E-Paper

গ্রামীণ মেঠো সুর নিয়েই তাঁর আজীবনের ঘরকন্না

ছোট্ট ছেলেটি সুর আহরণ করেছিল মাঠ, ঘাট, নদী থেকে। বড় হতে হতে কোনও প্রথাগত তালিম ছাড়াই তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন বাংলার প্রকৃতি-সঙ্গীত। তাঁর প্রাণভোমরা ছিল পল্লিগ্রামের ভাওয়াইয়া গান। তাঁর নাম আব্বাসউদ্দীন আহমদ। এ বছর তাঁর জন্মের ১২৫ বর্ষের সূচনা। বিদ্যুৎ রাজগুরু

বিদ্যুৎ রাজগুরু

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:২৬
কণ্ঠশিল্পী: আব্বাসউদ্দীন আহমদ

কণ্ঠশিল্পী: আব্বাসউদ্দীন আহমদ

ইস্কুলে যাতায়াতের পথে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত ছোট্ট ছেলেটি। কৃষক মাঠের ফসল কাটতে কাটতে আপন মনে গান গাইছে, রাখাল গরু চরাতে চরাতে গান গাইছে, গাছে গাছে পাখি ডাকছে, দুপুরবেলা মাঝি হয়তো নৌকোয় সেদ্ধভাত রাঁধতে-রাঁধতে গুনগুন করছে চেনা কোনও সুর— এ সবই চুম্বকের মতো টানত ছেলেটিকে। হাট-মাঠ-ঘাটের সুর তাকে বেঁধে ফেলত আশ্চর্য মায়ায়, সে নিজে নিজে গাইতে চেষ্টা করত সেই সব গান। সে সব কেউ অত গুরুত্ব দেননি সে সময়। উকিলবাবুর ছেলে, পড়াশোনায় অত ভাল, এ নিশ্চয়ই আরও বড় উকিল হবে, এমনটাই ভেবেছিলেন বড়রা। কিন্তু সুর ঠিক তার রাস্তা খুঁজে নেয়। তাঁর মাধ্যমেই এক দিন দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার ভাওয়াইয়া গান। সেই ছোট্ট ছেলেটির নামই আব্বাসউদ্দীন আহমদ।

আমাদের চেনা-পরিচিত সমাজেই এক-এক জন অন্য ধরনের মানুষ জন্ম নেন, যাঁরা দেখতে হয়তো আর পাঁচ জনের মতোই সাধারণ, কিন্তু কোনও এক মহৈশ্বর্যে ঐশ্বর্যশালী। তেমনই এক বিস্ময়কর কণ্ঠসম্পদ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তাঁর কণ্ঠস্বরে, গায়কিতে মিশে ছিল মাটির গন্ধ, রোদের তাত, নদীর আর্দ্রতা আর শিকড়ের সন্ধান। তাঁর কণ্ঠে ‘আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে’ শুনে সব কাজ ভুলে উদাস, অন্যমনস্ক হয়ে পড়েননি— এমন বাঙালি প্রায় নেই বললেই চলে।

১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর তৎকালীন কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। মায়ের নাম হিরামন্নেসা, বাবা জাফর আলি। বাবা ছিলেন সে কালের নামী আইনজীবী। আব্বাসউদ্দীনও ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র। শিক্ষকরা সকলেই তাঁকে ভালবাসতেন। কিন্তু পড়াশোনার পাশাপাশি সঙ্গীতের প্রতিও গড়ে উঠেছিল অচ্ছেদ্য টান। কোনও রকম সাঙ্গীতিক পরিবেশে তিনি বেড়ে ওঠেননি, কারও কাছে প্রথাগত তালিমও নেননি সে অর্থে। স্কুলজীবন থেকেই শিশু আব্বাসউদ্দীন শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও মন দিয়ে গান শুনতেন, সেখান থেকেই তাঁর মনে গায়ক হওয়ার ইচ্ছে জন্ম নেয়।

সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় তিনি সঙ্গীত রপ্ত করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট তৎকালীন পাকিস্তান রেডিয়োতে তাঁর প্রথম গান ছিল ‘কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো’ এবং অপরটি ‘স্মরণপারে ওগো প্রিয়’। গানদু’টি রেকর্ড হয় কলকাতা গ্রামোফোনে, তুমুল জনপ্রিয়তাও পায়। কলকাতায় এই শিল্পী কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসেন। নজরুলের লেখায় ও সুরে আব্বাসউদ্দীনের দরদি কণ্ঠ জনপ্রিয়তা লাভ করে সহজেই। আধুনিক গানের সংখ্যা তাঁর অজস্র। সেই সময়ে ইসলামি গানকে কণ্ঠে ধারণ করে তিনিই প্রথম সব ধর্মীয় গোঁড়ামি ভেঙে দিতে পেরেছিলেন।

পরবর্তী কালে তিনি অসংখ্য স্বদেশি, আধুনিক, উর্দু, পল্লিগীতি গেয়েছেন। পল্লিগীতিতে তাঁর সাফল্য কালজয়ী। পল্লিগ্রামের নির্ভেজাল জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আব্বাসউদ্দীনের প্রাণভ্রমরা ছিল ভাওয়াইয়া সঙ্গীত। ভাওয়াইয়া গান গাইতে গাইতে আপনমনে পথ চলতে ভালবাসতেন। ‘ভাওয়া’ শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া এসেছে, যা মাঠ-প্রান্তরের নিজস্ব আবহসঙ্গীত। বিস্তীর্ণ চরকে ‘ভাওয়া’ বলা হয়। গরু-মহিষের গাড়িই এই গানের আকর। গাঁয়ের মেঠো, উঁচুনিচু পথে যাত্রীবোঝায় মইশাল ভাই এই গান গাইতে গাইতে পথ চলে। সঙ্গে বাজে দোতারা। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালবাসার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এই সঙ্গীত। এগুলি লোকজ সংস্কৃতির গর্ভজাত, লোকায়ত এগুলির ভাষা। তাই গানের সুরকার-রচয়িতার নাম জানা যায় না। তিস্তা নদীর চরে আপন খেয়ালে মোষের পিঠে চড়ে চলছে মইশালের দল। তাদের মনের উৎসারিত ভাবই সঙ্গীতের সুর-মূর্ছনায় আকাশ-বাতাস প্লাবিত করে। তিস্তার চরের লোকমানসের ভাষাই তাঁর মাতৃভাষা। এই ভাষাতেই উথলে উঠে প্রাণের সঙ্গীত ভাওয়াইয়া… ‘কোন দ্যাশে যান মইশাল বন্ধু/ মইশের পাল লইয়া/ ওরে আইজ ক্যানেবা মইশাল তোমরা/ মইশের বাতান থুইয়া রে...’। ছেলেবেলায় অজান্তেই তাঁর কণ্ঠে বাঁধা হয়েছিল সুরের বাসা। গ্রামীণ সেই মেঠো সুরকে নিয়েই তাঁর আজীবনের ঘরকন্না।

ভাওয়াইয়া গানের পথিকৃৎ আব্বাসউদ্দীনই প্রথম গাঁয়ের মানুষের মেঠো সুরকে শহুরে মানুষের শৌখিন ড্রয়িংরুমে তুলে এনেছিলেন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, টোকিয়ো, মেলবোর্ন-সহ পৃথিবীর বহু দেশে তিনি এই ভাওয়াইয়া সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। আবার কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিখ্যাত ইসলামিক গজ়ল, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ তাঁর কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছিল। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের লোকসাহিত্যের উপাদানগুলি সর্বপ্রথম সংগ্রহ করেন জর্জ এব্রাহাম গ্রিয়ারসন। যদিও তিনি ইংরেজ ছিলেন, তবুও বাংলা ভাষা ও লোকসাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ ও ভালবাসা। তিনি তাঁর গবেষণাপত্রটি ‘জার্নাল অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’ পত্রিকায় প্রাঞ্জল ইংরেজিতে অনুবাদ-সহ প্রকাশ করেন। তাঁর সংগ্রহগুলি প্রকাশিত হওয়ার পরই আমাদের সাহিত্য বিদেশি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রিয়ারসন সম্পাদিত, ১৯০৩-এ প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’-র পঞ্চম খণ্ডে তিনি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বহু গানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যাতে আব্বাসউদ্দীন-সংগৃহীত গানগুলোও পাওয়া গেছে। আব্বাসউদ্দীনই প্রথম ভাওয়াইয়া গান রেকর্ড করে জনমানসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ‘ও কি গাড়োয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’, ‘আমায় ডুবাইলি রে আমায় ভাসাইলি রে’ গানগুলি মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন রচিত ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে তুই’ তাঁরই কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাংলার কৃষি-সংস্কৃতিতে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তাপপ্রবাহের দরুন জলের জন্য আকুতি শোনা যায় এমন সুরেলা সঙ্গীতে। শোনা যায়, বর্মার কোনও এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে এই গানটি যখন আব্বাসউদ্দীন মঞ্চে গাইছেন, তখনই নাকি বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল।

১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকায় প্রয়াত হন আব্বাসউদ্দীন। এ বছর এই বিস্ময়-গায়কের ১২৫তম জন্মবর্ষের সূচনা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

folk song

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy