Advertisement
E-Paper

লক-আপ থেকে ভেনিস

চোর সন্দেহে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। জেলখানায় অসহ্য অত্যাচারে কাটত দিন-রাত। জীবনের সেই অন্ধকার পর্ব নিয়েই লেখা হল বই, সিনেমা পাড়ি দিল ভেনিসে। অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় চোর সন্দেহে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। জেলখানায় অসহ্য অত্যাচারে কাটত দিন-রাত। জীবনের সেই অন্ধকার পর্ব নিয়েই লেখা হল বই, সিনেমা পাড়ি দিল ভেনিসে। অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৭ ১০:৩০
জীবনাশ্রিত: তামিল ছবি ‘ভিসারানাই’-এর একটি দৃশ্য।

জীবনাশ্রিত: তামিল ছবি ‘ভিসারানাই’-এর একটি দৃশ্য।

ক’দিন হল ছেলেটি এসেছে অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর শহর লাগোয়া এক গ্রামে। কতই বা বয়স। বছর কুড়ির আশেপাশে। তেলুগু তেমন জানে না। তবে কাজ একটা জুটিয়ে ফেলেছে। স্থানীয় চায়ের দোকানে। বন্ধুও জুটেছে বেশ কিছু, নেলসন, রবি, মইদিন... প্রত্যেকেরই দিনে হাড়ভাঙা খাটুনি। কেউ রিকশা টানে, কেউ হোটেলে কাজ করে, কেউ বা মোট বওয়ার কাজ।

রাতের বেলাটুকু ওদের আনন্দের সময়। স্থানীয় এক মসজিদের সামনে ফুটপাতটা ওদের ঠেক। আড্ডা জমে। ঘুমচোখে লেগে থাকে স্বপ্ন— সিনেমার ‘হিরো’ হওয়ার। এ ভাবেই বেশ চলছিল। আচমকা ছন্দপতন। ওরা নাকি চোর। সন্দেহের বশে পুলিশ তুলে নিয়ে যায় ওদের— উপন্যাসের কথক কুমার আর তার বন্ধুদের।

অন্ধ্রপ্রদেশ পুলিশ শুরু করে ‘জেরা’। জেরার নামে দশ ফুট বাই দশ ফুটের সেলে অকথ্য অত্যাচার, ১৩ দিন ধরে। এ ভাবেই শুরু হয় ‘লক-আপ: জটিংস অব অ্যান অর্ডিনারি ম্যান’ উপন্যাস। লেখক কোয়েম্বাত্তুরের অটোচালক, এম চন্দ্রকুমার। ‘কুমার’ নামে তিনিই উপন্যাসের কথক। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এ উপন্যাসের বিষয়। সম্প্রতি তামিল থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক পবিত্র শ্রীনিবাসন।

‘সেল’-এর বর্ণনায় উঠে আসে কুমার, থুড়ি চন্দ্রকুমারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। দরজায় একটা ছোট্ট খোপ। খাবার, জল আসে ও পথে। দেওয়ালে একটা গর্ত, প্রস্রাব করার জন্য। আবছায়া ঘরে ঠেসাঠেসি-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে বেশ ক’জন অপরাধী। চারদিকে ঘাম আর প্রস্রাবের নোনাধরা গন্ধ। গন্ধ আরও একটা আসে, বিড়ির। তাকেই মনে হয় সুগন্ধ। রোজ, সকালে এক বার দরজা খোলে। ওই একটা সময়ই কুমার আর তার বন্ধুদের মনে হয়, তারাও ‘মানুষ’। একটা খুপরি আছে সেল-এ। সেখানে চেনামুখেরা মাঝেসাঝে দেখা দেয়— চা, খাবার আর আশ্বাস নিয়ে।

এম চন্দ্রকুমার

আর জোটে মার, শুধুই মার। দড়ি দিয়ে বাঁধা শরীর। ঘাড়, পেট, গোপনাঙ্গ, পা— শরীরের কোনও অঙ্গই বাকি থাকে না মার খাওয়া থেকে। যত মার, তত ভেসে আসে একটা বাক্য, ধ্রুবপদের মতো। সেলের দেওয়াল চিরে শোনা যায়, ‘স্যর, আমি কিছু করিনি স্যর!’ করা বা না করার, কোনওটারই প্রমাণ নেই। নেই গ্রেফতারি পরোয়ানাও। তবুও তাঁরা অপরাধী। অপরাধের অভিযোগ একটা অবশ্যি আছে। কুমারের কর্মস্থল, চায়ের দোকানের মালিকের অভিযোগ, ওরা শাটার ভেঙে টেপরেকর্ডার চুরি করেছে। পরে সবাই মিলে হুমকিও দিয়েছে আবার।

এ ভাবেই দিন যায়। ১৩টা দিন। সেল-যাপনটাও যেন সয়ে যায়। তাই দরজা খোলার আওয়াজ শুনলেই যেন মনে হয়, ‘এই বেশ ভাল। অন্তত বাইরের থেকে!’ কুমার অবাক চেয়ে দেখে, তারই বন্ধু নেলসনকে। এক ‘স্যর’-এর জুতো পালিশের কাজ করে সে। আর তাতে কী যে উৎসাহ নেলসনের!

চন্দ্রকুমার মানুষের অবসাদও লক্ষ করে। লক-আপে এক নতুন বাসিন্দা এসেছেন। হঠাৎ খুলে যায় লক-আপের দরজা। সেই নতুন বাসিন্দা তুরন্ত গতিতে লাফ দেন। তার নাগাল পান না এক পুলিশকর্মী। সেই মারতে না পারার ‘অবসাদে’ যথেচ্ছ লাথি জোটে সহবন্দিদের।

সকলেই এমন নন। এক সহৃদয় পুলিশকর্মীর কথাও বলেন কুমার। যিনি পরামর্শ দেন, দোষ স্বীকার করে নিতে। সেই পরামর্শের উদ্দেশ্য ‘নেক’— মারধরের রোজনামচা থেকে কুমারদের রক্ষা করতে হবে যে। ‘দোষ’ স্বীকার করা হয়, আদালতে। কারণ তারা ভাবে, মার খেতে খেতে মৃত্যু হওয়া বা পঙ্গু অবস্থায় রেল স্টেশনে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে এই ‘স্বীকার’ করে নেওয়া অনেক শ্রেয়।

চন্দ্রকুমারের এই উপন্যাস শুধু জেল-জীবনের বর্ণনা নয়। বরং এ যেন প্রান্তিক মানুষের জীবনের একটি পর্বের নেপথ্য-কথা।

কোয়েম্বাত্তুরের অটোচালক চন্দ্রকুমারকে এই উপন্যাস লেখায় উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধু, তামিল সাহিত্যিক নানি শঙ্করন। যা থেকে হয়েছে ‘ভিসারানাই’ (জেরা) ছবিও। বানিয়েছেন প্রখ্যাত তামিল পরিচালক ভেত্রিমারান। সিনেমাটি ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবং ৬৩-তম জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিতও হয়। অস্কারে বিদেশি ভাষার সেরা চলচ্চিত্র বিভাগেও পাঠানো হয়েছিল।

দিনের শেষে কুমার এক জন পাঠকও। সেখানেও সে ব্যতিক্রমী। তার পছন্দের লেখক-তালিকায় এক ফরাসি এবং ভগৎ সিংহ।

Visaranai M Chandrakumar Venice Film Festival লক-আপ: জটিংস অব অ্যান অর্ডিনারি ম্যান Lock Up এম চন্দ্রকুমার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy