E-Paper

অর্জুনের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য শিখেছিলেন তির-ধনুক চালনা

তখন রঙ্গালয়ে অভিনয় করতে আসায় সমাজে নানা বিধিনিষেধ ছিল। কিন্তু কোনও বাধা মানেননি এই মানুষটি। শুধু অভিনেতা হিসেবে ‘নটসূর্য’ হয়ে ওঠাই নয়, হয়ে উঠেছিলেন সুদক্ষ পরিচালক, সংগঠক, নাট্যপণ্ডিত, শিক্ষক এবং এক আগ্রাসী পাঠক। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টির প্রথম ডিন এবং নাট্য বিভাগের অধ্যক্ষও হয়েছিলেন অহীন্দ্রভূষণ চৌধুরী।

শম্পা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:১১
অভিনয়শিল্পী: অহীন্দ্রভূষণ চৌধুরী। তাঁর নিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ আর আন্তরিকতা ছিল প্রবাদপ্রতিম।

অভিনয়শিল্পী: অহীন্দ্রভূষণ চৌধুরী। তাঁর নিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ আর আন্তরিকতা ছিল প্রবাদপ্রতিম।

১৮৯৫ (মতান্তরে ১৮৯৬) সালের ৬ অগস্ট। বেলেঘাটায় মামাবাড়িতে জন্ম চন্দ্রভূষণ চৌধুরী এবং পঙ্কজিনী দেবীর ছেলে অহীন্দ্রভূষণ চৌধুরীর। জমিদার পরিবারের এই ছেলেটি ছোটবেলা থেকে জেদি। খেলাধুলো, গানবাজনা, যাত্রা-থিয়েটারে দারুণ উৎসাহ। তখনকার দিনে জনসাধারণের আমোদ-প্রমোদের প্রধান উপকরণ ছিল যাত্রা ও থিয়েটার। বছর দুয়েক বয়সের অহীন্দ্রকে নিয়ে মা যাত্রা শুনতে গেছেন। কনসার্টের দল শুরু করল ঐকতান। একযোগে বেজে উঠল ঢোল, করতাল, মন্দিরা, হারমোনিয়াম, বেহালা, এসরাজ, কর্নেট, ক্ল্যারিয়োনেট। মা পঙ্কজিনী বসেছেন চিকের আড়ালে। মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছেলে ছুটে চলে গেল ক্ল্যারিয়োনেট বাদকের পাশে। পরের দিন সকালে বায়না— একটা বাঁশি চাই।

বাবার সূত্রে ছেলের সাধারণ রঙ্গালয়ে আনাগোনা ছিল ছোটবেলা থেকেই। নয় বছর বয়সে ক্লাসিক থিয়েটারে ‘প্রফুল্ল’ নাটকে যোগেশের ভূমিকায় গিরিশচন্দ্রের অভিনয় দেখলেন। সে স্মৃতি তাঁর মনে চিরকাল রয়ে গেল। লন্ডন মিশনারি সোসাইটি স্কুলে পড়াশোনার সূচনা। থিয়েটারের প্রতি অদম্য ভালবাসায় প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসা হল না। জাতীয় আন্দোলনের তাগিদে তখন পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে ব্যায়ামাগার, ফুটবল-ক্রিকেট ক্লাব। অহীন্দ্রভূষণের শরীরচর্চা আর ফুটবল খেলার জায়গা তখন ভবানীপুর ক্লাব। ১৯১২ সালে ভবানীপুর রয়াল ক্লাবে ‘বিজয়া’ নাটকে সমরেন্দ্রর ভূমিকায় অহীন্দ্র। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, ফর্সা রং, ব্যায়াম করা ঋজু দেহ। একেবারে নায়কোচিত চেহারা। কলকাতার একটি অভিজাত যাত্রাদল ছিল ভবানীপুর বান্ধব সমাজ। এই দলে ছিলেন তিনকড়ি চক্রবর্তী, ইন্দু মুখোপাধ্যায়, হরিমোহন বসু, ভূজঙ্গভূষণ রায়, ফণী রায় প্রমুখ, যাঁরা প্রত্যেকে পরে প্রথিতযশা শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। এখানে ‘অভিমন্যু বধ’ নাটক, ‘পার্থ-প্রতিজ্ঞা’, ‘সীতাহরণ’ ইত্যাদি যাত্রাপালায় অভিনয় করেন অহীন্দ্রভূষণ। ‘পার্থ-প্রতিজ্ঞা’য় ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকায় তাঁর অসাধারণ অভিনয় দেখে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাই হরীন্দ্রনাথ দত্তের মনে হয়েছিল, তিনি দর্শক হিসেবে নিতান্ত ভাগ্যবান। এখানেও অহীন্দ্রর নানা পরীক্ষানিরীক্ষা। বান্ধব সমাজে যাত্রায় প্রবেশ-প্রস্থানের দৃষ্টিপথ চিহ্নিত করলেন তিনি। মহলার সময় জুড়ির দলের সঙ্গে গান গেয়ে সুরচর্চার পাশাপাশি ময়দানে নির্জনে স্বরচর্চা চলত। ব্যায়ামচর্চাও ছাড়েননি।

১৯২০ সালে সুধীরার সঙ্গে বিয়ে হল অহীন্দ্রের, কাজকর্ম তেমন করা যাচ্ছিল না। আর একটা পর্ব নিত্যদিনের রুটিনে যোগ হল— ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে পড়াশোনা। অহীন্দ্র চৌধুরী সুদক্ষ পরিচালক, সংগঠক, পণ্ডিত, শিক্ষক এবং আমৃত্যু আগ্রাসী পাঠক। তথাকথিত ভদ্র পরিবারের কারও সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয়ে তখন অনেক বিধিনিষেধ। দেশে তখন নির্বাক ছায়াছবির যুগ। বন্ধু প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে ১৯২০ সালের নভেম্বরে ফোটো প্লে সিন্ডিকেট গঠন করে ‘সোল অব আ স্লেভ’-এর চিত্রনাট্য লেখা, ছবি তৈরির সম্পাদনা ও নায়ক ধর্মদাসের ভূমিকায় অভিনয় করলেন অহীন্দ্র। ছবিটি এ দেশ ছাড়াও আফ্রিকা, ফিজি দ্বীপপুঞ্জ ও তখনকার রেঙ্গুনে প্রচারিত হয়েছিল।

তখন কলকাতায় নিউ বেঙ্গল স্কুলের ছবি আঁকার স্বর্ণযুগ। প্রবাসী প্রেস থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘চ্যাটার্জি অ্যালবাম’ নামে নতুন পদ্ধতিতে আঁকা ছবি প্রকাশিত হত। অহীন্দ্র চৌধুরী ওরিয়েন্টাল স্কুল অব আর্টস সোসাইটির চিত্র প্রদর্শনীতে দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বলে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তাঁর চিত্রশিল্পের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। কলকাতায় তখন নিয়মিত চলছিল তিনটি থিয়েটার। স্টার, মনোমোহন আর মিনার্ভা। সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনয় করা তখন সহজ ছিল না। মাঝে মাঝে চলত কর্নওয়ালিস থিয়েটার। ১৯২২ সালের শেষে মিনার্ভা থিয়েটার পুড়ে গেল। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং বাংলা থিয়েটারের অন্যতম প্রযোজক প্রবোধচন্দ্র গুহের প্রচেষ্টায় তৈরি হল আর্ট থিয়েটার লিমিটেড। তার আগে অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে।

পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে যোগ দিয়ে শিশির ভাদুড়ি ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানিতে ‘আলমগীর’-এ অভিনয় করেন। ১৯২৩ সালে ইডেন গার্ডেন এগজ়িবিশন গ্রাউন্ডে পর পর চার বার তাঁর অভিনীত ‘সীতা’ মঞ্চস্থ হয়। এই বছরে রথযাত্রার দিন আর্ট থিয়েটারে ‘কর্ণার্জুন’ অভিনীত হয়। অর্জুনের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য অহীন্দ্র চৌধুরীকে তির-ধনুক চালনা শিখতে হয়েছিল। এখানে দৃশ্যপট, পোশাক-পরিচ্ছদে নতুনত্ব দেখা দিল। মঞ্চে ব্যবহার হল ভেলভেটের পর্দা। নরেশ মিত্রের অসুস্থতায় পরের বছর ‘সাজাহান’ নাটকে অভিনয়। মেক-আপে পারদর্শী ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। দেহের ডান দিকটা পক্ষাঘাতে পঙ্গু, এমন ভাবে অভিনয় করতে হত তাঁকে। তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি লিখছেন, নটসূর্যের ‘সাজাহান’ ছিল তখনকার থিয়েটারের ব্ল্যাঙ্ক চেক। থিয়েটারের খরচ কিংবা মাসমাইনে এক রাত্রি নটসূর্যের ‘সাজাহান’ মঞ্চস্থ হলে কুলিয়ে যেত। আর্ট থিয়েটারে তিনি ‘ইরানের রানী’, ‘রাজা ও রানী’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘প্রফুল্ল’, ‘সাজাহান’, ‘বন্দিনী’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেন। ‘মিশরকুমারী’ নাটকে আবনের রূপসজ্জায় তাঁকে দেখার জন্য দর্শক ভিড় করত। ‘নবযৌবন’ নাটকে মূর্খ, নির্বোধ, দাম্ভিক দর্পনারায়ণের ভুমিকায় অভিনয়ে দর্শক দারুণ কৌতুক বোধ করত। স্বয়ং নাট্যকার অমৃতলাল বসু এ নাটক দেখে বলেছিলেন—“অহীন্দ্রবাবু আমার দর্পনারায়ণের পরিকল্পনাকেও অভিনয়গুণে উঁচাইয়া গিয়াছেন।”

১৯৩০ সালে অহীন্দ্র চৌধুরী চলে আসেন মিনার্ভা থিয়েটারে। এখানে তাঁর অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে আছে— ‘মিশরকুমারী’, ‘বেহুলা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘প্রতাপাদিত্য’। ১৯৩৩ সালে অহীন্দ্র চৌধুরী আবার স্টারে (আর্ট থিয়েটারে) ফিরে আসেন। এ পর্যায়ে অনুরূপা দেবীর ‘পোষ্যপুত্র’তে শ্যামাকান্ত, রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’য় বৈকুণ্ঠ চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন। বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয়ে অহীন্দ্র চৌধুরীর জুড়ি ছিল না। শচীন সেনগুপ্তর ‘তটিনীর বিচার’ নাটকে ড. ভোসরূপে তাঁর চরিত্রায়ণ ছিল যুগান্তকারী। শচীন সেনগুপ্তের ‘বাংলার প্রতাপ’ নাটকে কার্ভালো চরিত্রে অভিনয়কালে বাহান্ন বছর বয়সেও তিনি রবি রায়ের মতো সাড়ে ছ’ফুট লম্বা বিশালদেহী পুরুষকে কাঁধে নিয়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যেতেন।

হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতীয় রঙ্গমঞ্চ’ বইটিতে লিখেছেন, “আর ইঁহার কৃতিত্ব এই তিনি অভিনয় করিতে গিয়া কখনও কোনো প্রকারে দর্শককে disappoint করেন নাই। বোধ হয় অভিনয় কলার প্রতি একান্ত বশ্যতাই মঞ্চ ও ছায়ালোকে তাঁহার নিরবিচ্ছিন্ন উন্নতির কারণ।” মন্মথ রায় তাঁকে ‘নটসূর্য’ উপাধি দিয়েছিলেন, কারণ প্রতিভায় তিনি ছিলেন সূর্যের মতো উজ্জ্বল ও ভাস্বর। যে সব নাটক এই প্রতিভাবান অভিনেতা অভিনয় ও পরিচালনা করতেন, তার ঐতিহাসিক পটভূমি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, পোশাক-পরিচ্ছদ কেমন ধরনের, তা খেয়াল করতেন। এক দিকে ‘নাট্যাচার্য’, অন্য দিকে ‘নটসূর্য’, এই দুই ‘সেলেব্রিটি’কে নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্কের বিরাম ছিল না। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে গোলাম হোসেনের ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরীর অভিনয়ের প্রশংসা করে বলে, এই ব্যতিক্রমী অভিনয় অন্য চরিত্রগুলোর অভিনয়ে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে।

আর্ট থিয়েটারে রবীন্দ্রনাটক ‘চিরকুমার সভা’, ‘গৃহপ্রবেশ’ এবং ‘শোধবোধ’ প্রযোজনায় অহীন্দ্র চৌধুরীর অবদান ছিল সুপ্রচুর। বার বার রবীন্দ্রনাথের কাছে উপদেশ নিতে যেতেন। কবির সম্পাদিত বইটি অহীন্দ্র চৌধুরীর লাইব্রেরিতে ছিল। চন্দ্রবাবু চরিত্রে অহীন্দ্রের অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ওটি অহীন্দ্রের একটি সৃষ্টি; ওই সৃষ্টি আর্টিস্টের বড়ো ক্ষমতা।” ‘শোধবোধ’ নাটকের অভিনয়ে শিক্ষাদান প্রসঙ্গে ‘নাচঘর’ পত্রিকা মন্তব্য করে, “এ নাট্যাভিনয়ের শিক্ষাগুরু কে তা জানি না, কিন্তু তিনি যিনিই হোন, নিশ্চয়ই পাকা লোক, তাঁর শিক্ষাদান সার্থক হয়েছে।” এ কৃতিত্বের অনেকটাই অহীন্দ্র চৌধুরীর প্রাপ্য।

শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে বহু বার তিনি সম্মিলিত অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে আছে ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘সাজাহান’, ‘আলমগীর’, ‘রঘুবীর’, ‘ষোড়শী’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’, ‘বিজয়া’, ‘প্রফুল্ল’, ‘মিশরকুমারী’, ‘বলিদান’ ইত্যাদি। এক সময়ে মঞ্চে শিশির-অহীন্দ্র সম্মেলন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলার মতো আগ্রহ সঞ্চার করত দর্শকসমাজে, অথচ শিশিরকুমার, দুর্গাদাস বা নির্মলেন্দু লাহিড়ির মতো কণ্ঠমাধুর্য অহীন্দ্র চৌধুরীর ছিল না। তিনি বেতার নাটক করেছেন প্রচুর, ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। শেষ বেতার অভিনয় ‘সাজাহান’। পঁচিশখানির বেশি রেকর্ড-নাট্যের মধ্যে আছে ‘কর্ণার্জুন’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘সাজাহান’, ‘মীরাবাঈ’, ‘আলমগীর’ ইত্যাদি। চলচ্চিত্র মাধ্যমেও তিনি ছিলেন সু-অভিনেতা। একশোর বেশি ছবিতে তাঁর অভিনয়। সেই সময়কার পত্রিকা ‘চিত্রবাণী’ লিখেছে, “সম্ভবত এমন ছবি বা ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার অভিনয় বা রূপারোপ দেখে বলা যায়, একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন শিল্পী অহীন্দ্রভূষণ। এর প্রধানতম কারণ তাঁর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, শৃঙ্খলবোধ।” বাড়িতে শিক্ষক রেখে হিন্দি শিখেছেন। তাঁর অভিনীত হিন্দি ছবিগুলির মধ্যে আছে ‘রাজনর্তকী’, ‘ডাক্তার’, ‘সন্ধি’, ‘পি ডাবলু ডি’, ‘পতিব্রতা’, ‘বনফুল’, ‘পহচান’, ‘জবাব’ ইত্যাদি।

থিয়েটারকে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হয়। এ কথা মনে রেখে নিজের অভিনয়কে আরও প্রাসঙ্গিক আর আধুনিক করার জন্য সারা পৃথিবীতে নাটক নিয়ে যা পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে, তার বৃত্তান্ত তিনি সংগ্রহ করতেন, পরখ করে দেখতেন। পড়তেন প্রচুর, ডায়েরিও লিখতেন। বিলেত থেকে নতুন বইয়ের আমদানি হলে নিউ মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। কলকাতায় গোপালনগরে নিজের বাড়িতে তিনি অসাধারণ এক গ্রন্থাগার তৈরি করেছিলেন। মূল্যবান বই, পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের হ্যান্ডবিল, প্রেস লে-আউট, নাটকের বিজ্ঞাপন, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত থিয়েটার সমালোচনা— এই সংগ্রহশালা ছিল সত্তর-আশি বছর আগেকার কলকাতার থিয়েটার-সাম্রাজ্যের এক টুকরো ছবি।

তাঁর ‘বাঙালীর নাট্যচর্চা’ বইটি থিয়েটারে বেড়ে ওঠা মানুষের নাট্য বিশ্লেষণ। সুতরাং দেখা আর বোঝাটা আর পাঁচ জনের থেকে স্বতন্ত্র। এই বইতে আছে রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার, রিয়ালিস্টিক থিয়েটার, স্তানিস্লাভস্কির থিয়েটার, ইবসেনের ‘গোস্ট’ নাটকের কথা এবং ইউরোপিয়ান থিয়েটারের হাল-হকিকত, আইরিশ ও রাশিয়ান থিয়েটার নিয়ে আলোচনা। তাঁর মতে পরীক্ষামূলক থিয়েটারের জন্য প্রয়োজন বক্তৃতাঘর, এ বিষয়ে গবেষণাগার ও পাঠাগার। তাঁর লেখা ‘বাংলা নাট্য বিবর্তনে গিরিশচন্দ্র’ বইটি ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ‘গিরিশ বক্তৃতামালা’র লিখিত রূপ। গিরিশচন্দ্রের রচনাবলির পুনঃপাঠ ছিল এ বক্তৃতার উদ্দেশ্য। তাঁর মতে, গিরিশচন্দ্রের রচনাবলির তিনি ‘ক্রিটিক’ নন, ‘রিভিউয়ার’। দুই খণ্ডের ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ তাঁর লেখা আত্মজীবনী। বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে তা ‘দেশ’ ও ‘অমৃত’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। বইটি কেবল নটের জীবনকথা নয়। তাঁর সমসাময়িক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং জাতীয় জীবনের নানা কথা এর উপাদান।

‘পশ্চিমবঙ্গ নৃত্যনাট্য সঙ্গীত আকাদেমী’ পরবর্তী কালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে তিনি এর ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টির প্রথম ডিন এবং নাট্য বিভাগের অধ্যক্ষ পদে মনোনীত হন। আগে থেকে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি লিট উপাধিতে ভূষিত হন। বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবর্ষ পূর্তিতে বর্ষব্যাপী উৎসবের মূল সভাপতি ছিলেন তিনি। তার আগে তিনি ভারত সরকার দ্বারা ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে সম্মানিত হন অহীন্দ্র চৌধুরী। ১৯৭৪ সালে প্রয়াত হন এই সুবিখ্যাত নট ও পণ্ডিত।

নাট্যমঞ্চ থেকে অবসর গ্রহণের দিন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “সূর্য কখনও অস্ত যায় না, পৃথিবীর এক গোলার্ধে তার অস্ত, অন্য গোলার্ধে তার উদয়। নটসূর্য অভিনয়জীবন থেকে বিদায় নিলেন, কিন্তু আর এক ক্ষেত্রে পদসঞ্চার করেছেন তিনি। এখন তিনি নাট্য জগতে আচার্য।” শিল্পীরা অনেকেই কর্মক্ষম অবস্থা পর্যন্ত কাজ করতে চান। কিন্তু অহীন্দ্র চৌধুরী খ্যাতির শীর্ষে থাকার সময়ে নাট্যাভিনয় থেকে অবসর নেন। ‘কি ভেবে থিয়েটারে এসেছিলাম’ প্রবন্ধটিতে বাঙালির থিয়েটার চর্চার উত্থান-পতন নিয়ে তাঁর সমৃদ্ধ আলোচনা আছে। দুটো বিশ্বযুদ্ধ তিনি দেখেছেন। সে বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব থিয়েটারে কম পড়েনি। থিয়েটারের রূপ ও রীতির তার পর নানা পরিবর্তন ঘটেছে। থিয়েটারও যে সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তা নয়। তবু তাঁর মতে, “চেষ্টা ও উদ্দীপনা থাকলে ঊষর মরুপ্রান্তে মানুষ মরু-উদ্যানের সন্ধান পায়। পথ আপনি পায়ের কাছে এগিয়ে আসে, তাই ভরসা আছে যে, রঙ্গমঞ্চের দ্বিধা সঙ্কুচিত পদক্ষেপ— আবার সরল গন্তব্য পথের সন্ধান পাবে।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bhawanipore beleghata

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy