্যাংগোয়েজ, এমনকী তাকানো পর্যন্ত নিজের মধ্যে এনে ফেলা, আবার পুরোপুরি এনে না ফেলতে পারার অস্বস্তিটাকেও অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলা। এই জিনিস পৃথিবীর খুব কম অভিনেতাই পারেন। আমার মতে, কমল হসনের ‘সোর্স’ বাছতে ভুল হয়নি।

ডাস্টিন হফ্ম্যান তাঁর প্রথম অস্কার-টি পান ‘ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার’ ছবির জন্য, যেটা থেকে হিন্দিতে ‘অকেলে হাম অকেলে তুম’ হয়েছিল। বুঝতেই পারছেন গল্পটা। ‘ক্রেমার’-এ আমাকে মুগ্ধ করে তিন জনই। কিন্তু অভিনয়ের রেটিং-এ, শিশুটিকে ধরা উচিত হবে না। কারণ, একটি শিশুর পবিত্রতা, ‘ইনোসেন্স’-এর সামনে পৃথিবীর কোনও অভিনয়ই দাঁড়াতে পারে না (‘সোনার কেল্লা’ দ্রষ্টব্য)। কিন্তু ছবিটায় ডাস্টিনের নায়িকা ছিলেন মেরিল স্ট্রিপ। এই পৃথিবীতে মেরিল স্ট্রিপের চেয়ে ভাল অভিনেত্রী এসেছেন বলে আমার জানা নেই। ফলে, ছবিটা জুড়ে স্বামী-স্ত্রী’র অশান্তি ও ছাড়াছাড়ি, সন্তানকে নিয়ে টানাটানি, এর যে লড়াই, তা শুধু প্লটের বা গল্পের বুনন নয়, যেন অভিনয়েরও দ্বৈরথ, সম্মুখসমর। এবং সেই যুদ্ধ এক মুহূর্তের জন্যও সিনেমার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে না, তাকে সমৃদ্ধই করে।

অভিনয়ের মাপকাঠি অস্কার পুরস্কার যে নয়, তা মানি। না হলে ‘মিডনাইট কাউবয়’ যে বছরে হফ্ম্যান করলেন, সে বছর জন ওয়েন যে কোন বি়জ্ঞানে ‘ট্রু গ্রিট’-এর জন্য অস্কার পান, তা আমার মাথায় ঢোকে না। আমার ছোট মাথা, সবটা না-ও ঢুকতে পারে।

‘রেন ম্যান’-এ হফ্ম্যান এক জন অটিস্টিক মানুষের চরিত্রে। অটিজ্ম মানে কিন্তু পাগলামো নয়, শুধু খানিকটা মেলোড্রামা আর চুলটুল ঝাঁকিয়ে হাত পা নেড়ে আবোলতাবোল বকে দিলেই হবে না, খুব জটিল এর অভিনয়। অসম্ভব পর্যবেক্ষণশক্তি আর প্রবল অভিনয়প্রতিভা না থাকলে এক অটিস্টিক চরিত্রের ভেতরে খোলনলচেসুদ্ধ ঢুকে পড়া প্রায় অসম্ভব। আমি প্রবল শাহরুখ-ভক্ত হয়েও এটা মেনে নিতে বাধ্য, এক অটিস্টিকের চরিত্রে ‘মাই নেম ইজ খান’-এর তাঁর অভিনয়, ধারাবাহিকতার নিরিখে হোঁচট খেয়েছে কখনওসখনও। হিন্দি ছবির নাচগানের জন্য যা হতে বাধ্যও হয়তো। কিন্তু ‘রেন ম্যান’! ‘এ যে দৃশ্য, দেখি অন্য’। হফম্যানের দ্বিতীয় অস্কারটি আসে এই ছবিতে অভিনয়ের জন্যই।

ওঁর করা স্মরণীয় অভিনয়ের তালিকা দিতে গেলে গোটা কাগজ ভরে যাবে। ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’-এ নিক্সন-এর দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূল দুই সাংবাদিকদের এক জন, ‘ওয়্যাগ দ্য ডগ’-এর হলিউড প্রোডিউসার, অথবা ‘স্ট্রেট টাইম্স’-এর সেই অপরাধী, যাকে সিস্টেম আবার অপরাধী বানিয়ে দিল! এর সব ক’টাই অভিনেতাদের ধর্মগ্রন্থ হওয়ার উচিত।

কিন্তু যেটা আমায় পাগল করে দেয়, সেটা টেলিভিশনের জন্য বানানো ‘ডেথ অব আ সেল্‌সম্যান’। এক জন পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর বয়সি লোক কী করে ওই পঁচাত্তর বছর বয়সি লোকের অভিনয়টা করেন? কী করে চলে যান বার বার ওই কল্পজগতে, যেখানে ওঁর দাদা দাঁড়িয়ে ওঁকে সুন্দরতর পৃথিবীর ডাক দিচ্ছে? মনে রাখতে হবে, ইনি কোনও শ্লথ বৃদ্ধ নন, এমন এক জন বৃদ্ধ যিনি প্রবল অশান্তিতে ভুগছেন। কারণ তাঁর ছেলে তাঁকে অন্য এক জনের সঙ্গে বিছানায় দেখে ফেলেছে। অনর্গল কথা বলে মানসিক সমস্যা ঢাকার চেষ্টা করে যিনি বার বার ধরা দিচ্ছেন। আমার কাছে এই ছবির ‘মেকিং’-টাও আছে। সেখানে অবাক হয়ে দেখি, শারীরিক ক্লান্তি (বয়সের ভার বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য) আয়ত্ত করতে, হফম্যান অনবরত সেট-এ ডন দিচ্ছেন। রোল, রোলিং, অ্যাকশন বলার পর ডন দিয়ে উঠে শট-এ যাচ্ছেন। এ কী সম্ভব? হয়তো। সেটা এক জনই বলতে পারতেন, যিনি তিরিশ বছর বয়সে ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে থরহরিকম্পমান বৃদ্ধের ভূমিকায় অভিনয় করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। রবি ঘোষ। সেটা আর এক দিন বলা যাবে।

rahuloday@gmail.com

dustin hoffman arunadoy dustin hoffman work dustin hoffman performance dustin hoffman influence dustin hoffman bollywood kamal hasan nayakan al pachino robert de niro morgan freeman anthony hopkins jack nikolson
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy