Advertisement
E-Paper

সমুদ্র আলো করে বসে আছে

আমি অনেক সময় অনেক কিছু দেখতে পাই যা আমার পাশের মানুষটিও দেখতে পায় না, আমি জানি। আমার নাকের পাশ দিয়ে একটা প্লেন উড়ে গেল। মাথার ওপর নেমে এল অনেক পুরু ঘন কালো মেঘের চাদর, বা শার্টটা খুলে নিয়ে কেউ একটা আলখাল্লা পরিয়ে দিয়ে গেল আমাকে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

আমি অনেক সময় অনেক কিছু দেখতে পাই যা আমার পাশের মানুষটিও দেখতে পায় না, আমি জানি। আমার নাকের পাশ দিয়ে একটা প্লেন উড়ে গেল। মাথার ওপর নেমে এল অনেক পুরু ঘন কালো মেঘের চাদর, বা শার্টটা খুলে নিয়ে কেউ একটা আলখাল্লা পরিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। এই সব কিছুই চলতে থাকে কিন্তু কেউ কিছুই বুঝতে পারে না। আমিও কোনও দিন বোঝাতে চাইনি কাউকেই। সামনের সিটে বসা লোকটার বাঁ-কানের ফুটো থেকে লিলিপুটদের কাছেও লিলিপুট একটা লোক বেরিয়ে এসে ডান-কানের ফুটো দিয়ে ঢুকে কোথাও চলে গেল। আমি দেখতে পেলাম কিন্তু বলতে পারলাম না কিছুই। আমি জানি, এ রকম আমার হতেই থাকবে, হতেই থাকবে আর হতেই থাকবে।

সুব্রত, কবি সুব্রত চক্রবর্তী, তখন মহিষাদল রাজ কলেজে পড়ায়। এক দিন একটা পোস্টকার্ড এল— ‘অমুক তারিখ থেকে তমুক তারিখ পাঁচ দিন কলেজ বন্ধ। চলে এস। দীঘা যাব। নতুন লেখা কবিতাগুলো এনো। আমিও লিখেছি প্রচুর। এই ক’দিন শুধু কবিতা, আমরা আর সমুদ্র।’

আমার তখন খুব খারাপ অবস্থা। না-ছাপা কোনও কবিতাই নেই। শেষ কবিতাটা লিখেছি আট মাস আগে। কিন্তু কবিতা না নিয়ে গেলে, আমি তো সুব্রতকে চিনি, মারধোর খেয়ে যেতে পারি। অগত্যা রাত জেগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চারটে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চারটে, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত আর সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর চারটে চারটে করে কবিতা কপি করে, পরের দিন ট্রেনে চেপে মহিষাদল। নিজের বলে চালিয়ে দেব সব, সুব্রত বুঝতেই পারবে না।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেলে দুজন মিলে বেরোলাম টুকিটাকি কেনাকাটা করতে। সবচেয়ে আগে কিনতে হবে রাতের কেরোসিন, ট্রিপল-এক্স রাম। মহিষাদল থেকেই জোগাড়পাতি শুরু করে দিয়েছিলাম। দিঘা তখন একটা ছোট্ট জায়গা। থাকার মধ্যে বিশাল বড় একটা সমুদ্র, তার ধারে মস্ত একটা কড়াই নিয়ে বসে থাকা একটা লোক। কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে গভীর জল থেকে উঠে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ, ভাজা-ভাজা করে ফেলে মাছের জীবন। রাম রহিম শ্যাম স্যামুয়েলরা সেই ভাজা মাছ খায়, সঙ্গে চলে রাতের কেরোসিন। তার পর চলে বাওয়াল। আর আছে ক’টা ঝুপড়ি ডালভাতের দোকান, ক’টা ঘুপচি-মার্কা থাকার হোটেল। তারই একটার নাম ছিল বোধহয় সারদা বোর্ডিং হাউস। পার-ডে দশ টাকা ভাড়া। সেখানেই গিয়ে উঠব আমরা। সুব্রত ফোনে ঠিক করে রেখেছে।

কেনাকাটা সেরে মহিষাদল বাজারের চায়ের দোকানে ঢুকলাম। দেখি সামনের টেবিল আলো করে, শুধু টেবিল কেন, সমস্ত দোকান আলো করে বসে আছে তন্বী শ্যামা শিখরদশনা এক যুবতী, পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর, পাশে চমৎকার দেখতে এক পুরুষ। খুব মজা করে গল্প করছে দুজন। এক্কেবারে রাজযোটক। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ভাল লাগল, আর তার চেয়েও ভাল লাগল সুন্দরীটিকে দেখে। মনে হল, বিয়ে-ফিয়ে যদি হয়ই তা হলে এমন হওয়াই ভাল। আমার এক জেঠতুতো পিসি সারা জীবন পিসেমশাইকে আপনি আপনি করে কথা বলতেন। পিসেমশাইও তাই, নিতান্ত কথা বলতে হলে ওই আপনি আপনিই করতেন। তার পরও কী করে যেন বছর বছর আপনি-আপনিই চলে আসত পিসতুতো ভাইবোনেরা। রাস্তায় নেমে সুব্রতকে জিজ্ঞেস করলাম, দেখলে? দেখলে না? কী সুন্দর! সুব্রত অবাক হয়ে বলল, ‘কই আমি তো কিছু দেখিনি।’ সে কী! আমাদের সামনেই তো বসেছিল! সুব্রত বলল, ‘তাই? হবে হয়তো!’

সকাল আটটায় বাস। কলকাতা থেকে মহিষাদল, কাঁথি হয়ে দিঘা। বাস চলেছে। আমি আর সুব্রত পাশাপাশি বসার জায়গাও পেয়ে গেছি, আমাদের গল্প থামছেই না, যেমন কখনওই থামতে চাইত না সেই দিনগুলোয়। আমাদের চেয়েও বেশি শব্দময় সামনের সিটে বসে থাকা নারী ও পুরুষটি। ভাল করে তাকিয়ে দেখি, আরে এরা তো সেই কাল রাতের চায়ের দোকানের দম্পতি। তেমনই হেসে চলেছে মেয়েটি, তেমনই সুখী তার পুরুষ।

সুব্রত ঝুঁকে ফিসফিস করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল, দিঘা যাচ্ছেন বুঝি? ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। উত্তর দিলেন কি দিলেন না বোঝা গেল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মহিষাদলে থাকেন, না? কাল সন্ধেয় চায়ের দোকানে দেখেছিলাম আপনাদের। মেয়েটি তাকাল গম্ভীর মুখে। বলল, ‘না, মহিষাদলে থাকি না।’ তবে কি কলকাতা? কাঁথি? কেউ কোনও উত্তর দিল না। ফিরে গেল তাদের ফিসফিস কথায়, হাসাহাসিতে।

সুব্রত বলল, কবিতা এনেছ? বললাম, হ্যাঁ। কই দেখি? এখানেই দেখবে? সুব্রত বলল, হ্যাঁ, দেখি না। খাতা বের করলাম। সুব্রত পড়তে পড়তে নাকমুখ কুঁচকে বলে উঠল, এ তো সুনীল, শক্তি, প্রণবেন্দু, সমরেন্দ্রকে ঝেড়ে ফাঁক করে দিয়েছ। আমি বললাম, ঝেড়ে ফাঁক করিনি। এগুলো ওদেরই লেখা। সুব্রত তাকাল আমার দিকে। আমি বললাম, কী করব! তুমিই তো কবিতা আনতে বললে। আমি এখন লিখতে পারছি না। ওরা লিখছে তাই ওদের কবিতাই আনলাম।

সারদা বোর্ডিং হোস্টেলের ঘরে ব্যাগ রেখে, রাস্তার ঝুপড়িতে ডাল ভাত পোস্ত মাছের ঝোল খেয়ে সমুদ্রের ধারে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম, কখন সূর্য ঢুকে পড়বে সমুদ্রের ভেতর। সঙ্গে ঝোলার ভেতর অপেক্ষা করতে করতে, অপেক্ষা করতে করতে, ঘুমিয়ে পড়ল দৈত্যের বোতল। হোটেলে যখন ফিরলাম, রাত তখন ভিগি-ভিগি। ভিগি-ভিগি আমাদের শরীর, আমাদের পা, হাতের আঙুল। লাফ দিয়ে পড়লাম বিছানার ওপর। ডুবে গেলাম সমুদ্রের তলায়, সাঁতার কাটতে লাগলাম আমারই মতো ঘুমন্ত মাছেদের সঙ্গে। ঘুম ভাঙল রুলের গুঁতোয়।

চোখ খুলে দেখি, তিন-চার জন পুলিশ বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে। ঢুকল কী করে ঘরে! মনে পড়ল, কাল রাতে দরজাই বন্ধ করা হয়নি। হেড পুলিশ বলল, বাইরে আসুন। আমি আর সুব্রত বাইরে বেরিয়ে এলাম, পুলিশ ইন্সপেক্টর পাশের ঘরের খোলা দরজার দিকে দেখিয়ে বলল, এদের দেখেছেন আগে? কিছু বলতে পারবেন? পাশের ঘরে ঢুকে যা দেখলাম তাতে রাতের নেশা, ভোরের ঘুম এক সেকেন্ডে ছুটে গেল।

আমাদের পাশের ঘরটাই ভাড়া নিয়েছিল সেই দম্পতি, আর কাল রাতে ফলিডল খেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে সুখী সুখী মুখেই চলে গিয়েছে অনেক দূর। বিছানার ওপর যা পড়ে আছে তা শুধুই তাদের শরীর। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল এত ভালবাসাবাসির এই নারী আর পুরুষ আসলে জামাইবাবু আর শ্যালিকা। কেন যে মানুষ ভালবাসে!/ কেন যে পড়ে প্রেমে!/ তার চেয়ে ভালো, নাম লেখানো/ চিরাচরিত গেম-এ।

এর বেশ কয়েক দিন পর কফিহাউসে গেছি। শনিবারের বাজার। কোনও টেবিলই প্রায় খালি নেই। হঠাৎ দেখি, কোণের একটা টেবিলে বসে আছে সেই দম্পতি। তারা কথা বলে চলেছে, কথা বলে চলেছে আর কথা বলে চলেছে।

এগিয়ে গেলাম ওদের সামনে, বললাম, এখন ভাল আছেন? ওরা তাকাল আমার দিকে, ঝকঝকে একটা হাসি হেসে আবার ডুবে গেল নিজেদের গল্পে। আমার পিঠে কে যেন হাত রাখল। তাকিয়ে দেখি শামশের আনোয়ার, বলল, হাঁ করে কী দেখছিস শালা? বসে পড়। নইলে এ দুটো চেয়ারও এক্ষুনি কেউ টেনে নেবে।

বহু দিন পর, বাড়ি ফিরে নন-স্টপ আটটা কবিতা লিখেছিলাম সেই রাতে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy