Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বাগদাদের মুদ্রায় ছিল শিবের ষাঁড় নন্দী

লম্বা চুল-দাড়ির জিশুখ্রিস্টকে পাওয়া যাচ্ছে রোমান দেবতাদের মতো শ্মশ্রুহীন রূপে। বিভিন্ন ধর্মের পুরোধা আর প্রতীকগুলি পালটে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। লম্বা চুল-দাড়ির জিশুখ্রিস্টকে পাওয়া যাচ্ছে রোমান দেবতাদের মতো শ্মশ্রুহীন রূপে। বিভিন্ন ধর্মের পুরোধা আর প্রতীকগুলি পালটে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

চরণরেখা: অমরাবতী স্তূপ থেকে পাওয়া বুদ্ধের পদচিহ্ন। বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত

চরণরেখা: অমরাবতী স্তূপ থেকে পাওয়া বুদ্ধের পদচিহ্ন। বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত

শ্রাবণী বসু
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

আধ বোজা চোখ, মাথায় চুল চুড়ো করে বাঁধা— ধ্যানী বুদ্ধের এই পরিচিত ছবিটি এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় ধর্মীয় অবয়ব। আজ অনেকের বৈঠকখানায় বুদ্ধের এই ধ্যানমগ্ন ছবি বা মূর্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর জন্মস্থান থেকে অনেকটাই দূরে যে জায়গা থেকে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি প্রথম পাওয়া যায় তা তৈরি হয়েছিল বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় পাঁচশো বছর পর।

গৌতম বুদ্ধ মারা গিয়েছিলেন খ্রিস্টের জন্মের চারশো বছর আগে! তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বাণী প্রচার করেছিলেন সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা। মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছে সেই বাণী। তখন লেখা হয়নি। লেখা হয় বহু পরে। বুদ্ধ মূর্তির আগে তাঁকে বোঝাতে কখনও দু’টো পায়ের পাতা, কখনও স্রেফ রাজছত্র চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম ও তৃতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশে অমরাবতী স্তূপের গায়ে যে খোদাইকার্য করা হয়েছিল তাতেও কিন্তু বুদ্ধদেবের কোনও মূর্তি পাওয়া যায়নি। সেখানেও তথাগতকে বোঝাতে পদচিহ্নই ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রায় সব ধর্মের প্রথম প্রবক্তাকে নিয়েই এ হেন রূপান্তর লক্ষণীয়। এই রূপান্তর কী ভাবে হয়েছে? এটাই ছিল অক্সফোর্ডের অ্যাসমোলিয়ান মিউজিয়ামে হয়ে যাওয়া ‘ইমাজিন দ্য ডিভাইন, আর্ট অ্যান্ড দ্য রাইজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস’ প্রদর্শনীটির বিষয়। যখন বিশ্ব জুড়ে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ বনাম মুসলমান, ইহুদি বনাম আরব এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ, তখন এই প্রদর্শনীর লক্ষ্য ছিল, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন ধর্মের, ধর্মীয় চিহ্নের তুলনামূলক আলোচনা। প্রদর্শনীতে দেখানো হল, বিভিন্ন ধর্মের আইকন বা চিহ্নগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে পালটে গিয়েছে।

এই যে বদল, তা কিন্তু এসেছে ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে দিয়েই। মানুষই তার রোজকার জীবনের মাধ্যমে এনেছে সেই পরিবর্তন। বহু বার মন্দির ভাঙা হয়েছে, ভাঙা হয়েছে গির্জা। আবার সেগুলো তৈরি করা হয়েছে। হয়তো আবার সেগুলো ভেঙেও ফেলা হয়েছে। একটা উদাহরণ তো এখন ভীষণ জীবন্ত। ১৫২৮-১৫২৯ সালের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় বাবরের নির্দেশে তৈরি হয়েছিল বাবরি মসজিদ। বির্তক, ওখানে আগে একটি রামমন্দির ছিল, যেটা ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবর। সেই আগুনে উত্তপ্ত হয়ে ১৯৯২-এ হিন্দুত্ববাদীরা ধূলিসাৎ করে বাবরি মসজিদ। এ দিকে আবার ২০০১-এ তালিবানরা আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি উড়িয়ে দেয়।

ইংল্যান্ডের এক অভিজাত বাড়ি থেকে প্রাপ্ত, রোমান দেবতার আদলে জিশুর মোজাইক

এই সব কাণ্ড শুধু পূর্বে নয়, পশ্চিমেও ঘটেছে। একটা সময় ইংল্যান্ডেও অনেক গির্জা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে, কারণ সেখানে কেউ প্রার্থনা করতে যেত না। কখনও কখনও বেশ কিছু পরিত্যক্ত গির্জা ভেঙে তৈরি হয়েছে ফ্ল্যাটবাড়ি। কখনও তৈরি হয়েছে পানশালা, কখনও বা হিন্দু মন্দিরও! কিন্তু এই অবস্থাটারও বদল এল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ড ও রোমানিয়া থেকে আসা বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসে। যাঁরা রবিবারে নিয়মিত গির্জায় প্রার্থনা করতে যেতেন। আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত গির্জাগুলো প্রাণ ফিরে পেল। সেজে উঠল বিয়ের অনুষ্ঠানে।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে মথুরা ও গান্ধার, এই দু’টি জায়গা ছিল শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। এখন অবশ্য গান্ধার পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। মথুরা ও গান্ধার এই দু’টো জায়গার মধ্যে ব্যবসায়িক দিক থেকে সে ভাবে কোনও যোগাযোগ না থাকলেও, দু’টো জায়গাতেই প্রায় একই সময় তৈরি হয়েছিল বুদ্ধের মূর্তি, আঁকা হয়েছে বুদ্ধের ছবি। এমনকী মথুরার শিল্পকলাকেও প্রভাবিত করে গান্ধার শিল্প।

মথুরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান। আবার বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কারণ, কোঁকড়া চুল, আলখাল্লার মতো পোশাক পরা লাল পাথরের তৈরি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি মথুরা থেকেই পাওয়া যায়। অনুমান, এই মূর্তি তৈরি হয়েছিল ১০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। আরও একটি বুদ্ধমূর্তির খোঁজ এই সময় পাওয়া যাচ্ছে, যা তীর্থঙ্করদের আদলে তৈরি। জৈনশিল্পের প্রভাব লক্ষণীয়। প্রথম মূর্তিটির ভগ্ন অংশ অক্সফোর্ডের অ্যাসমোলিয়ান মিউজিয়ামে রাখা আছে। যে সময় মথুরায় শিল্পীরা বুদ্ধমূর্তির শৈল্পিক দিক নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছেন, সেই একই সময়েই গান্ধারের সোয়াট উপত্যকার শিল্পীরাও সেই চিন্তাভাবনা করছেন। গান্ধারের বুদ্ধমূর্তিরও দুই কাঁধ ঢাকা। পোশাকের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট। গ্রিক ও রোমান সভ্যতা প্রভাবিত করে গান্ধার শিল্পকে। এটা সম্ভব হয়েছিল সিল্ক রুট ধরে মধ্য এশিয়ার, ভারত ও চিনের মধ্যে ব্যবসা প্রসারিত হওয়ায়। বৌদ্ধ ব্যবসায়ীরা বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য অনুদান দিতে থাকেন। পৃষ্ঠপোষকতা করেন ভাস্করদের। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও কাশ্মীরে কোনও কোনও জায়গাও এই ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রথম কুষাণ সম্রাট কুজুলা কাডফিসেসের উৎসাহে গান্ধার শিল্পের অনুকরণে বুদ্ধমূর্তি তৈরির রমরমা শুরু হয়। তাঁর শাসনকাল ছিল ৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। গান্ধারের কিছু অংশ তিনি অধিকার করেছিলেন, পরে তাঁর পুত্র সেই সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন মথুরা পর্যন্ত। প্রথম দিকে পাওয়া দু’টি বুদ্ধমূর্তি কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের সময়ের। কণিষ্ক নিজে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর সময়ের মুদ্রাতেও বুদ্ধের ছবি পাওয়া যায়। কণিষ্কের দৌলতেই কিন্তু গান্ধার ও মথুরার মধ্যে যোগ সূত্র দৃঢ় হয়। দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে বৌদ্ধ ধর্মে হিন্দু ধর্মের মিশ্রণ লক্ষ করা যাচ্ছে।

এই পরিবর্তন শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দাড়ি, লম্বা চুলওয়ালা সুপুরুষ জিশুকে একটা সময় পাওয়া যাচ্ছে এক্কেবারে শ্মশ্রুহীন অবস্থায়। জিশুর যে প্রতিকৃতির সঙ্গে রোমান দেবতাদের বড্ড মিল। প্রথম রোমান মোজাইক স্টাইলে জিশুর প্রতিকৃতি পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের ডরসেটের একটা বাড়ি থেকে। যেখানে জিশুর হেয়ার স্টাইল ও পোশাক ছিল একেবারে রাজকীয়। এই মোজাইক ক্রাইস্টের মাথার পিছনে গ্রিক ভাষায় খোদাই করা আছে ‘X’ ও ‘P’। যা বোঝাচ্ছে ‘Christ’ শব্দটি। মাথার পিছনে ‘Chi-ro’ বোঝায় রোমের উপর তাঁর আধিপত্য। অন্য একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনি একটা ক্রস ধরে আছেন, ঠিক যেমন ভাবে রোমান সম্রাট তলোয়ার ও গ্লোব ধরে থাকেন।

ধ্যানাসীন: গান্ধার বুদ্ধমূর্তি।

এ বার ইহুদিদের প্রসঙ্গ। জুডাইজমের সঙ্গে জুড়ে আছে সাতটি শাখাযুক্ত মোমদানি। এই সাত-বাহু মোমদানি ইহুদিদের কাছে খুব পবিত্র চিহ্ন। কিন্তু প্রথম সহস্রাব্দে ইহুদিদের ধর্মীয় চিহ্নগুলির মধ্যে হিউম্যান ফিগার পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, ইজরায়েলের সিনাগগে সূর্য দেবতা। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ইহুদিদের উপর হামলা করে, তাঁদের মন্দির ধ্বংস করে। ইহুদিরা বাঁচার জন্য ছড়িয়ে পড়েন ভূমধ্যসাগরীয় ও মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। সেখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশতে মিশতে নানান পরিবর্তন আসে ইহুদি ধর্মের মধ্যেও।

এই পরিবর্তন কিন্তু হিন্দু ধর্মেও হয়েছে। প্রথম সহস্রাব্দে বিষ্ণুর অবতার দশ নয়, ছিল ন’টা। একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার শিল্পকার্যে বিষ্ণুর দশ অবতারের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে কিন্তু দশ অবতারের উল্লেখ নেই। হিন্দু ধর্ম মানেই তেত্রিশ কোটি দেবতা। কিন্তু সত্যি কি তাই! এক জন দেবতা একাধিক রূপে বর্ণিত। এই তথ্যটিও বেরিয়ে আসছে গবেষণার পর।

ইসলামীয় শিল্পে ক্যালিগ্রাফি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মসজিদ বা রাজপ্রাসাদের দেওয়ালে কারুকার্য মানেই বিভিন্ন ছাঁদের অক্ষর বা ক্যালিগ্রাফি।

বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে মিল চোখে পড়ে অনেক সময়ই। যেমন, হিন্দু, মুসলমান দুই ধর্মের শাসনকর্তাদের কাছে ধর্মীয় বার্তা প্রচারের অন্যতম উপকরণ ছিল মুদ্রা। ৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ থেকে একটা মুদ্রা পাওয়া যায়, যেখানে খোদাই করা আছে শিবের ষাঁড় নন্দী আর আরবিতে লেখা আছে আব্বাসীয় খলিফার নাম।

একটা ধর্ম আর একটা ধর্মের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মের নামে ধ্বংস হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে। যার পরিণতি নির্মম। এক ধর্ম আর এক ধর্মের শিল্পকলাকে ধূলিসাৎ করেছে, কখনও কখনও ভাস্কর্যের অঙ্গহানি করে বিকৃত করেছে। শিল্প ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে বিপক্ষের অক্ষমতা আর নিজ শক্তির জয়। যে ক্ষমতার লড়াই আজও চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Symbols Sculpture Buddhism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE