Advertisement
E-Paper

উড়ে এসে জুড়ে বসে

চিকু সারাদিন একা একা বাড়িতে থাকে। সেই যে কোন সকালে বাবা আর মা কাজে বেরিয়ে যায়, আসে সেই অন্ধকার হলে। সারাদিন একা একা থাকতে চিকুর মোটেই ভাল লাগে না। খুব মনখারাপ হয়, রাগ হয় মা-বাবার উপর। কত দিন তো ও মায়ের কাছে বায়নাও করেছে, ‘মা, আজকে কোত্থাও যাবে না তুমি।’

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

চিকু সারাদিন একা একা বাড়িতে থাকে। সেই যে কোন সকালে বাবা আর মা কাজে বেরিয়ে যায়, আসে সেই অন্ধকার হলে। সারাদিন একা একা থাকতে চিকুর মোটেই ভাল লাগে না। খুব মনখারাপ হয়, রাগ হয় মা-বাবার উপর। কত দিন তো ও মায়ের কাছে বায়নাও করেছে, ‘মা, আজকে কোত্থাও যাবে না তুমি।’

মা ওকে কোলে করে বুঝিয়েছে, ‘আমি না বেরলে তোমার জন্য ভাল ভাল খাবার কে নিয়ে আসবে? তোমার পছন্দের খেলনা নিয়ে আসব কী করে?’

তাই তো, মা রোজ ওর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। কিন্তু তবুও, চিকুকে তো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু মা নিয়ে যায়নি, মা বলেছে, ‘তুমি তো এখন ছোট, যখন বড় হবে, তখন তুমিও যাবে।’

চিকু বাড়িতে বসে বসে ভাবে যে সে কবে মায়ের মতো বড় হবে। তখন ও-ও রোজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। কত নতুন নতুন জায়গায় যাবে। কিন্তু সে তো বড় হলে! এখন কি তা হলে ওকে রোজ একাই থাকতে হবে? দুপুরবেলা যে ওর ভারী ভয় করে। খালি মনে হয় ভূতে এসে ওকে যদি খেয়ে নেয়! ছেলেধরা এসে যদি ওকে বস্তায় ভরে নিয়ে যায়। তার পর যদি ওর হাত-পা কেটে ফেলে দেয়। ভয়ে শিউরে ওঠে চিকু। এ ভাবেই কেটে যায় দিনের পর দিন।

তবে, এ তো না হয় রোজকার গল্প, আজকে ওর মা এত দেরি করছে কেন? সকালে তো বলে যায়নি যে আজ দেরি হবে। কোনও দিন মায়ের ফিরতে দেরি হলে মা তো বলে যায়। মা ওকে একলা ফেলে রেখে কোথাও চলে যায়নি তো? ওর কথা ভুলে যায়নি তো? চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছে চিকুর।

এমনিতেই আজ দুপুরবেলার পর থেকে ওর খুব মনখারাপ। এখনও কাঁধের কাছটা জ্বালা করছে। হাত ঘোরাতে গেলে একটু খচখচও করছে। চিকু তো শুধু খেলতে গিয়েছিল, ওরা চিকুর সঙ্গে এমন কেন করল? মা এলেই নালিশ করবে। মা গিয়ে ওদের আচ্ছা করে বকে দিয়ে আসবে। তখন বুঝবে ওরা। কিন্তু মা যে আজকে ফিরছেই না।

রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে চিকু। ক্রমশ চার পাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আকাশের লাল রং ধীরে ধীরে কালোয় মিশে যাচ্ছে। রাস্তার আলোগুলোও আজ জ্বলেনি। তার সঙ্গে আকাশ ভেঙে যেন বৃষ্টি আসছে। চিকুর খুব ভয় করছে। আজকে যদি ওর মা রাতে না ফেরে! রাত্তিরবেলা কোনও বেম্মদত্যি, শাঁকচুন্নি বা কন্দকাটা এসে যদি ওকে ধরে নিয়ে যায়! এ বার ভয়ে, দুঃখে কেঁদেই ফেলল ও। চোখ ঝাপসা হয়ে এল। তার পর কাঁদতে কাঁদতে যে ও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন কী আরাম হচ্ছে! নরম গদির মধ্যে যেন ও শুয়ে আছে! কী গরম বিছানাটা! চোখ মেলে দেখল মা ওকে কোলে নিয়ে বসে আছে। দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছে বুকের মধ্যে। ও আবার স্বপ্ন দেখছে না তো! দু’হাতে চোখটা রগড়ে নিল। তার পর একগাল হেসে মাকে জড়িয়ে ধরল।

‘মা, কোথায় ছিলে তুমি? দেরি হল কেন?’

‘আজকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল তো সোনা, তাই আটকে পড়েছিলাম। কিছুতেই ফিরতে পারছিলাম না।’

‘ইস! তুমি আজ পুরো ভিজে গিয়েছ, মা?’ বলে মায়ের ঠোঁটে ঠোঁট ঘষল। তখনই ওর মায়ের চোখ চলে গেল ওর কাঁধে।

‘চিকু, কী হয়েছে এখানে?’

তাই তো! ও তো মাকে বলতে ভুলেই গিয়েছে দুপুরে ওরা চিকুর সঙ্গে কী করেছে। কাঁদোকাঁদো গলায় ও বলে উঠল, ‘ওই যে পাশের বাড়ির ছেলেটা রোজ উঠোনে বসে ভাত খায় না? আজকেও দুপুরবেলা ওখানে ভাত খাচ্ছিল। আমি তো সকালে ওর সঙ্গে খেলতে যাই। দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় ও আমায় আবার ডাকল। তাই আমি ওর কাছে গিয়ে বসলাম। ও মুখ থেকে মাছটা, ভাতটা বের করে আমায় দিচ্ছিল, আমিও টুকটুক করে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ ওর মা দৌড়ে এসে এক গামলা গরম জল ছুড়ে মারল আমার গায়ে। এইখানে, ঠিক এইখানে,’ বলে কাঁধের কাছটা সামনে এনে মাকে দেখানোর চেষ্টা করল।

খানিক থেমে আবার বলতে শুরু করল, ‘তার পর আমায় তাড়িয়ে দিল। বলল, ‘হুস, হুস, কোত্থেকে যে সব উড়ে এসে জুড়ে বসে। যা এখান থেকে, হ্যাংলা কোথাকার!’ মা, আমি তো যাইনি, ও-ই তো আমায় ডেকেছিল। কত বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিছুতেই শুনল না। আমাকে তাড়িয়ে দিল। আমার খুব দুঃখ হয়েছে মা। আমি কি হ্যাংলা, বলো? আমি তো শুধু খেলতেই গিয়েছিলাম।’

ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।

মা ওকে দু’হাতের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁধের ওই পোড়া জায়গায় চুমু দিয়ে দিল। তার পর কাঁধে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আর কক্ষনও যাবে না ওদের সঙ্গে খেলতে, বুঝলে? ওরা ডাকলেও যাবে না। ওরা ও রকমই।’

‘কিন্তু কেন ওরা এ রকম মা?’

‘ওরা তো মানুষ, ওরা আমাদের বুঝতে পারে না। আমাদের কথাও বুঝতে পারে না।’

‘কিন্তু মা, আমার যে খুব খেলতে ইচ্ছে করে।’

চিকুর মা বাসা থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল, লাল আলো ফুটছে আকাশে, ভোর হল বলে। তার পর চিকুর হাত ধরে টানল, ‘তোর খেলতে ইচ্ছে করে? চল, আজ আমি খেলব তোর সঙ্গে, আকাশে।’

বলে ডানা মেলে কদমগাছটা থেকে উড়ে গেল দূর আকাশে। চিকুও ওর মায়ের পিছু পিছু উড়ল। সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ল চিকুর ডানায়। চিকচিক করে উঠল ওর চোখ দুটো। কাঁধের কাছটায় একটু লাগছে, কিন্তু খুব আনন্দ হচ্ছে। হাত-পা যেন হালকা হয়ে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। কা-কা, কা-কা করে মায়ের সঙ্গে আরও উপরে উঠে এল চিকু, এত উপরে এর আগে আর কখনও আসেনি সে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy