Advertisement
E-Paper

টাইম মেশিন

দেশে ‘নীরবতা পালন করুন’ বা ‘সাইলেন্স প্লিজ’ কথাটি বাতিল বলে ঘোষণা করা হল। ‌কারণ, শব্দবন্ধটি প্রয়োজন হারিয়েছে। মানুষ এখন স্বরযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। মুঠোফোনের দৌলতে সবাই এখন আঙুলের কারসাজিতেই কথা বলতে অভ্যস্ত। বিশাল হলঘর বা অনেক মানুষের জমায়েতও এখন শব্দদূষণহীন।

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০

দেশে ‘নীরবতা পালন করুন’ বা ‘সাইলেন্স প্লিজ’ কথাটি বাতিল বলে ঘোষণা করা হল। ‌কারণ, শব্দবন্ধটি প্রয়োজন হারিয়েছে। মানুষ এখন স্বরযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। মুঠোফোনের দৌলতে সবাই এখন আঙুলের কারসাজিতেই কথা বলতে অভ্যস্ত। বিশাল হলঘর বা অনেক মানুষের জমায়েতও এখন শব্দদূষণহীন। কারণ, বক্তা তাঁর বক্তব্য স্মার্টফোনে লিখে, গ্রিনটুথের মাধ্যমে অডিয়েন্সের স্মার্টফোনে শেয়ার করে দেন। একই কারণে, স্কুল-কলেজ, বাজার, রেস্তরাঁ সব জায়গাই শব্দশূন্য। ছুঁচ পড়লেও সবাই চমকে ওঠে। মিছিল-মিটিং সবখানেই স্বরযন্ত্রের প্রয়োজন শেষ। নেতা ও সমর্থক, প্রত্যেকেই নিজের মত প্রকাশ করেন এখন ‘অঙ্গুলি হেলনে’। মিছিলে সকলে স্লোগান টাইপ করতে করতে যায়, প্রযুক্তিতে চড়ে সে কথা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বাড়ি ও রাস্তার লোকের ফোনে। রাস্তায় কোনও গাড়ি এলে হর্ন বাজায় না, ফোনে সিগনাল পাঠায়। শোক-দুঃখ, আনন্দ সবই লিখে জানানো হয় বা স্মাইলি এঁকে বোঝানো হয়। আগে যাঁরা কানের সমস্যার জন্য নানা অসুবিধা ভোগ করতেন, তাঁরাও এখন আর ইএনটি ডাক্তারের কাছে যান না। চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে কান বিভাগটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক কানের ডাক্তাররা ছাড়াও যাঁদের অন্যের কথায় কান পাতা অভ্যেস, তাঁরা বেশ একটু অসুবিধায় পড়ে গেছেন। তাঁরা স্বভাব বদলাতে না পেরে অন্যের স্মার্টফোনের ডেটা প্রসেসিং সিস্টেম হ্যাক করার চেষ্টা করছেন। পাড়ায় পাড়ায়, রকে বা কাফেতে বসে গুলতানির বদলে সকলে এ ওর পিঠে পিঠ দিয়ে ফোন বা ল্যাপটপ অন করে আঙুল নাড়িয়ে নিঃশব্দে চ্যাট করে। শিশু ছাড়া কারও হাসি-কান্না শোনা যায় না। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বহু দিন অব্যবহৃত থাকার ফলে ধীরে ধীরে কান ও স্বরযন্ত্র অবলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে প্রাণের শব্দ বলতে থাকবে শুধু পশুদের ডাক।

শাশ্বতী পালƒ হাটখোলা, চন্দননগর, হুগলি

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

ক্লা স নাইনে ‘কেমিস্ট্রি’ পড়াতেন নরেশবাবু। আড়ালে আমরা তাঁকে ‘পাগলা-নরেশ’ বলতাম। এতে কোনও ‘মিস্ট্রি’ ছিল না। খ্যাপাটে ব্যবহারের জন্য তিনি এই উপাধি লাভ করেন।

তিনি পড়াতেন খুব গুছিয়ে। আর ক্লাসে তাঁর প্রশ্নের ঠিক উত্তর না দিতে পারলেই বাক্য-শেল: ‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এই বার ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ।’ আমরা এতে বেঁচে গেলেও, ‘ভাল’ ছেলেদের জন্য তোলা থাকত আরও বিষ মাখানো তির, ‘বড় বড় বানরের বড় বড় লেজ, লংকা-য় যাইতে মাথা করে হেঁট।’ এক দিন আমি তাঁর ‘ছড়াস্ত্র’-র লক্ষ্য হলাম, ‘তোর হাবভাব যেন কী না কী, এখন দেখছি তুই পিনাকী!’ ক্লাসে হাসির খোরাক হলাম। ওই সব মর্মভেদী ‘বাণ’ এড়াবার জন্য আন্দাজে কোনও উত্তর দিলে ছুটে আসত: ‘কেমিস্ট্রি-তে করিলে কোনও অনুমান, হইয়া যাইবে তুমি মুখপোড়া হনুমান।’

শিব্রামীয় রসিকতাও করতেন। এক দিন, ক্লাস চলাকালীন এক জন হন্তদন্ত হয়ে আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক স্বদেশবাবুর খোঁজ নিতে এল, ‘স্বদেশকে দেখেছেন?’ স্যর মুচকি হাসি দিলেন, ‘স্বদেশ? এটাই তো স্বদেশ। এটা কি বিদেশ?’ ক্লাসসুদ্ধ সকলে হেসে উঠলাম। ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হাসলেন।

‘উইট’ আর ধারালো কথার জন্য ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাঁকে সমঝে চলত। এক দিন পড়াতে গিয়ে ‘সব জলের অণু’র সিম্বল ‘এইচটুও’ বলতেই, একটি জন্ম-জেঠু পাকা টাইপের ক্লাসমেট প্রশ্ন করল, ‘চোখের জলেরও?’ ফিচলেমি-টার উত্তর এল, ‘ডোন্ট হেস্ট, রেজাল্টের পর হবে টেস্ট।’

পরীক্ষার হলে গার্ড দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রীতিমত ‘সেলেব্রিটি’। আক্ষরিক অর্থে কোনও পরীক্ষার্থী ঘাড়ও ঘোরাতে পারত না। দু’চার জন ছেলে টিচার্স রুম থেকে আগাম খবর নিয়ে আসত, কোন রুমে তিনি ‘গার্ড’ দিতে যাচ্ছেন। এক বার, পরীক্ষা শুরু হবার বেশ খানিক ক্ষণ আগেই ‘নাইন-এ’ সেকশনে গিয়ে তিনি বসে আছেন। অন্য ক্লাসের ছেলেরা, তাদের মধ্যে ‘নাইন-বি’-র আমরাও আছি, দরজার বাইরে মজায় নাচানাচি করছি। ওয়ার্নিং বেল পড়তেই, হুড়োহুড়ি করে ক্লাসে ফিরে বেঞ্চে বসে যা দেখলাম, তাতে আমরা হতভম্ব ! আমাদের রুমের চেয়ারে তিনিই বসে। আমাদের পিছনে কখন তিনি এলেন টেরই পাইনি। তার মানে দাঁড়াল, ‘হল কালেকশন’ জিরো। এ দিকে, ক্লাসের একটি ছেলে (পড়ুন, চর) স্টাফরুমের অন্দর থেকে পাকা খবর নিয়ে এসে ক্লাসে ঢুকতে ঢুকতে উত্তেজনায় দরজা থেকেই চেঁচাচ্ছে, ‘আমাদের রুমে নরেশ গার্ড রে, নরেশ গার্ড!’ ঢুকেই ‘ফ্রিজ’! আমরা কষ্টের মধ্যেও জোরে হেসে উঠলাম। স্যরও মিটিমিটি হাসছেন। আগামী তিনটি ঘণ্টায় উসুল করে নেবেন!

ঘুরেফিরে দুজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তির কথা বলতেন। ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন এবং জর্জ বার্নার্ড শ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যথার্থ মূল্যায়নের অভাব বোঝাতেই রামানুজনের কথা বলতেন। স্যরের এই হকটা ছিল। এমনি যতই খ্যাপাটে হোন, ছাত্রমেধার যথার্থ মূল্যায়নে তিনি ছিলেন অতুলনীয়।

স্কুল পেরিয়ে তখন আমি কলেজে। ডাক্তারের চেম্বারে স্যরের সঙ্গে দেখা। কলেজে পড়ে লেজ না গজালেও সাহস বেড়েছে। দু’-একটা কথার পর তাঁকে খুশি করার জন্য হেসে বললাম, ‘স্যর, আপনার সঙ্গে না বার্নার্ড শ-এর খুব মিল।’ ও হরি! একটুও খুশি না হয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গাঁট্টাটি মারলেন: ‘শয়ে শয়ে ‘Shaw’ হয় না, বুঝলি? ‘Shaw’ এক জনই!’

পিনাকী দত্ত চৌধুরীƒ সূর্যনগর, টালিগঞ্জ

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

আমি ছেলেবেলা থেকেই খুব পাড়াবেড়ানি ছিলাম। যতটা সময় ঘরে থাকতাম, তার চেয়ে অনেক বেশি পাড়ায় এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। মা সব সময় বলতেন, ‘এত পাড়াবেড়ানি হলে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়ির কথা শুনতে হবে। এ বার একটু ঘরে থাকা অভ্যেস করো।’ তত দিনে অবশ্য আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। জেনে গিয়েছি, শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়াও বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য দেওর-ননদ আছে। তাই মনটা বেশ আনন্দেই ছিল।

আমি চির কালই চেঁচিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত। তাই মনে ভয় ছিল, প্রথম দিকে শ্বশুরবাড়িতে কী ভাবে নিজেকে শান্তশিষ্ট রাখব। সে পরীক্ষায় প্রথম দু’দিন তো পাশ করে গেলাম। কিন্তু গন্ডগোলটা হল বউভাতের পর দিন।

বউভাতের রাতে যাঁরা পরিবেশন করেছিলেন, বউভাতের পর দিন দুপুরে তাঁদের খাওয়ার নেমন্তন্ন ছিল। আমি আবার পরিবেশন করতে ভীষণ পছন্দ করি। তাই আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে আমার জা, ননদ আর শাশুড়ির সঙ্গে পরিবেশনে হাত লাগালাম। কিন্তু বিপদ ঘটল, যখন আমি সব ভুলে গিয়ে শাশুড়িকে বললাম, ‘মাসিমা, আমায় তরকারির থালাটা একটু এগিয়ে দেবেন?’ হঠাৎ দেখি সকলে খাওয়া ছেড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ননদ বড় বড় চোখে বলে উঠল, ‘কে তোমার মাসিমা?’ আমি তো লজ্জায়, ভয়ে, কোনও রকমে ‘সরি, ভুল হয়ে গেছে’ বলে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচি।

মজা হল এর পর দিন। তখন আত্মীয়স্বজন, সকলেই যে যার মতো ফিরে গেছে। বিকেলে শাশুড়িমা বললেন, ‘চলো তোমায় আমার বন্ধুদের দেখিয়ে আনি।’ অবাক হলাম। ভাবলাম, বউভাতের দিন কি তাঁরা আমায় দেখেননি? আবার বাড়ি গিয়ে দেখাতে হবে? গিয়ে দেখলাম, এক জন খুবই অসুস্থ, শয্যাশায়ী। এবং অন্য জন হাঁটুর ব্যথায় নড়তে পারেন না।

‘বউ দেখানো’ পর্ব শেষ করে বাড়ি ফিরছি। বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি, দেখি আমার ননদ দৌড়তে দৌড়তে রাস্তা পর্যন্ত এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আর খুব হাঁপাচ্ছে। মা আর আমি দুজনেই ভয় পেয়ে গেলাম। বাবার শরীর খারাপ হল নাকি?

ননদ বলল, ‘মা, চুপিচুপি ঘরে ঢোকো। বাবা খুব রেগে গেছে। বলছে, নিজে এক পাড়াবেড়ানি, এখন নতুন বউটাকেও পাড়াবেড়ানি তৈরি করছে।’ নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। হো-হো করে হেসে ফেললাম।

পর দিন দ্বিরাগমনে বাপের বাড়ি গিয়ে সবার প্রথমে মায়ের হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললাম, ‘তুমি বলেছিলে, আমার শাশুড়ি আমায় পাড়াবেড়ানি বলে কথা শোনাবে। জানো, আমার শাশুড়ি নিজেই এক জন পাড়াবেড়ানি!’

অনুরাধা ভট্টাচার্যƒ নাগপুর

সাদাকালো টিভিতে রঙিন টেনিস

সোনার হাতে সোনার মেডেল। ১৯৮৮-র সোল অলিম্পিকে স্বর্ণপদকজয়ী স্টেফি গ্রাফ।

১৯৮৬’র জুন-জুলাই। ক্লাস সেভেনে পড়ি। আনন্দমেলার একটা সংখ্যায় খেলার টুকরো খবর দেওয়া পাতার নীচে চোখ আটকে গেল। এক বিদেশিনি কিশোরীর লন টেনিস র‌্যাকেট হাতে আকাশের দিকে বল ছুড়ে, সার্ভ করার দৃপ্ত ভঙ্গিমা। সঙ্গের লেখা থেকে জানলাম, মেয়েটির বয়স ষোলো, জার্মান। নাম স্টেফি গ্রাফ। বিশ্ব টেনিস সার্কিটে সেই সময় সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী টেনিস খেলোয়াড়।

পরের বছর, ’৮৭-র উইম্বলডন ফাইনালে উইমেন্স সিংগল্‌স-এর দিন। গত এক বছর স্টেফি গ্রাফের স্কিল সম্বন্ধে বহু লেখা পড়েছি। জানতাম, একটা রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল হতে চলেছে। হলও তাই। গোটা কোর্ট জুড়ে সপ্তদশী স্টেফি গ্রাফ-এর তীব্রগতির শটগুলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলাম। কিন্তু উলটো দিকে ছিলেন তখনকার বিশ্ব টেনিসের এক নম্বর তারকা, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। অভিজ্ঞতার জোরে তিনিই জিতে গেলেন ম্যাচের ফল গড়ে-দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো। চ্যাম্পিয়নের শিরোপাও উঠল ওঁর মাথাতেই। ম্যাচ শেষে কোর্টের পাশে খেলোয়াড়দের বসার জায়গায় জামাকাপড় গোছাতে ব্যস্ত স্টেফির মাঝে মাঝে চোখের জল মোছা, আর ওঁর বাবা পিটার গ্রাফ-এর মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার দৃশ্যে মনখারাপ হয়ে গেল। কিন্তু এ বিশ্বাসও দৃঢ় হল, আগামী বছর এই মেয়ের সামনে নাভ্রাতিলোভাও দাঁড়াতে পারবেন না।

ঠিক তা-ই হল। ’৮৮-র উইম্বলডন লেডিজ ফাইনাল পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করলেন স্টেফি গ্রাফ। বছরের গোড়া থেকেই প্রায় সব বড় খেতাবগুলোই উনি জিতে আসছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, আগের বারের ভুলগুলো শুধরে, নিজেকে আরও নিখুঁত করে তুলে, আগের বার ফাইনালে হারের বদলা নিতে মুখিয়ে আছেন। আমিও উন্মুখ ছিলাম আমার প্রিয় প্লেয়ারকে প্রথম বার উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন হতে দেখতে। চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে কোর্টের এক মাথা থেকে আর এক মাথায় চলাফেরা, নিখুঁত প্লেসিং আর বিখ্যাত ফোরহ্যান্ডে স্টেফি গ্রাফ নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেন নাভ্রাতিলোভাকে। জয়সূচক শটটা মেরে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে লাফিয়ে উঠলেন যখন, আমার আনন্দ দেখে কে! সেন্টার কোর্টের সব দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে তখন অভিনন্দন জানাচ্ছেন উইম্বলডনের নতুন রানিকে। খয়েরি রঙের, কাঠের তৈরি সাদাকালো ই.সি. টেলিভিশন সেটের স্ক্রিনে দৃশ্যগুলো দেখে মনে হচ্ছিল সাদাকালো কোথায়, এ তো রঙিন!

পাড়ার বইখাতার দোকানে আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম। আসার সঙ্গে সঙ্গে তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি খেলার ম্যাগাজিনটা কিনে নিলাম। আহা, পাতাজোড়া অপূর্ব কারুকাজ করা উইম্বলডনের থালা (ট্রফি) হাতে স্টেফি গ্রাফের ছবি! ওঁর ছবিওয়ালা খেলার ম্যাগাজিন সংগ্রহ করার সেই শুরু। অগস্টের কোনও এক দিনের আনন্দবাজারে বেরল ‘স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড’-এর বিজ্ঞাপন। প্রচ্ছদকাহিনি স্টেফি গ্রাফকে নিয়ে। দোকানের দাদাকে বলে রাখলাম আবার, আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে কিনে নিলাম।

আর এক মহিলা খেলোয়াড়ও আলোড়ন ফেলেছিলেন সেই সময়। আর্জেন্টিনার গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি। ওঁর রূপ, স্টাইল, কোর্টে দারুণ ব্যক্তিত্বময় চলাফেরা আমাদের মন জয় করেছিল। স্টেফি গ্রাফ-সাবাতিনি জুটি হয়ে উঠেছিল আলোচনার বিষয়। আমার এক বন্ধু পড়াশোনা শিকেয় তুলে সারা সন্ধে বাংলাদেশ টেলিভিশনে উইম্বলডন-এর উইমেন্স ডাবল্‌স ফাইনাল ম্যাচে গ্রাফ-সাবাতিনি জুটির খেলা দেখল। পর দিন শোনালও তার বর্ণনা। স্কুলে আর এক বন্ধুর ব্যাগ থেকে সাবাতিনির পোস্টার চুপিসারে সরিয়ে ফেলল এক করিৎকর্মা সহপাঠী। আমিই শুধু জানতাম সেটা।

ক’মাস পরেই, ’৮৮-র সোল অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল জিতলেন স্টেফি। টেনিস বিশ্ব সে বছর তাঁর সমগ্র কৃতিত্বকে ভূষিত করল ‘গোল্ডেন স্ল্যাম’ শিরোপায়। মনে আছে, আর এক পছন্দের খেলোয়াড়, স্তেফান এডবার্গ, পুরুষদের বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। সে বছরই প্রথম টেনিস অলিম্পিকের ক্রীড়াসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হল। গোল্ড মেডেল হাতে স্টেফি গ্রাফের পাতাজোড়া ছবি আজও আছে আমার কাছে।

’৮৯। বিশ্বজোড়া স্টেফি-প্রেমীদের সঙ্গে আমিও এক বিরাট ধাক্কা খেলাম— ফরাসি ওপেন-এর ফাইনালে ওঁর হারের খবর পেয়ে। পর দিন সকালে ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক–এ হাইলাইটস-এ দেখলাম, পেটের গন্ডগোলে কাহিল ছিলেন স্টেফি। বিশ্ব টেনিস সে বছর পেল আর এক দুর্ধর্ষ খেলোয়াড়, স্পেনের আরান্থা সাঞ্চেজ ভিকারিও।

সে বছরই প্রথম দিল্লি দূরদর্শন কর্তৃপক্ষ কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে উইম্বলডন সরাসরি সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। কী আনন্দ! প্রথম দিনই স্টেফি গ্রাফের খেলা। বাড়িতে আসা অঙ্কের মাস্টারমশাইকে অনুরোধ করলাম, একটু আগে ছেড়ে দিন। স্যর ছেড়েও দিলেন। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল, ফাইনালে, এক দিকে স্টেফি গ্রাফ, অন্য দিকে বরিস বেকারের ম্যাচগুলো টিভিতে যেন গিলতে লাগলাম। সে বছর ‘জার্মান ডাবল্‌স’ হল, মানে, নারী-পুরুষ দুই বিভাগে স্টেফি গ্রাফ আর বরিস বেকার চ্যাম্পিয়ন। সোনালি ট্রফি হাতে স্টেফি গ্রাফ আর বরিস বেকারের প্রচুর রঙিন ঝলমলে ছবি জোগাড় করলাম।

আশির দশকের সেই বছরগুলোয় সঙ্গী ছিল সেই স্পোর্টস ম্যাগাজিনগুলো, যার পাতায় পাতায় স্টেফি গ্রাফ, বরিস বেকার, ক্রিস এভার্ট, স্তেফান এডবার্গ, ইভান লেন্ডল, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। মনে মনে চলে যেতাম উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টে, সোল অলিম্পিকে, বা ফরাসি ওপেনের লাল সুরকির কোর্টের ধারে— যেখানে দুরন্ত দুর্ধর্ষ খেলে চলেছেন, আমার স্বপ্নের খেলোয়াড়রা!

ইন্দ্রনীল রায়, বিদ্যাসাগর উপনিবেশ, কলকাতা

indranilroy13@gmail.com

আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy