Advertisement
E-Paper

আবার চকলেট

১৫১৯ সালে করতেজ্‌ অ্যাজটেকদের রাজধানীতে পৌঁছলেন। সেখানে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কোকোর শুঁটির দর তখন চরমে। রাজা মন্তেজুমা কোটি কোটি শুঁটির মালিক। কিন্তু কেৎসালকোয়াতল্‌-এর ভয়ে রাজ্য কাঁপছে! সেই কেৎসালকোয়াতল্‌, যাঁকে দেবতারা স্বর্গ থেকে নির্বাসন দিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয় পানীয় মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে।

পিনাকী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

১৫১৯ সালে করতেজ্‌ অ্যাজটেকদের রাজধানীতে পৌঁছলেন। সেখানে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কোকোর শুঁটির দর তখন চরমে। রাজা মন্তেজুমা কোটি কোটি শুঁটির মালিক। কিন্তু কেৎসালকোয়াতল্‌-এর ভয়ে রাজ্য কাঁপছে! সেই কেৎসালকোয়াতল্‌, যাঁকে দেবতারা স্বর্গ থেকে নির্বাসন দিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয় পানীয় মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। দেবতারা খবর পেয়েছিলেন এক বিশ্বাসঘাতক অ্যাজটেকের মারফত, তাই কেৎসালকোয়াতল্‌ প্রচণ্ড খেপে অ্যাজটেক জাতির ওপর। নির্বাসনে যাওয়ার সময়, তাঁর ফেরত আসার নির্দিষ্ট সাল বলে হুমকি দিয়েছিলেন, এসে অ্যাজটেকদের চরম শাস্তি দিয়ে প্রতিশোধ নেবেন। যুদ্ধবাজ করতেজ্ যখন ও-দেশে গেলেন, উনি কিছুটা হোমওয়ার্ক করে নেন স্থানীয় দোভাষী সঙ্গিনী দোনা মারিনা’র সাহায্যে। তিনি কেৎসালকোয়াতল্‌-এর গল্প জানতেন, তাই সে দেশে পা দেওয়ার সময় গায়ে চড়ালেন সোনায় মোড়া পাখির পালক দিয়ে তৈরি জামা। ব্যস! রাজা মন্তেজুমা ঘাবড়ে গিয়ে ছুটলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে। দেবতার রোষ থেকে বাঁচতে এক পাত্র চকলেট আর এক বাগান কোকোর গাছ নজরানা দিলেন। কিন্তু তখনও স্পেনীয়রা কোকোর স্বাদ নিয়ে নাজেহাল। করতেজের এক স্যাঙাত বলেছিল, এটা শুয়োরে খেতে পারে, মানুষ পারে না। করতেজের দেশ জয় চলতে চলতে এক দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ এল তাঁর অধীনে। সেখানে চাষ হত চিনি। তা কোকোর সঙ্গে মিশল। তৈরি হল চকলেট-ম্যাজিক।

কোকোর শুঁটির কথা আর নতুন চকলেটের রেসিপি স্পেনীয়রা লুকিয়ে রেখেছিল। গোপন রাখার তাগিদ এতটাই যে, ১৫৭৯ সালে যখন ইংরেজ জলদস্যু জাহাজ এক কোকো বিন বোঝাই জাহাজকে আক্রমণ করে, স্পেনীয়রা তা রক্ষা করার খুব জোরদার চেষ্টা করেনি। তাই, কিছু না পেয়ে, কোকোর শুঁটিকে ছাগলের নাদি মনে করে হতাশ ক্রুদ্ধ জলদস্যুরা জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেয়। এক জাহাজ কোকো বিন ধ্বংস হয়ে যায়।

ইউরোপে প্রথম চকলেট আসে ওষুধ হিসেবে। তা জ্বর সারায়, শরীর ঠান্ডা করে, আর হজমেও সাহায্য করে। ক’দিন বাদে চার্চ উপোস করলে চকলেট খাওয়ার অনুমতি দেয়। বিধান দেয়: চকলেট খেলে উপোস ভাঙবে না। এক পাদ্রি এর বিপরীত বিধান দিয়ে খুনও হয়ে যান!

সারা ইউরোপ নতুন চকলেটের স্বাদ লুফে নিল। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের বিয়েতে চকলেট পরিবেশিত হল। রাজা চকলেট প্রেমে এতই মশগুল যে ১৬৫৯ সালে প্যারিসে চকলেটের দোকান খোলার অনুমতি দিলেন। ইতিমধ্যে ১৬৫৭ সালে প্রথম ‘চকলেট হাউস’ খুলে গেছে, সেখানে চকলেটে চুমুক দিতে দিতে জুয়া খেলা যায় আর আড্ডা দেওয়া যায়। কফি-হাউস বা টি-হাউস চালুর আগে এই চকলেট-হাউসগুলোই ছিল ইংল্যান্ডের প্রাণকেন্দ্র।

শিল্প বিপ্লবের সময় চকলেটকে গ্রাস করল নতুন সব উদ্ভাবনী শক্তি আর যন্ত্রের মিলিজুলি কারসাজি। ১৮৩০ সালে সুইটজারল্যান্ডের কোহ্‌লার প্রথম বাদাম মিশিয়ে চকলেট তৈরি করলেন। ১৮৪৭ সালে ইংল্যান্ডের ফ্রাই কোম্পানি প্রথম চকলেট বার তৈরি করল। চকলেট আর শুধু পানীয় রইল না, খাদ্যবস্তুও হয়ে গেল। ১৮৭৫ সালে সুইটজারল্যান্ডের নেস্‌লে সাহেব জামাইয়ের সাহায্যে প্রথম মিল্ক চকলেট আবিষ্কার করলেন। আর বেচারা কলম্বাস তলিয়ে গেলেন বিস্মৃতির অতলে। সবাই ভুলে গেল, রাজা ফার্দিনান্দ আর রানি ইসাবেলার হাতে তিনিই কোকোর শুঁটি তুলে দিয়েছিলেন, নতুন দেশ থেকে আনা উপহার হিসেবে!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

একটু এসি ভিক্ষা চাইছি স্যর...

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

পৌষ তখন ডাক দিয়ে ফেলেছে। ‘পাতা কেন ঝরে পড়ে’— এ নিয়ে রেডিয়োতে একটা ‘টক’ দিতে এসেছিলেন কাটোয়া থেকে কিছুটা দূর— শিবলুনের শিক্ষক তপোময় ঘোষ। কিছুটা মফস্সলি পত্রপত্রিকায় ওঁর কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক সহজ লেখা পড়েই ওঁকে ডাকা। রেকর্ডিং শেষ হলে উনি বলেছিলেন, একটা ধামা হবে স্যর, ছোটখাটো? অবাক হয়ে বলি, আকাশবাণী ভবনে ধামা কোথায় পাব বলুন তো...! উনি এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে বলেন— তা হলে এই ঘরে যে ফাঁকা পিসবোর্ডের বাক্সটা পড়ে আছে, ওটাই নিয়ে যাই না কেনে? বলি, ব্যাপারটা কী বলুন তো? উনি বলেন, ও কিছু না, সঙ্গে ছ’-সাত জন লোক আনা করা আছে কিনা, ওরা মুড়ি খাবে যে। বলি, কত বড় কেউকেটা আপনি, বিহার-ঝাড়খণ্ডের নেতাদের হার মানিয়ে ছ’সাত জন বডিগার্ড নিয়ে ঘোরেন? উনি দাঁতে জিভ কেটে বলেন— বডিগার্ড কেন হবে, ওরা তো পেশেন্ট...

ওঁকে তো শিক্ষক বলেই জানতাম। সঙ্গে সঙ্গে কি হোমিয়োপ্যাথিও করেন নাকি কে জানে! জিজ্ঞাসা করে জানলাম, রেডিয়োতে কাজ আছে বলে কয়েক জন পেশেন্ট নিয়ে উনি বেরিয়ে পড়েছেন ভোরবেলাতেই। পিজি হাসপাতালে দেখানো হয়ে গিয়েছে। এখানকার কাজটা হয়ে গেলে বিকেলের ট্রেনে ওদের ফিরে যাওয়ার কথা। ‘পেশেন্ট’রা সব গোষ্ঠ পালের পদতলে বসে আছে। খাওয়াদাওয়া হয়নি তেমন, ঘর থেকে মুড়ি-বাতাসা আনা করা আছে, একটা পাত্র পেলে সবাই মিলে মুড়ি খেয়ে, গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়া স্টেশনে যাবে। আমি বলি, মুড়ি খাওয়া হবে তো খবরের কাগজ দিচ্ছি, আমরা তো খবরের কাগজে মুড়ি ঢেলেই খাই। তপোময় বলেন— সে তো কাচের ঘরে বসে খান স্যর, ও দিকে আজ খুব উত্তুরে বাতাস দিচ্ছে যে, মুড়ি উড়ে পালাবে।

বাক্সটা সমেত আমিও ওঁর পেশেন্ট দেখতে যাই পৌষের মাঠে। এক জনের পা ফুলেছে, চোখের পাতাও। গাছের পাতাও ঝরছে শীতের হাওয়ায় নাচন লেগেছে বলে। তপোময় বলেন, কিডনি ভোগে গেছে, ডায়ালিসিস ছাড়া উপায় নাই। অন্য এক জন কাশছে। কাশ ঝরে যায় মাঠের কোনায়।

তপোময়কে প্রতি মাসেই দু’-তিন বার করে আসতে হয়। ও দিকের রোগীরা যে ওঁকেই চেনে। আর তপোময় চেনেন হাসপাতালের গলিঘুঁজি। বুকের কাঠি পোকায় ধরলে কোথায় যেতে হবে, হেঁতাল-ব্যথায় কোথায়, বাহ্যিদ্বারে আতাফল বেরুলে কোন ডিপার্টমেন্ট। তথ্যপ্রযুক্তির বিরাট বিপ্লবে হন্ডুরাসের হোটেল কিংবা ফুকেটের টিকিট সম্পর্কে জানা যায়, কিন্তু তপসিয়ার বাস কোথায় দাঁড়ালে পাওয়া যায়, জানার উপায় নেই। হাসপাতালগুলোও এক-একটা ধাঁধা। তপোময় হলেন হাসপাতালগুলোর মানেবই। উনি সঙ্গে না এলে মানুষগুলো দালালের খপ্পরে পড়ে। বলেছিলাম, বোর্ডেই তো লেখা থাকে সব, তা ছাড়া রোগী সহায়তা কেন্দ্র আছে...

উনি বলেছিলেন, হাসপাতালের বোর্ডে ভদ্রলোকের ভাষায় যা লেখা থাকে সেটা আমার-আপনার জন্য। আর রোগী সহায়তা কেন্দ্রেই দালালদের ভিড়। এখন লোকজন এই তপোময় ঘোষের হবি জেনে গেছে, উপায় নেই আর। মিছিল-মিটিং থাকলে একটু সুবিধা হয়। ট্রেন-ভাড়াটা লাগে না। অনেক সময় রুটি-আলুরদমও ফ্রি-তে জোটে ওদের।

এক বার বর্ষা। ঝরঝর বরিষে বারিধারা। নবীন মেঘের সুর লেগেছে। সিকিউরিটি আটকেছে জলে ভেজা তপোময়কে। বলি, আসুন ভিতরে।

তপোময় বলেন— আরও তো চার জন বাইরে ভিজছে। হেঁটে যাচ্ছিলাম লঞ্চে উঠব বলে, বৃষ্টিটা নামল এমন... এ বার সিকিউরিটিকে কী বলি? আর্টিস্ট তো এমন দেখতে হয় না। পবিত্র মিথ্যেটা ঝিলিক দিলে বললাম, ফোক আর্টিস্ট, ছেড়ে দিন। ক্যান্টিনে গেলাম। চা-নিমকি। তপোময়কে বলি, এ বার কাউকে গাইতে বলুন, যেন রিহার্সাল। দেখলাম, গয়টার আক্রান্ত লোকটাকে। আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড ফুলেছে। ও গাইল— ‘জীবন রে, তুই ছেইড়ে গেলে মুই সোহাগ করব কারে।’ ওরা বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল বৃষ্টিচ্ছায়ায়।

আরও কিছু দিন পর। গ্রীষ্ম। তখন ‘এসো, হে বৈশাখ’-এর পালা চুকে ‘নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা’ শুরু হয়ে গেছে। তা ছাড়া আকাশ জুড়ে শুনিনু ভোট বাজে। ২০০৬। ভিআইপি-রা আসছেন বেতারে ভোট প্রচারে। আবার তপোময়। সিকিউরিটি আটকেছে। বাইরে যাই। উনি বলেন— একটা লোক, ট্যাক্সিতে আছে। একটু এসি ভিক্ষা চাইছি স্যর, ঘণ্টাখানেক এসি দান দিন। কেমোথেরাপি করিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, কেমন যেন করছে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলছিল বলে আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।

তপোময় ঘণ্টাখানেক পরে ফোনে জানালেন, লোকটা স্টেশনেই মারা গেছে।

স্তব্ধতার পর বললেন—

ও কিছু না স্যর, আছে দুঃখ আছে মৃত্যু চালিয়ে দিন।

swapnoc@rediffmail.com

Chocolate
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy