E-Paper

রথের চাকা

সভ্যতার রথ চলতে শুরু করে চাকার আবিষ্কারেই। কর্ণের রথের চাকা যেন চিরকালীন দুর্ভাগ্যের প্রতীক। সারনাথ থেকেই ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। বঞ্চনার চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। সময়ের চাকার সঙ্গে সঙ্গে আরও নানা চক্রের আবর্তন দেখলেন রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়

রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ ০৮:১৭
ছবি: কুনাল বর্মণ।

ছবি: কুনাল বর্মণ।

আমার প্রথম রথ টানার স্মৃতিটা একটু মনখারাপের। মা কিনে দিয়েছে রথ। দাদা রঙিন কাগজ দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। বাবা বাজার থেকে আসার পর আমাকে কিচ্ছু না বলে রথের মধ্যে জগন্নাথ সাজিয়ে দিয়ে গেছে। শেষের বিষয়টায় আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয়েছে। কারণ বাড়ির আলমারিতে ম্যাগনেটে তিন জনকে দেখতে দেখতে একটা ভাল-লাগা তৈরি হয়েছিল। আর বাবা দিয়েছে, তার ব্যাপারই আলাদা। আনন্দে ডগমগ হয়ে রথ নিয়ে নীচে নেমে এসেছি, দাদা নামিয়ে দিয়ে গেছে। দিদা আমার রথ দেখে আরও খুশি, একটা ঠাকুরের ছোট বাটিতে বাতাসা আর ছোট গেলাসে জল দিয়ে দিল জগন্নাথদেবের কাছে। মনের আনন্দে রথ টানা শুরু করলাম, তিন বন্ধু মিলে। কিন্তু মা রথ জগন্নাথদেবের কিনলেও, চাকা মনে হয় কর্ণের কোম্পানি থেকে আনিয়েছিল। যতই সোজা নিয়ে যেতে চাই, ‘কমলি নেহি ছোড়েগি’, টেরেবেঁকে একাকার, তখন বুবাই প্রথম দেখাল। রথের দুলুনিতে আমার ঠাকুরের গেলাস গেছে উল্টে,আর সেই জল আমার আদরের ছোট্ট জগন্নাথকে দিয়েছে গলিয়ে, সে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। বিকেলে বৃষ্টি মানে খেলা মাটি, কিন্তু সে দিন ভাল লেগেছিল। ওই বৃষ্টি আমাকে আর আমার আধখেঁচড়া জগন্নাথকে আড়াল দিয়েছিল বন্ধুদের থেকে।

বিজ্ঞানের চাকা

রথ এবং রথের চাকা বৈজ্ঞানিক ভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রথের চাকাতেই চাকা তার জমাট অবস্থা থেকে স্পোক-জাতীয় জিনিসের আওতায় এল, যা কিনা এক বিশাল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি। রাজকীয় কাজে ব্যবহৃত হলেও, রথ মূলত সামরিক আবিষ্কার। আজকের ভাষায় যাকে বলে কাস্টমাইজ়েশন, বড় যোদ্ধারা নিজের অনুপাতে তাঁর রথকে সে রকম করে নিতে পারতেন। আমরা যেমন গাড়ির পিছনে লাগাই ‘আই আম আ জ়্যাভেরিয়ান’, তেমনই বড় বড় যোদ্ধারা তাঁদের রথ থেকে পতাকা ওড়াতেন চেনা নিশানের বক্তব্য রেখে। আর্যদের মধ্যে তো বটেই, রথের সামরিক ব্যবহার দেখা গেছে মেসোপটেমিয়া, মিশর, চিন, পারস্য দেশের লোকের মধ্যে। কাজেই নাৎসি বাহিনির ফক্স ভাগেন গাড়ি তৈরি নতুন কিছু নয়, রথের সময় থেকেই সামরিক বাহিনি গাড়ি বানাচ্ছে।

রথচক্রের কথা হবে আর কোণার্কের অত্যাশ্চর্য রথচক্রের আলোচনা হবে না, তা তো হতে পারে না। তা একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক, আবার বৈজ্ঞানিকও। এটি সূর্যদেবতার রথচক্রের কল্পনায় তৈরি। বারোটি চাকা বছরের বারো মাসকে বোঝায়। চাকার ভিতরে স্পোক থাকে আটটা, দিনের আট প্রহর বোঝানোর জন্য। এই রথচক্র তাই সূর্যঘড়িরও কাজ করে।

নতুনতর ও ক্ষিপ্রতর যান চলে আসায় রথ তার সামরিক কৌলীন্য হারালেও, তার রাজকীয় ঠাটবাট বজায় থাকে বহু দিন। রাজপরিবার কত জমকালো, তা তার রথের সংগ্রহ দেখে মালুম হত।

এক বার রথের দিন বিজয়গড় ঠাকুরবাড়ি থেকে রথ বেরিয়েছে, বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে দুলকি চালে। বন্ধুরা সব যাচ্ছে দৌড়ে দড়িতে হাত লাগাতে। আমি মাকে বলছি, আমিও যাব রথের দড়ি টানতে। মা আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, যেতে দেবে না। আসলে সেই সময় জয়াপ্রদার একটা ছবি এসেছে, ‘সংযোগ’। আর এত ছবি থাকতে বাবা মাকে নিয়ে গেছে ওই ছবি দেখতে। ওতে দেখিয়েছে জয়াপ্রদা তাঁর জায়ের বাচ্চাকে নিজের পুত্রসম স্নেহ করত। তাকে নিয়ে রথের দড়ি টানতে যায়, আর ভিড়ের চাপে, রথের চাকার নীচে পড়ে শিশুটির মৃত্যু ঘটে। ব্যস, মা’র স্থির ধারণা হয়েছে, ওই পনেরো-কুড়ি জনের রুগ্ণ ভিড়ে রথ টানতে গেলেও আমার কিছু হয়ে যাবে। যেতে দিল না মানে দিলই না! চোখের সামনে দিয়ে রথ চলে গেল।

মহাকাব্যের চাকা

এই বার ঘরে থাকা হাতিটার সঙ্গে আলাপ করেই ফেলা যাক। কর্ণের রথের চাকা। ভারতীয় সাহিত্যে এ রকম মহান অবিচারের নিদর্শন আর কোথাও নেই যেন। তা যেমন শিশু অপুর মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনই যন্ত্রণা দিয়েছে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মতো দরদি বিজ্ঞানীকে।

তাই তো তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর শৈশবের নায়ককে নিয়ে কিছু লিখতে। ঠাকুর ছিলেন বিজ্ঞান-উৎসাহী এবং প্রবল ভাবে আচার্যের গুণগ্রাহী। তাই অনুরোধ ফেলতে পারলেন না, লিখলেন ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’। যা সাহিত্য হিসেবে কেমন, তার জবাব সময় দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রসঙ্গান্তর হলেও বলে রাখা উচিত, আমাদের অভিনেতা হিসেবে তৈরি হওয়ার সময় অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে একটা ছিল ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ ঠোঁটস্থ রাখা। কী ভাবে এক জন অত্যাশ্চর্য বিজ্ঞানীর অনুরোধ পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের সাহায্য করে দেয়! যাকগে, ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ নিয়ে লিখতে বসলে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ব, কর্ণের চাকায় ফিরি। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালীন চাকা যখন মাটিতে বসে যায়, কর্ণ অর্জুনকে অনুরোধ করেন তাঁকে সময় দেওয়ার। অর্জুন ভেবেছিলেন সময় দেবেন কর্ণকে তাঁর যান্ত্রিক গোলযোগ সারিয়ে নেওয়ার, কিন্তু পার্থসারথি ভাবছিলেন বৃহত্তর দৃশ্যের কথা। কারা জিতলে ন্যায়ের জয় হবে? সেই জয়ের জন্য করণীয় কী? তিনি অর্জুনকে বললেন, কোথায় ছিল ঔচিত্যবোধ, যখন কর্ণ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের উল্লাসে অংশগ্রহণে করেছিল?

অর্জুন বিবেকের দোটানা ঝেড়ে ফেলে কর্ণকে শেষ করে। কিন্তু যুদ্ধের যুক্তির কেয়ার রোম্যান্টিকরা আবার কবে করেছে? তাদের দরবারে জিতে গেছে ওই কর্ণই।

কর্ণ ও তার রথের চাকা নিয়ে আলোচনা করতে বসলে মনে রাখতে হবে তার আপাত-জন্মপরিচয়। সে সূতপুত্র। সে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অংশের সমাজের প্রতিভূ। তাই দলিত আন্দোলনে সামাজিক অসাম্য, বঞ্চনা বোঝাতে কর্ণের রথের চাকার প্রতীক ফিরে ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে দলিতদের সাহিত্যে, দলিতদের নিয়ে সাহিত্যে।

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত মরাঠি সাহিত্যিক শিবাজি সাওয়ন্তের ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কর্ণের উপর একটি আধুনিক, প্রামাণ্য কাজ। সেখানেও রথের চাকা ফিরে এসেছে ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে, আর প্রশ্ন তুলেছে এই দেশের নায়ক নির্বাচনের পদ্ধতিকে। গুরচরণ দাস তাঁর বই ‘দ্য ডিফিকাল্টি অব বিয়িং গুড’-এ কর্ণের রথের চাকাকে তুলনা করেছেন আমলাতন্ত্রের সৎ অফিসারদের সঙ্গে, যাদের এই দূষিত সিস্টেম নষ্ট করে দেয়।

বিশ্বাসভঙ্গের চাকা

আর যত দিন যাচ্ছে, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমাদের পাশে কেউ নেই, আমাদের রথের চাকা বসে যাচ্ছে। বেঙ্গালুরু জিতল, উৎসবের বীভৎস মজা কেড়ে নিল এগারো জনের প্রাণ। কারও কোনও দায় নেই? উৎসব চলল নিয়মমাফিক, মাঝখান থেকে প্রশাসনিক ব্যর্থতায় এগারোটা নাম চিরকালের মতো ‘ড্রিম ইলেভেন’-এ ঢুকে গেল। আপনি ভরসা করে প্লেনে উঠলেন, বত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় তা ভেঙে পড়ল ডাক্তারি পড়ুয়াদের ক্যান্টিনে। নিভে গেল তিনশো স্বপ্ন। পুণের কাছে সেতু ভেঙে পড়েছে, কেদারে কপ্টার। আমাদের নেতা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে আমাদের পুলিশকে, এই যুদ্ধক্ষেত্রে এক জন সাধারণ মানুষ কী ভীষণ অসহায়, তাই না? তার মধ্যে এক দল ব্যাকগ্রাউন্ডে ভজন লাগিয়ে রিল শেয়ার করছে, একটি গীতা অক্ষত আছে। বলি, কোন ঠাকুরের পুজো করেন বলুন তো এঁরা? এতগুলো শবের উপর তো শ্মশানচারী তান্ত্রিকরাও সাধনা করতে ভয় পাবেন। এ সব ভয়াবহ দুর্ঘটনা, কার দায় জানি না, দিচ্ছিও না কারও উপর, শুধু দেখতে পাচ্ছি নাগরিক হিসেবে আমাদের চাকার চার পাশে চোরাবালির স্রোত বেড়েই চলেছে, আমরা শুধু অসহায় চোখে দেখছি আমাদের চাকার বিশ্বাসঘাতকতা।

আধ্যাত্মিকতার চাকা

বৌদ্ধ ধর্মেও কম মাহাত্ম্য নেই চক্রের। বুদ্ধের ধর্মচক্রে চব্বিশটি স্পোক আছে। যার বারোটি নির্দেশ করে মানবজীবনের যন্ত্রণার বারোটি কারণের দিকে। পরের বারোটি সেই কারণ অপসারণের মাধ্যমে নির্বাণের পথ প্রদর্শন করে। বলা হয়, অশোকচক্র বা বুদ্ধের ধর্মচক্রের চব্বিশটি নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে, মানুষের জন্ম-মৃত্যুর ক্রমাগত চক্র থেকে মুক্তি, যার অপর নাম নির্বাণ। আমাদের অবিদ্যাজনিত, স্পর্শজনিত, তৃষ্ণাজনিত, জরাজনিত যাবতীয় সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে এক পৃথিবীর নির্দেশ দেয় সিদ্ধার্থের এই ধর্মচক্র। সেখানে অন্ধকার দূর করতে বাইরের আলোর প্রয়োজন হয় না। ‘আত্মদীপ ভব’— অর্থাৎ আত্মা স্বয়ং প্রজ্জ্বলিত দীপ হয়ে পথ দেখায়। স্ব-ইন্দ্রিয়কে সঠিক পথে চালনার মাধ্যমে যদি আদর্শ জীবনযাপন করা যায়, তবেই পাওয়া যাবে আলোর ঠিকানা। মনে রাখতে হবে, বৌদ্ধমতে ইন্দ্রিয় কিন্তু ছ’টি। বাকি পাঁচটির সঙ্গে মনও ইন্দ্রিয়াধীন, তাকে বশ করতে হবে সবার আগে। মনকে নিয়ে যেতে হবে হিংসা, দ্বেষমুক্ত শান্তির নদীতীরে। তবে মিলবে পারানির কড়ি। না হলে বৃথা এ যাওয়া আর আসা।

সিদ্ধার্থের শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক এই ধর্মচক্র, যা কিনা জ্ঞানার্জনের পথে এক আলোকবর্তিকাস্বরূপ। তা মানুষের জীবনের চক্রাকার আবর্তনকেও চিহ্নিত করে। তাই এই ধর্মচক্র ফিরে ফিরে এসেছে পাশ্চাত্য সাহিত্যে। তাকে যুগে যুগে সাহিত্যিক, দার্শনিকরা ফিরে ফিরে দেখেছেন আধ্যাত্মিক, দার্শনিক এমনকি আর্থ-সামাজিক আতশকাচের মধ্য দিয়ে।

হারমান হেস-এর ‘সিদ্ধার্থ’-এর কথা মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে। সেখানে পুনর্জন্ম, কর্ম, মুক্তি গল্পের বিষয় হিসেবে ফিরে ফিরে এসেছে, যা ধর্মচক্রের কথা বলে। নদী এখানে বহমান, চলমান, চক্রের রূপক ধারণ করেছে। এটি পরবর্তী কালে আইভরি মার্চেন্টের ছবি হয়। নায়ক হন শশী কপূর।

জ্যাক কেরুয়াক এর ‘দ্য ধর্মা বুমস’-এ বুদ্ধের শিক্ষা ও ধর্মচক্রকে বিট জেনারেশনের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে। ভিয়েতনামী সন্ত থিচ নহাত হান তাঁর বিভিন্ন লেখায় ধর্মচক্রকে আবার রোজকার ধ্যানের রূপক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

ধর্মচক্র: সারনাথে পাঁচ জন শিষ্যকে উপদেশ দিয়ে প্রথম ধর্মপ্রবর্তন শুরু করেন গৌতম বুদ্ধ।

ধর্মচক্র: সারনাথে পাঁচ জন শিষ্যকে উপদেশ দিয়ে প্রথম ধর্মপ্রবর্তন শুরু করেন গৌতম বুদ্ধ।

সলমন রুশদি থেকে অ্যালান ওয়াটস, এমনকি মারভেল কমিক্স-এর ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ’-এও ধর্মচক্রের ইঙ্গিত মেলে।

মনোবলের চাকা

আসলে এটা আলোর দিকে যাওয়ার রোজকার চেষ্টা। যে কারণে এখানে বলা হচ্ছে, এক জন জ্ঞানীর জীবন আসলে এক যাত্রীর জীবন। কারণ এক জন যাত্রীর চেয়ে জ্ঞানী কেউ হতে পারে না। আবার এই যাত্রার মজা হচ্ছে, এখানে পরের দিন আগের দিনের চেয়ে কিছুটা পথ বেশি হাঁটা যায়, হাঁটাই দস্তুর। একটা সময়ের পর আর পথনির্দেশ লাগে না, চড়াইয়ের কষ্ট কমে যায়। আর আলোর গল্প, শান্তির ছায়ায় শুনতে ভাল কার না লাগে? তাই এক জন আলোর যাত্রীর পথনির্দেশিকায় পড়ে থাকা নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে নিলে তা হয় পরবর্তী প্রজন্মের শস্য। কী ভাবে? চলুন বলি।

অ্যাপার্থাইড-এর সময় সাতাশ বছর জেলে ছিলেন মাডিবা। মাডিবা হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, আর অ্যাপার্থাইড হল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষমূলক এক ধরনের শাসনব্যবস্থা। যা বলে দিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ ব্যতীত বাকি সবাই মনুষ্যেতর প্রাণী। কিন্তু সবার আদরের মাডিবা এই সরল সমীকরণ মানতে চাননি, তাঁর মনে হয়েছে সূর্য যদি সবার সমান হয়, অক্সিজেন যদি সবার ভাগে এক থাকে, তা হলে অধিকারের হেরফের কী যুক্তিতে? তিনি ঝাঁপ দিলেন বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনে।

সেই সময় গোটা পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে। আন্দোলনকারীদের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের উপহার ‘নেকলেস’। নেকলেস হচ্ছে হাত বেঁধে গায়ে টায়ার পরিয়ে দাহ্যপদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। সামান্য মনোরঞ্জন। সেই সময় দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ম্যান্ডেলার জেল হল। ১৯৬৪-১৯৮২ সাল, আঠারো বছর ম্যান্ডেলা রবেন আইল্যান্ডে একটি সাত ফুট বাই আট ফুটের ঘরে বদ্ধ অবস্থায় কাটিয়েছেন, দিনের পর দিন শ্বেতাঙ্গ কারারক্ষীদের দ্বারা নিগৃহীত হতে হতে। তার পর বিভিন্ন জেল ঘুরে তিনি ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, সাতাশ বছর পর বাইরে বেরোলেন, বা বলা ভাল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁকে বার করতে বাধ্য হল তদনীন্তন শাসক। পৃথিবী বদলাচ্ছিল, আর সেই বদলটা সবার আগে রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পেলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এটা ছিল বর্ণবিদ্বেষ-উত্তর নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা। তিনি সে দেশের প্রথম নির্বাচিত কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান। এ দিকে রায়ট অশান্তি ক্রমশ বাড়ছে, কারণ বিশ শতকের শেষার্ধে তাদের পাওয়া এই স্বাধীনতা এসেছে অনেক ‘নেকলেস’-এর বিনিময়ে। যার ফলে বাড়ছে লুঠতরাজ। কিন্তু হিংসা তাঁর পথ নয়, ছিলও না কোনও দিন।

ঘটনাচক্রে তিনি স্পোর্টস কমিটির মিটিংয়ে গেছেন, সেই সময় দেখলেন দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডের রাগবি খেলা হচ্ছে। কিন্তু কিছু স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেমেয়ে ইংল্যান্ডকে সমর্থন করছে। রাগবিতে কখনও কৃষ্ণাঙ্গদের ঢুকতে দেয়নি দক্ষিণ আফ্রিকা। এমনকি সমর্থন করতে স্টেডিয়ামেও নয়। কিন্তু নেলসন জানতেন, দেশকে জুড়তে এবং বিদ্বেষকে মুছে ফেলতে খেলার কোনও বিকল্প নেই।

আর এক বছর পর রাগবি বিশ্বকাপ, দক্ষিণ আফ্রিকায় হচ্ছে। নেলসন ম্যান্ডেলা নবনির্মিত কৃষ্ণাঙ্গ স্পোর্টস কমিটিকে রাজি করালেন এই আপাদমস্তক শ্বেতাঙ্গ খেলাটিকে সমর্থন করতে। আর অধিনায়ককে ডেকে বললেন, “আমি শ্বেতাঙ্গ অপশাসনের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ অপশাসন চাইনি, আমি চেয়েছি সমান অধিকার। এ দেশ আমার পূর্বপুরুষের দেশ। এর নাম রামধনুর দেশ, সেখানে সব রং মিলেমিশে থাকবে। তোমাকে জিততে হবে এই বিশ্বকাপ, পারবে?”

তখন অধিনায়ক সত্যিটা বলেন যে অস্ট্রেলিয়া, নিউ জ়িল্যান্ড-এর মতো দলের সামনে তাঁদের সুযোগ ক্ষীণ। তখন ম্যান্ডেলা তাঁকে বলেন সেই কবিতাটি, যা কি না রবেন আইল্যান্ডের সাত বাই আটের কারাকুঠুরিতে তিনি নিয়মিত বলতেন। কবিতাটি— ‘ইনভিক্টাস’, কবি উইলিয়াম আর্নেস্ট হেনলি। আমার মতো অর্বাচীনের তর্জমায় ‘অপরাজেয়’ নাম দিয়ে অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়—

যখন রাতের আলকাতরার চাদর আমায় জড়িয়ে ফেলতে চায়

আমি চিরঋণী কারণ আমার অপ্রতিরোধ্য আত্মা আমার পথ আটকে দাঁড়ায়

পরিস্থিতির আঁচড়ে কেটেছে কম নয়, সহ্যকরেছি সহ্যাতীত

অঘটনের কৃপায় মাথা রক্তাক্ত, তবে তাঝোঁকেনি এখনও

ধ্বংসস্তূপ প্রশ্নাতীত

এমনকি

কান্নাও থামেনি এখনও

হ্যাঁ শীতের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিতে পারে? কিন্তু যন্ত্রণারও তো সালতামামি আছে

তার চৌকাঠ পেরিয়েও দেখতে পাবে, এখনওএকটু সাহস আছে

এর পর জানি না ভাগ্যে কী আছে, রায় কীদেবেন ঈশ্বর

আমার নরক আমারই, স্বর্গেও রয়েছে ঘর

তার পর নেলসন ম্যান্ডেলা অধিনায়কের কাঁধ ধরে বলেছিলেন, “আঠারো বছর একটা সাত বাই আট ফুট মাপের জেলে নিগৃহীত হয়েছি, আমার বন্ধু-স্বজন শুধু মৃত ব্যক্তির সংখ্যা হয়ে পৌঁছেছে জেলে, আমার পক্ষে সবচেয়ে সহজ ছিল ঘৃণা, হিংসা। কিন্তু হিংসা আমার পথ হতে পারে না। তা আমি শিখিনি, আমার পূর্বসূরিরা শেখাননি। কিন্তু আমার পাশে কবিতাটা ছিল, সবার পাশে নেই। তাদের প্রবল ক্ষোভ, রাগ। এ মেটাতে পারে খেলা, এ মেটাতে পারে আমাদের সুর। এখানে আমার রাজনীতির এক্তিয়ার শেষ।”

দক্ষিণ আফ্রিকা সে বার বিশ্বকাপ জেতে। এবং এই জয় সহজাত ভাবেই ছড়িয়ে যায় সবার মধ্যে।

চক্রবৎ পরিবর্তন্তে

তবে হ্যাঁ, সব খেলায় এত সহজে জয় হয়নি। বিশেষত যে খেলার জন্য আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে চিনি, তাতে তো একেবারেই নয়। আজও পাড়ার কোনও দাদা রাতবিরেতে হুট করে উপর থেকে বৌদির ছোড়া চাবি মাতাল অবস্থায় ধরে ফেললে, পাড়ার ছেলে টিটকিরি দেয় ‘কাকু তো পুরো জন্টি!’ এই জন্টি রোডস, অ্যালান ডোনাল্ড, ডেল স্টেন, ফাফ, এবি ডিভিলিয়ার্স, জাক কালিস, কত নায়কের জন্ম দিয়েছে এই দেশ। অথচ আইসিসি ট্রোফির ভাঁড়ার ছিল শূন্য। কত বার জেতা ম্যাচ হেরে ‘পার্মানেন্ট চোকার্স’-এর তকমা গায়ে সেঁটে গেছে। তারা এত বছর পর প্রথম বার কোনও চ্যাম্পিয়নশিপ জিতল টেম্বা বাভুমা নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদের অধিনায়কত্বে। কাগিসো রাবাডা, লুঙ্গি এনজিডি, এইডেন মার্করাম, কেশব মহারাজের দেশ এই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট টিম আজ সত্যি রামধনুর দেশ। যেমনটা, মাডিবা চেয়েছিলেন। একেই বলে ধর্মচক্র, বুঝলেন? বুঝতে পারছেন না? আচ্ছা খোলসা করি, নেলসন ম্যান্ডেলা এক জন সাবুত কেরেস্তান মানুষ, তাঁর সঙ্গে বুদ্ধের ধর্মচক্রের সম্পর্ক কী? আরে, নেলসন ম্যান্ডেলা তো পূর্বসূরিদের কথা বলেছেনই। এবং সেই পূর্বসূরিদের এক জন হলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী, যিনি প্রাথমিক ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় অহিংসার মন্ত্র ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিলেন। এবং মহাত্মা গান্ধী বার বার বলেছেন, তাঁর এই অহিংসার তত্ত্ব তাঁর নয়, তা একান্তই বুদ্ধের। তিনি বুদ্ধ দ্বারা এবং তাঁর ধর্মচক্রের ত্যাগ-তিতিক্ষার আদর্শ দ্বারা, ইন্দ্রিয়সুখ থেকে মুক্তির পথ দ্বারা সারা জীবন অনুপ্রাণিত থেকেছেন। আজ যখন বাভুমাকে ঘিরে ওঁর শ্বেতাঙ্গ ‘বন্ধুরা’ বেলা চাও-এর সুরে তাঁর বন্দনাগীত গাইতে গাইতে তাঁকে আর রাবাডাকে উদ্‌যাপন করতে নিয়ে যাচ্ছেন, তখন তো ওটা আর বাস থাকছে না, ওটা রামধনু দেশের সূর্যরথ হয়ে যাচ্ছে, যার সামনে সাতটা ঘোড়া সপ্তাহের সাত দিনের প্রতীক। “কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।/ তারি রথ নিত্যই উধাও/ জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,/ চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।”— আপনি রথচক্রের চলে যাওয়া শুনতে পাবেন, আবার সময়ের বয়ে যাওয়াও বুঝতে পারবেন। এখানে আবার ঢুকে গেলেন ব্রহ্মবাদী রবিবাবু! বলছি না, সবটাই চক্র!

একটা শিশু খিদিরপুর বাজার থেকে বেরিয়েছে, তার হাতের খেলনা মাটির জগন্নাথ নিয়ে। অঝোর বৃষ্টি তার জগন্নাথকে গলিয়ে দিতে পারলেও থামাতে পারছে না তার বাবার বাজারে লেগে যাওয়া আগুন। এ দিকে স্বামীজি শিকাগো থেকে ফিরেছেন বলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে খোলা রথে করে শোভাবাজার দিয়ে... শিশুটি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল স্বামীজির উদ্দেশে, “খুব বৃষ্টি পড়ছে, আমার বাবা দারুনির্মিত জগন্নাথ কিনে দিতে পারেননি, আমার জগন্নাথ মাটির, তা গলে যাচ্ছে, তাকে রাখব কোথায়? দিঘায় না পুরীতে?”

স্বামীজি প্রথমে ম্যান্ডেলা হয়ে যান, তার পর বুদ্ধ, সব শেষে স্বপ্ন ভাঙলে মনে পড়ে— আমি রথের ওই গলে যাওয়া ছোট্ট জগন্নাথের বাতাসা কুড়ি জনকে বিশ্বাসভরে ভাগ করে দিয়েছিলাম।

এই বিশ্বাসটুকুই!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ratha Yatra 2025

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy