উলুবেড়িয়ার এই ভাতের হোটেলে উত্তমকুমার কখনও খেতে আসেননি। শুধু ভাল লাগা থেকেই উত্তমকুমারের ছবি, তাঁর সিনেমার নানা জনপ্রিয় গানে অসাধারণ উপভোগ্য এক আবহ তৈরি করেছেন ঘোষ পরিবারের নতুন প্রজন্ম। নুরুল আবসার
মহানায়ক উত্তমকুমার মারা গিয়েছেন পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। এই পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে মহানায়ক-বন্দনায় ছেদ পড়েনি উলুবেড়িয়ার ঘোষ পরিবারের। উলুবেড়িয়া শহরে তাঁদের একটি ভাতের হোটেল আছে। মহকুমা আদালতের পাশেই ওটি রোডের ধারে অবস্থিত এই হোটেলে যাঁরা প্রায় রোজই খেতে আসেন, তাঁদের সিংহভাগ মহকুমা আদালতের আইনজীবী। একেবারেই আটপৌরে ভাতের হোটেল এটি। তবে খাবারের মান বেশ ভাল। ফলে খদ্দেরের অভাব হয় না। তার সঙ্গে খদ্দেরদের অতিরিক্ত পাওনা হল মহানায়কের জাদুস্পর্শ। সারা হোটেলের দেওয়াল জুড়ে আছে মহানায়কের ছবি। কোথাও তিনি একক, আবার কোনও ছবিতে তিনি সুচিত্রা সেনের সঙ্গে একই ফ্রেমে। আরও আছে! এখানে যাঁরা খেতে আসেন তাঁদের কানে আসে মহানায়ক অভিনীত ছায়াছবির গান। কখনও তাঁরা শোনেন ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক’, আবার কখনও তাঁদের কানে আসে ‘অমানুষ’ ছবির ‘না না তুমি এমন করে দাগা দিয়ে সরে যেয়ো না’। এই সব গান চলতেই থাকে সারা দিন ধরে, যত ক্ষণ হোটেল খোলা থাকে। হোটেলে খেতে আসা প্রবীণ, প্রৌঢ় মানুষজন ডুবে যান উত্তমকুমারের স্মৃতিতে।
হোটেলটির বয়সও একশো বছর ছুঁই-ছুঁই। আমতার কুশবেড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা নগেন্দ্রনাথ ঘোষ উকিলপাড়া নামে পরিচিত এই এলাকায় হোটেলটি চালু করেন। প্রথমে নাম ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন হিন্দু হোটেল। পরে নগেন্দ্রনাথের সন্তান চিত্তরঞ্জনের জন্ম হলে ছেলের নামে তিনি হোটেলের নাম দেন চিত্তরঞ্জন হিন্দু হোটেল। সেই নামেই এখন হোটেল চলছে। যত দিন জীবিত ছিলেন, এই হোটেলে বসতেন নগেন্দ্রনাথ। পরে বসেন চিত্তরঞ্জন। তবে একই সঙ্গে তিনি মহকুমা আদালতে মুহুরির কাজও করতেন। ফলে তিনি সব সময় হোটেলে বসতে পারতেন না। ছেলে জপনকুমারকে ব্যবসায় বসিয়ে দেন। পড়াশোনার পাশাপাশি জপন হোটেলের কাজও শুরু করে দেন এখন থেকে দু’দশক আগে। তিনি আসার পর থেকে হোটেলের অঙ্গসজ্জা বাড়ে। দেওয়ালে বসে রঙিন পাথর। মহানায়কের মৃত্যু হয় ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই। সেই থেকেই হোটেলে থাকত তাঁর ছবি। তখন নগেন্দ্রনাথ জীবিত। নগেন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পরে চিত্তরঞ্জনও মহানায়কের ছবি বহাল রাখেন। জপন আসার পরে মহানায়কের ছবির সংখ্যা বাড়ে। যেখানে জপন বসেন, সেই ক্যাশ কাউন্টারের মাথার উপরে ঝোলানো হয় একই ফ্রেমে উত্তম-সুচিত্রার পাশাপাশি তিনটি ছবি। এ ছাড়াও হোটেলের দেওয়াল ভরে দেওয়া হয় কোথাও উত্তমকুমার, কোথাও উত্তম-সুচিত্রার ছবিতে। চালু হয় উত্তমের ছবির গান বাজানো। শুধু তাই নয়, উত্তমকুমারকে নিয়ে লেখা একাধিক জীবনীগ্রন্থ আছে জপনের ড্রয়ারে। অবসর সময়ে সেই সব বই পড়েন তিনি। মনে রাখতে হবে, যে সময় এই ভাতের হোটেলে মহানায়কের স্মৃতিবাহী আবহ রচিত হয়, তখন কিন্তু শহরেও পরিচিতি পায়নি থিম-রেস্তরাঁর কনসেপ্ট। খাওয়ার পরিবেশকে ভাল লাগার মোড়কে মুড়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টা তখনকার নিরিখে অভিনব।
এই হোটেলে খেতে আসেন আইনজীবী হারু দোয়ারি, রেজাউল করিমরা। হারু বলেন, “চিত্তরঞ্জন হোটেলের মালিকদের সবাই উত্তমপ্রেমী। আমরা যারা এখানে খাওয়াদাওয়া করি, সবাই জানি। আমরা চিরকালই উত্তমকুমারের সিনেমায় বুঁদ হয়ে থাকতাম, ফলে এটা আমাদের কাছে বড় পাওনা।”
মহানায়কের সঙ্গে একটা সময়ে হাওড়ার সরাসরি সম্পর্ক ছিল। জগৎবল্লভপুরের গোহালপোতা গ্রামে ছিল সিনেমা ব্যবসায়ী সত্যনারায়ণ খানের বাড়ি। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা সংস্থা চণ্ডীমাতা ফিল্মসের মালিক। সেই সূত্রে তিনি বহু ছবির আউটডোর শুটিং করেছিলেন গোহালপোতা গ্রামে। তাঁর প্রযোজিত ও পরিবেশিত অনেক ছবির নায়ক ছিলেন উত্তমকুমার। যেমন ‘ধন্যি মেয়ে’। এই ছবির বহির্দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল গোহালপোতায়। শুধু চণ্ডীমাতা ফিল্মস নয়, অন্য ব্যানারের ছবির শুটিংও হয়েছে গোহালপোতা গ্রামে। যেমন ‘বনপলাশীর পদাবলী’। শিল্পী সংসদ প্রযোজিত এই ছবির পরিচালক ছিলেন মহানায়ক স্বয়ং। তিনি দফায় দফায় প্রায় এক মাস ধরে এখানে এসেছিলেন ছবির শুটিং করতে। মহানায়কের সঙ্গে সত্যনারায়ণের যে সখ্য ছিল, তার সৌজন্যেই তিনি এখানে আসতেন। মহানায়কের এই গ্রামে আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার সম্পর্ক ছিল অন্তত তিন দশকের। তিনি থাকবেন বলে সত্যনারায়ণ তিন তলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। এই বাড়ির সুযোগ-সুবিধা ছিল সেই সময়কার তিনতারা হোটেলের মতো। সত্যনারায়ণ মারা যান ১৯৭৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর পরও উত্তমকুমার এই গ্রামে এসেছেন। শেষ বার এসেছেন ১৯৭৯ সালে ‘প্রতিশোধ’ ছবির শুটিং করতে।
যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, তা আজ কার্যত পরিত্যক্ত। তাঁর স্মৃতিরক্ষার জন্য সরকারি বা বেসরকারি ভাবে কিছুই করা হয়নি বলে অভিযোগ। শুধু এলাকার প্রবীণ মানুষদের মনের মধ্যে থেকে গিয়েছেন মহানায়ক। তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্মরণ করার তেমন কোনও উদ্যোগ গোহালপোতায় দেখা যায়নি। কিন্তু তারই বিপরীত ছবির দেখা মেলে উলুবেড়িয়ার এই ছোট হোটেলটিতে। এই হোটেল তো দূর অস্ত, উলুবেড়িয়াতেই মহানায়ক কস্মিনকালেও এসেছিলেন, তেমন কোনও খবর নেই। তবুও উত্তমকুমারকে বছরের পর বছর ধরে স্মরণ করায় কোনও ছেদ পড়েনি ঘোষ পরিবারের।
উল্টে ঘোষ পরিবারের এমন এক জনের হাত ধরে উত্তম-স্মরণ গত কুড়ি বছর ধরে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে, যার জন্মই হয়েছে মহানায়কের মৃত্যুর সাত বছর পরে। আজকের আটত্রিশ বছর বয়সি জপনকুমার, আঠারো বছর বয়সে যখন হোটেলে বসতে শুরু করেন, তখন থেকে শুরু হয়েছে সিনেমার সঙ্কটও। একের পর এক ঝাঁপ বন্ধ করেছে সিনেমাহলগুলি। ফলে হল-এ গিয়ে উত্তমকুমারের ছবি দেখার সুযোগ ঘটেনি তাঁর। টেলিভিশনেও যে তিনি খুব একটা উত্তমকুমারের ছবি দেখেননি, তা নিজের মুখেই স্বীকার করেন জপন। তবুও উত্তম-বন্দনাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে তাঁর উৎসাহে ঘাটতি নেই। শুধু উত্তমকুমারের ছবি ঝোলানোই নয়, সব ছবিতে তিনি নিয়মিত মালা দেন, এবং তা চলছে কুড়ি বছর ধরে বিরামহীন ভাবে। মহানায়কের মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও একটি পরিবার যে ভাবে উত্তম-বন্দনা করছে, তার কারণ অনুসন্ধানে মহানায়ককে নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁরা আগ্রহী হতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে কী বলছেন জপনকুমার নিজে? তাঁর কথায়, “দেখুন, উত্তমকুমারের সিনেমা আমি খুব বেশি দেখিনি। তবুও যতগুলি দেখেছি, তাতেই আমি সম্মোহিত হয়েছি। তাঁর ছবির দিকে তাকালে আমি কেমন যেন হয়ে যাই! মনে হয়, উত্তমকুমারের মতো কেউ ছিলেন না। এখনও নেই। ভবিষ্যতেও হবেন না। তিনি এক জনই।”
মহানায়কের মৃত্যুর কিছু দিন পরেই তাঁকে নিয়ে আয়োজিত স্মরণসভায় সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “বাংলা ছবির জগতে উত্তমকুমারের মতো কেউ আসেননি। ভবিষ্যতেও আসবেন না।” কাকতালীয় ভাবে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালকের সেই মন্তব্যেরই যেন প্রতিধ্বনি শোনা গেল উলুবেড়িয়ার এক অখ্যাত হোটেল ব্যবসায়ীর কথায়!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)