Advertisement
E-Paper

মিষ্টি বলতে মুড়ি + চিনি

আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগত এলেই তাঁকে বা তাঁদের প্লেটভর্তি মিষ্টি দেওয়া হয়। আর তার জন্য আমরা, ছোটরা সর্বদাই প্রস্তুত থাকতাম। বাড়িতে কেউ এলেই আমাদেরই পয়সা নিয়ে নিকটবর্তী মিষ্টির দোকানে ছুটতে হত। নিয়মের বড় একটা ব্যত্যয় হত না।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগত এলেই তাঁকে বা তাঁদের প্লেটভর্তি মিষ্টি দেওয়া হয়। আর তার জন্য আমরা, ছোটরা সর্বদাই প্রস্তুত থাকতাম। বাড়িতে কেউ এলেই আমাদেরই পয়সা নিয়ে নিকটবর্তী মিষ্টির দোকানে ছুটতে হত। নিয়মের বড় একটা ব্যত্যয় হত না। আর তখনকার অতিথিরাও ছিলেন ভারী লক্ষ্মী। অম্লানবদনে প্লেট সাফ করে দিতেন। এখনকার অতিথিরা তো খাবার দেখলেই আঁতকে ওঠেন। কারও সুগার, কারও হাই ট্রাইগ্লিসারাইড, কারও হাইপার অ্যাসিডিটি। ময়মনসিংহ ছেড়ে যখন আমরা রেলের নির্বাসনে চলে গেলাম, তখনও ট্র্যাডিশন বড় একটা বদলায়নি। বাড়িতে অতিথি এলে খেতে দিতে হবেই। তবে কাটিহারে তেমন ভাল মিষ্টির দোকান ছিল না। আর আমরা যেখানে থাকতাম, সেই সাহেবপাড়া থেকে দোকানপাট অনেক দূর। মা’কে তাই চিঁড়েভাজা, ওমলেট, নাড়ু-তক্তি, হালুয়া বা পায়েসের ব্যবস্থা করতে হত। শুধু চা-বিস্কুট দিয়ে বিদায় করলে নিন্দে রটত।

ব্যতিক্রম ছিল টকু-বুধোদের বাড়ি। সাহেবপাড়ারই এক প্রান্তে তাদের বাংলো। টকু-বুধোর বাবার চাকরিটাও বেশ ভালই।

কাটিহারে আমার জেঠিমা এসে কিছু দিন ছিলেন। আমি জেঠিমাকে ‘বমা’ বলে ডাকতাম। বড়মা’র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ আর কী! তা, বমা নতুন জায়গায় এসে প্রায়ই পাড়া বেড়াতে বেরিয়ে পড়তেন। আমি তাঁর সফর-সঙ্গী। আমাকে না নিয়ে কোথাও যেতেন না। তা, যে বাড়িতেই যাই, সেই বাড়িতেই সবাই খুব সমাদর করেন। আদর করে বসান, খাতির করেন, প্লেটভরা মিষ্টি বা নানা মুখরোচক খাবার সাজিয়ে দেন। বমা বিশেষ খেতেন না। কিন্তু আমি রাম-পেটুক। চোখের পলকে প্লেট সাফ করে ফেলি এবং বমা খুব গোপনে নিজের প্লেট থেকেও আমাকে খাবার তুলে দেন।

এক বার বমার সঙ্গে টকু-বুধোদের বাড়ি বেড়াতে গেছি। তাঁরাও মুখে যথেষ্ট সমাদর করলেন। গল্পগাছাও বিস্তর হতে লাগল। কিন্তু খাবারের প্লেট আর আসে না। হা-পিত্যেশ করে বসে থেকে থেকে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে লাগল। আমি বমার শাড়ির আঁচল ধরে টানাটানি শুরু করলাম। বমা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অবশেষে বাধ্য হয়ে বলে ফেললেন, ‘আগো, আমাগো পোলার তো বড় ক্ষুধা পাইছে। তোমরা পোলাটারে খাওনের কিছু দেও।’

এই শুনে টকু-বুধোর মা বেজার মুখে উঠে গিয়ে একটা বাটিতে খানিকটা তেলমাখা মুড়ি নিয়ে এসে আমার হাতে বাটিটা দিলেন। সাত-আট বছর বয়সি একটা ছেলের কাছে তেলমাখা মুড়ির চেয়ে অখাদ্য আর কী-ই বা হতে পারে। সুতরাং, ফের বমার আঁচল ধরে টান। বমা বুদ্ধিমতী। ব্যাপারটা আঁচ করে বললেন, ‘আগো, তোমাগো ঘরে মিষ্টি কিছু নাই?’ তখন টকু-বুধোর মা সেই মুড়িটাই খানিকটা চিনি মিশিয়ে ফের এনে দিলেন।

বাড়ি ফিরে এসে বমা’র কী রাগ! এমন পিচাইশা বাড়ি আর দেখি নাই। বাচ্চাটারে একটা মিষ্টিও দিতে পারল না!

তখনই জানা গেল, টকু-বুধোদের বাবা খুব কৃপণ লোক। তাঁর শাসনে বাড়িতে সব রকম বাজে খরচ বন্ধ। ভিখিরিরাও ও-বাড়ি এড়িয়ে চলে।

টকু আর বুধো দুই ভাই আমারই প্রায় সমবয়সি। সুতরাং আমাদের বন্ধুত্ব হতে বেশি দেরি হল না। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন এবং বাঁদরামির সূত্রেই আমাদের সাহেবপাড়ার ছেলেদের গলায় গলায় ভাব। এক-এক দিন এক-এক জনের বাড়িতে খেলা হত। সেই সূত্রেই ওদের বাড়িতেও যেতে হত আমাকে।

এক দিন জল খেতে টকু আর বুধোর বাড়ির ভেতরে ঢুকেছি। দেখি, টকু-বুধোর বাবা গম্ভীর মুখে বাইরের ঘরে বসে আছেন। গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। মাথায় খোঁচা খোঁচা খাড়া চুল! তখন বাবাদের আমরা খুব ভয় পেতাম। সে নিজের বাবাই হোক, বা পরের বাবা। টকু-বুধোর বাবা আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, এই যে বাবা রুণু, তোমাদের বাড়িতে মাসে ক’সের সরষের তেল লাগে বলো তো?

মাসে ক’সের সরষের তেল লাগে, তা আমার জানার কথাই নয়। কিন্তু ভাবলাম, কী জানি, জানি না বললে যদি ভদ্রলোক রেগে যান! তা ছাড়া বরাবরই আমি একটু বোকাসোকা গোছের। কোথায় কী বলতে হয়, তা ঠিক করে উঠতে পারি না। আমি আকাশপাতাল ভেবে সম্পূর্ণ আন্দাজে বলে দিলাম, দশ সের।

কাউকে ও রকম আঁতকে উঠতে আমি কদাচিৎ দেখেছি। উনি হাঁ হয়ে আমার দিকে খানিক ক্ষণ চেয়ে থেকে বিড়বিড় করতে লাগলেন, দশ সের! দশ সের! না, না, না, না। এ তো খুব অন্যায় কথা! এ তো একদম ঠিক নয়!

আমিও একটু থতমত খেয়ে গেছি। বেশি বলে ফেললাম, না কি কম হয়ে গেল, তা বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ উনি বোমার মতো ফেটে পড়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, তোমার মা কি তেল দিয়ে আঁচান?

সেই রাগ দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে আসি। বাড়ি ফিরে মা’কে ঘটনাটা বলতেই মা বলল, সে কী! এইটুকু ছেলের কাছ থেকে কেউ তেলের হিসেব চায়? আর তুই-ই বা অত হাঁদা কেন? বলতে পারলি না যে তুই ওসব জানিস না!

বমা শুনে চেঁচামেচি জুড়ে দিল, আরে ওইটা তো একটা পিচাশ। খাড়াও, আমি গিয়া কইয়া আমু, মশয়, শুধু আচাই না, আমরা ত্যাল ঢাইল্যা ছানও করি। তাতে আপনের কী! আইজই আমি গিয়া হারামজাদারে দুই কথা শুনাইয়া আমু। পোলাপানের কাছে তার বাড়ির খবর জানতে চান, কেমন ভদ্রলোক মশয়? যে দিন পোলাটারে ত্যাল মুড়ি খাইতে দিছিল, হেইদিনই বুঝছিলাম অরা প্যাতনা পিচাশ।

শেষ পর্যন্ত বমাকে টকু-বুধোদের বাড়িতে হানা দিতে দেওয়া হয়নি। তাতে দু’বাড়ির সম্পর্ক বিগড়ে যেত। বাবা অতি সৎ মানুষ। জীবনে ঘুষ খাননি। কাজেই আমাদের একটু টানাটানিরই সংসার। ঘটনাটা শুনে বাবা বললেন, ঠিকই তো কইছে। রুণুর মায়ের ত্যাল খরচের বহর তো কম না।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy