Advertisement
E-Paper

দ্বীপের নাম গাংটিকুলি

তেরো বছর আগে বেআইনি কয়লা খাদানে জলে ডুবে মারা যান দশ জন শ্রমিক। আজও চরম দারিদ্রে দিন কাটাচ্ছেন তাঁদের পরিজনেরা। তেরো বছর আগে বেআইনি কয়লা খাদানে জলে ডুবে মারা যান দশ জন শ্রমিক। আজও চরম দারিদ্রে দিন কাটাচ্ছেন তাঁদের পরিজনেরা।

সুশান্ত বণিক

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
ফেরা: দূরে গাংটিকুলি। ছেলেদের প্রতীক্ষায় দুই মা। ছবি: পাপন চৌধুরী

ফেরা: দূরে গাংটিকুলি। ছেলেদের প্রতীক্ষায় দুই মা। ছবি: পাপন চৌধুরী

গ্রামের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় দামোদরের বুকে গাংটিকুলি দ্বীপকে। বর্ধমান-পুরুলিয়া সীমান্তে দামোদর নদের মাঝখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সেই দ্বীপ। অতীতে এই দামোদরকে গঙ্গা মেনে শ্রদ্ধাভক্তি করতেন গ্রামের বাসিন্দারা। গঙ্গা থেকে ‘গাং’, তার উপরে টিকুলি অর্থাৎ টিপ। এই থেকেই দ্বীপের নাম গাংটিকুলি। প্রাকৃতিক শোভায় ভরপুর এই দ্বীপেই তেরো বছর আগে ঘটে গিয়েছিল ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সেই কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন পাঞ্চেতের খেরকেয়ারি গ্রামের বাসিন্দা কানু গোপ, সারথি মণ্ডল, আশা বাউড়িরা। এখনও কাঁদেন।

দ্বীপের মাঝ বরাবর গভীর জঙ্গলের মধ্যে পরপর তিনটি বিশাল ইঁদারা ছিল। ব্যাস প্রায় ৩৫-৪০ ফুট। জল নয়, ইঁদারাগুলো থেকে তোলা হত কয়লার চাঁই। আসলে কুয়ো নয়, এগুলো ছিল বেআইনি কয়লা খাদান। ইঁদারার মুখে লোহার রেলিং গেঁথে বড় কপিকল বসানো, সেগুলোয় দড়ি পেঁচিয়ে ঝোলানো হত ডুলি। সেই ডুলি বেয়ে নিয়মিত খাদে ওঠানামা করতেন শ্রমিকেরা। খাদ থেকে কয়লা তুলে উপরে তোলা হত ওই ডুলিতে চাপিয়েই। ২০০৬-এর ৩১ জুলাই দুপুরে কয়লা কাটতে খাদে নেমেছিলেন খেরকেয়ারি গ্রামের দশ জন শ্রমিক। গাঁইতি দিয়ে কয়লার চাঁই কাটতে কাটতে অনেকটা গভীরে চলে যান তাঁরা। গাঁইতির কোপে একটা বিরাট চাঁই খসে পড়তেই হুহু করে দামোদরের জল খাদে ঢুকতে শুরু করে আচমকা। শ্রাবণের বর্ষায় এমনিতেই ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল দামোদর। মুহূর্তের মধ্যে নদীর জলে ভরে যায় ইঁদারাগুলো। এক জনও উপরে উঠে আসতে পারেননি।

ভোরের মুখে খবর পৌঁছয় গ্রামে। শোনামাত্র গাংটিকুলি ছুটেছিলেন পরিবারের লোকজন। কানায় কানায় ভরা ইঁদারাগুলো দেখেই বুঝেছিলেন, কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। দিনের আলো ফুটতে ওই দশজনকে উদ্ধারের তোড়জোড় শুরু করে জেলা প্রশাসন। গাংটিকুলি দ্বীপে তখন হাজার মানুষের ভিড়। সংবাদমাধ্যম খবর করল, বেআইনি কয়লা খাদানে মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হল বিধানসভা, সংসদ। ঘটনাস্থলে এলেন তৎকালীন কয়লামন্ত্রী, তাঁর উদ্যোগে নিখোঁজদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীও নামানো হল। কিন্তু লাভ হল না কোনও। সাত দিন চেষ্টার পরে হার মানলেন সবাই। আশা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন ওই শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরাও।

কেমন আছেন এখন তাঁরা? গ্রামে ঢোকার মুখে অশ্বত্থ গাছ, হনুমান মন্দির, পাশের রাস্তায় এগোলেই ডান হাতে আশা বাউড়ির ঘর। ২০০৬-এর দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন তাঁর দুই ছেলে দীপক ও মাধব। দুর্ঘটনার বছর কয়েক আগে স্বামীর মৃত্যুর পর ওই দুই ছেলেই ছিল সম্বল। এখন ইটভাটায় জন খেটে পেট চালাচ্ছেন আশা। মাটির ঘরে বসে ছেলে কার্তিকের কথা বলছিলেন কানু গোপ, ‘‘শ্রাবণ এলেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। সংসারের অনটন মেটাতে নিজের প্রাণটাই দিয়ে দিল!’’ দুর্ঘটনার সময় খেরকেয়ারি গ্রামের নিশার বয়স ছিল নয়, অজয়ের তেরো। ওদের বাবা সুবোধ গোপ গাংটিকুলির খাদানে হারিয়ে গিয়েছেন। বছরখানেক আগে নিশার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ধানবাদে মামাবাড়িতে থেকে স্নাতক পাশ করে অজয় এখন চাকরির চেষ্টায়। ভাঙাচোরা একচালা ঘরের উঠোনে বসে সুবোধের স্ত্রী ক্ষমা গোপের আক্ষেপ, গ্রামে মনসাপুজো ছিল, তার খরচ জোগাড়েই সে দিন ওই মরণকুয়োয় নেমেছিলেন তাঁর স্বামী।

ছেলে সমীর আর ফিরবে না, কিন্তু তার জমানো জীবনবিমার টাকাগুলোও কি মিলবে না? এই প্রশ্নই এখন জনে জনে শুধোন অশীতিপর রেখা মণ্ডল। একগুচ্ছ বিমার কাগজ হাতে ছুটে এসে অনুরোধ করছেন, ‘‘ছেলের জমানো টাকাগুলো এনে দাও। বেঁচে যাব তা হলে।’’ বাড়ি থেকে খানিক দূরে মাঠের মাঝখানে উঁচু ঢিবিতে বসে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা সারথি মণ্ডল। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ‘‘ওই যে দেখছ গাংটিকুলি, ওখানেই আমার অলোক শুয়ে আছে।’’ তাঁর ছোট ছেলে ভৃগু জানালেন, দাদার মৃত্যুর পর থেকেই রাতবিরেতেও উঁচু ঢিবিটায় উঠে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধা মা। নদী পেরিয়ে অনেক বার একা ওই দ্বীপে চলেও গিয়েছেন।

দুর্ঘটনার দিন ভাগ্যবতীর বয়স ছিল বছর ছয়। মায়ের হাত আঁকড়ে বাবার জন্য অঝোরে কেঁদেছিল ছোট্ট মেয়েটা। এত বছর পর তার বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, দরজায় তালা। প্রতিবেশীরা জানালেন, দুর্ঘটনায় স্বামী দশরথ গোপের মৃত্যুর পরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন ভাগ্যবতীর মা। বছর কয়েক পরে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঝাড়খণ্ডে ভাইয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন, সে দিনই কোনও ভাবে ছেলেকে নিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। কাকাদের আশ্রয়ে বড় হওয়া ভাগ্যবতীর বিয়ে হয়েছে বছরখানেক হল।

দুর্ঘটনার পর মাসকয়েক পরিবারগুলো একটু টাকা আর চাল পেয়েছিল প্রশাসনের তরফে। তার পর এতগুলো বছর কেটেছে, খোঁজ রাখেনি কেউ। জীবিত মানুষগুলোও এখন ডুবছেন অভাবের কুয়োয়।

Gangatikuli Death
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy