ক্লাসে ভাল রেজাল্টের জন্য সমু বাবার কাছ থেকে উপহার পেল একটা সুদৃশ্য হাতঘড়ি। ঘড়িটা দিয়ে বাবা বললেন, ‘এখন থেকে তুমি সময়ের মূল্য বুঝতে শেখো।’ উপহার পেয়ে সমু আহ্লাদে আটখানা। নেড়েচেড়ে খালি ঘড়িটাকে দেখতে লাগল। সমু ভাবল, বাবার কথা অনুযায়ী এখন থেকে তাকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কারণ, সমু কখনওই সময়ের সঙ্গে পেরে ওঠে না। সময় খালি সমুকে চোখ রাঙায়। বিকেলে খেলতে বেরিয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমে আসে ও বুঝতেই পারে না। কত তাড়াতাড়ি বিকেলটা গড়িয়ে যায়। আর সন্ধে নামা মানেই বাড়িতে এসে পড়তে বসা। সমুর একদম ভাল লাগে না। সময়টা ওকে খালি তাড়া করে বেড়ায়, যেমন রাতে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তেই কখন যে সকালটা চলে আসে! চোখ কচলাতে কচলাতে হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে ইস্কুলে ছোটা। সমু মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে ওঠে।
তবে সমু এখন ঘড়ি ধরে তার রোজকার রুটিন মেনে চলে। ইস্কুলের পরীক্ষায় একেবারে সময় হিসেব করে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেয়। নির্দিষ্ট সময়ে ইস্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরয়, আবার ঠিক সময়ে বাড়ি ফেরে। সময় মেনে সব কাজ করায় বাবা-মা’ও খুশি।
সে দিন রাতে একলা ঘরে বসে সমু রুমাল দিয়ে ঘড়ির কাচটা মুছছিল। কয়েক বার ঘষার পরেই কিম্ভূতকিমাকার একটা লোক তার সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথমটায় সে হকচকিয়ে গেছিল। তার পর মুখ তুলতেই লোকটা বলল, ‘আমি সময় দৈত্য। বলো তোমার জন্য কী করতে পারি!’
বিস্ময়ে হতবাক সমুর মুখ দিয়ে কথাই সরছিল না, তবু আমতা আমতা করে বলল, ‘আচ্ছা, তুমি সবাইকেই চোখ রাঙাও কেন বলো তো? এটা বন্ধ করতে পারো না!
‘যো হুকুম, মালিক।’ এই বলে দৈত্যটা হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেল। এর পর থেকে সমু কয়েক দিন লক্ষ করল ওর কাজগুলো একেবারে যথাসময়েই শেষ হচ্ছে। সমুর কখনও মনেও হচ্ছে না যে সময়টা তাকে চোখ রাঙাচ্ছে।
সে দিন সন্ধেয় ঘরে ফিরে সমুর মনে হল, সময় দৈত্যটাকে আর এক বার ডাকা যাক। রুমাল দিয়ে ঘড়িটার কাচ ঘষতেই দেখল দৈত্যটা হাজির। বলল, ‘বলো, তোমার জন্য কী করতে পারি!’
সমু বলল, ‘আচ্ছা, তুমি ইস্কুলে থাকার সময়টাকে একটু ছোট করে বিকেলের সময়টা যদি একটু বাড়িয়ে দাও, তা হলে আমরা একটু মনের সুখে খেলতে পারি। আর মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ার সময়টাও যদি একটু ছোট করতে পারো, তা হলে খুব ভাল হয়।’
‘যো হুকুম!’ বলে দৈত্য অদৃশ্য হল।
সমু প্রতি দিন স্কুলে যায়। বিকেলে খেলতে যায়। আবার সন্ধেয় মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তেও বসে। তবে কয়েক দিন হল সে লক্ষ করছে স্কুলে থাকার সময়টা মনে হয় সত্যিই ছোট হয়ে গেছে। এই সবেমাত্র স্কুল শুরুর ঘণ্টা পড়ল, অথচ কত তাড়াতাড়ি রামনরেশভাই ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। আবার কয়েক দিন ধরে লক্ষ করছে বিকেলটা যেন বেশ লম্বা হয়ে গেছে। সন্ধে হতেই চায় না। সব্বাই মিলে কেবল খেলতেই থাকে। আবার এই সে দিন সন্ধেয় মাস্টারমশাইয়ের কাছে সবে মাত্র পড়তে বসল, অথচ কত অল্প সময়েই মাস্টারমশাই যেন ছুটি দিয়ে দিলেন। সে বুঝতে পারে, এটা সময় দৈত্যেরই কাজ। কারসাজি করে সময়গুলোকে ধরে ধরে কমাচ্ছে আর বাড়াচ্ছে।
সে দিন মা সমুকে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার বল তো, তুই ভাল ছেলে হয়ে গেছিস! সময়ের কাজটা সময়ে করছিস! আমি তো এই কথাগুলোই তোকে পই পই করে বলতাম।’
মায়ের কথায় মুচকি হেসে সমু পড়ার ঘরে চলে যায়। সে আরও এক বার ঘড়ির কাচে রুমালটা ঘষে। অমনি দৈত্যটা ওর সামনে হাজির হয়।
‘বলো, কী করব?’
সমু বলে, ‘আচ্ছা, তুমি পরীক্ষা দেওয়ার সময়টা একটু বাড়িয়ে দিতে পারো। আসলে পড়াগুলো সব সময় মাথায় ঠিকঠাক আসতে চায় না। তাই লিখতে দেরি হয়ে যায়। ও দিকে পরীক্ষা শেষের ঘণ্টাটাও রামনরেশভাই যে বড্ড তাড়াতাড়ি বাজিয়ে দেয়।’
‘যো হুকুম, মালিক।’ বলে দৈত্য বিদায় নেয়।
সামনেই সমুর বাৎসরিক পরীক্ষা। বেশ আনন্দের সঙ্গেই পড়াগুলো রপ্ত করছে। আর মনে একটা আশা আছে, এ বারে নিশ্চয়ই পরীক্ষার ঘণ্টাটা বেশ দেরি করে বাজবে!
প্রথম দিন পরীক্ষায় বসে সমু দেখল, নাঃ, ঘণ্টাটা তো দেরি করে বাজলই না, বরং রামনরেশভাই তাড়াতাড়িই বাজিয়ে দিল। সে বেশ ক’টা প্রশ্নের উত্তর লেখার সময়ও পেল না। বাড়িতে ফিরে সমু বাবা-মা’র কাছে বেশ বকাঝকা খেল।
রাতে শুয়ে শুয়ে সমু ভাবতে শুরু করল। সময় দৈত্য যে কথা দিয়েছিল পরীক্ষার সময়টা লম্বা করে দেবে! মাঝরাতে নিঝুম বাড়িটার বারান্দায় এসে ঘড়ির কাচটাকে আরও এক বার
রুমাল দিয়ে ঘষল। অমনি সে এসে দাঁড়াল।
‘আমি সময় দৈত্য। বলো তোমার জন্য কী করতে পারি!’
সমু বলল, ‘তুমি পরীক্ষার সময়টাকে লম্বা করতে পারলে না। আমাকে বেশ কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর ছেড়েই আসতে হল।
এ জন্য বাবা-মা’র কাছে খুব বকাও খেলাম।’
সমুর কথা শুনে আজ দৈত্যটা আর ‘যো হুকুম, মালিক’ বলল না। সে প্রতি-উত্তর দিল।
‘সমু, তুমি কিন্তু পরীক্ষার আগে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করোনি। তাই পড়াগুলো তোমার মাথায় ঠিক সময়ে হাজির হয়নি। সারা ক্ষণ ভাবতে ভাবতেই তোমার সময় চলে গেছে। আর তোমার মনে হয়েছে পরীক্ষা শেষের ঘণ্টাটাও বড় তাড়াতাড়িই বেজে গেছে। দেখো সমু, সময়ের কাজটা খালি সময়ে করলেই চলবে না, সেটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে করতে হবে। আর তা হলেই ইস্কুলের সময়টাকে বেশ লম্বা মনে হবে না। মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে বসেও ছুটির কথা মাথায় আসবে না। আবার বিকেলটাকেও খালি ছোট বলে মনে হবে না। আর সব কাজ সময় মতো মনোযোগ দিয়ে করতে পারলেই দেখবে, আমি আর কাউকে চোখ রাঙাচ্ছি না। আজ তবে আমি আসি।’ এই বলে সময় দৈত্যটা সমুর সামনে থেকে একেবারে ভ্যানিশ হয়ে গেল।
সমু সকালে উঠে দেখল, আজকের ভোরটা যেন একটু দেরি করেই হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল স্কুলের উদ্দেশে।