E-Paper

মায়েদের রক্ষাকর্তা

ভিয়েনায় প্রসূতি-মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে এনেছিলেন বলে এই অভিধায় ভূষিত করা হয় তাঁকে। তিনি দেখিয়েছিলেন সতর্কতার এক সামান্য, কিন্তু অব্যর্থ উপায়। করোনাকালের আগে তিনি ছিলেন বিস্মৃতির আড়ালে। ১৩ অগস্ট ছিল ইগনাজ় সেমেলভাইসের ১৬০তম প্রয়াণদিবস।

অরিন্দম বসু

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:২১
পথপ্রদর্শক: চিকিৎসক ইগনাজ় সেমেলভাইস (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স)।

পথপ্রদর্শক: চিকিৎসক ইগনাজ় সেমেলভাইস (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স)।


উনিশ শতকের ভিয়েনা। ব্যস্ত হাসপাতালের করিডরে ঘটছিল এক বিপ্লব, যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস বদলে দিয়েছিল চিরতরে। এই বিপ্লবের হোতা ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ় সেমেলভাইস (১৮১৮-১৮৬৫)। তাঁর আবিষ্কারের স্বীকৃতি অবশ্য তিনি দেখে যেতে পারেননি। তাঁর জীবন ছিল বেদনা আর নিঃসঙ্গতার এক দীর্ঘ পথ-চলা— এক বিজ্ঞানীর একা লড়াই, সমসাময়িক সকলের তীব্র বিরোধিতায় পূর্ণ।

১৮৪০-এর দশকের ভিয়েনা। সেই সময় হাসপাতালে সন্তান জন্মানো আর সদ্যোজাতের মৃত্যু ছিল সমার্থক। ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালের দুটি প্রসূতি বিভাগ ছিল। একটি চিকিৎসক ও মেডিক্যাল বিভাগের ছাত্ররা পরিচালনা করত, অপরটি ধাত্রীরা। হাসপাতালের ভিতরেই ছিল এক অদ্ভুত বৈষম্য— চিকিৎসকদের বিভাগে মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ নারী চাইল্ডবেড ফিভারে মারা যেতেন। অন্য দিকে, ধাত্রীদের ক্লিনিকে সেই হার ছিল মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। নারীরা হাসপাতালে ভর্তির সময় প্রায় কেঁদে ফেলতেন, যাতে চিকিৎসকদের ক্লিনিকে তাঁদের না পড়তে হয়। কিন্তু তখনও কেউ জানত না, পার্থক্যের কারণটা কী।

এই প্রশ্নই তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তরুণ চিকিৎসক ইগনাজ় সেমেলভাইসকে।

এক দিন সেমেলভাইসের এক সহকর্মী, এক জন প্যাথলজিস্ট, অসাবধানতায় একটি পোস্টমর্টেম চলাকালীন তাঁর হাতের আঙুল কেটে ফেলেন এবং কয়েক দিনের মধ্যে মারা যান। সেমেলভাইস লক্ষ করলেন, তাঁর মৃত্যুর লক্ষণ সেই চাইল্ডবেড ফিভারের মতোই, যে রোগে প্রসূতিরা মারা যেতেন। এই ঘটনার পর সেমেলভাইস একটি ভয়ানক সত্য উপলব্ধি করলেন— চিকিৎসকরা মর্গে মৃতদেহ স্পর্শ কিংবা ময়নাতদন্ত করার পরই সরাসরি প্রসব করাতে চলে আসতেন, আর হাত ধুতেন না। তাঁরাই ছিলেন সংক্রমণের বাহক।

এর প্রতিকার হিসেবে তিনি ১৮৪৭ সালে এক নতুন নির্দেশ জারি করেন— সব চিকিৎসককে ক্লোরিন-চুন বা ক্লোরিনেটেড লাইমের দ্রবণে হাত ধুয়ে তার পর রোগী দেখতে হবে। এই নির্দেশ কার্যকর হতেই অবিশ্বাস্য ফল দেখা দিল। মৃত্যুহার দ্রুত কমে নেমে এল ১-২ শতাংশে।

যেখানে এত দিন শত শত মা সন্তানজন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতেন, সেখানে হঠাৎ করেই সংখ্যাটা প্রায় শূন্যে এসে ঠেকল। তবে, এই বিস্ময়কর ফলাফলের পরও সেমেলভাইসের তত্ত্ব গ্রহণ করেনি চিকিৎসাবিশ্ব। মনে হয়েছিল, কথাটার তেমন কোনও মানে নেই, এত সামান্য একটা সতর্কতার কী-ই বা গুরুত্ব থাকতে পারে!

আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, তিনি এমন এক সত্য তুলে ধরেছিলেন, যা চিকিৎসকদেরই প্রশ্নের মুখে ফেলছিল, বোঝাতে চেষ্টা করেছিল— তাঁদের অসতর্কতাই রোগীদের মৃত্যুর কারণ। তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞান ‘জার্ম থিয়োরি’ জানত না। ব্যাক্টিরিয়া, সংক্রমণ এ সব তখনও প্রমাণিত হয়নি। তাই সেমেলভাইসের ধারণা তখনকার বিজ্ঞানের চোখে ছিল অযৌক্তিক, বেপরোয়া। অনেকেই সেমেলভাইসের কথা হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেন। প্রতিকূলতা দেখে হতাশ হয়ে পড়েন সেমেলভাইস। তিনি চিঠি লিখে সহকর্মীদের ‘খুনি’ বলেও দোষারোপ করেন। তাঁর লেখা হয়ে ওঠে বিশৃঙ্খল, অভিযোগমুখর। ১৮৬৫ সালে, তাঁকে এক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, একটি ক্ষতের সংক্রমণের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। একটি ট্র্যাজিক পরিণতি, যা তিনি নিজেই বহু বছর ধরে থামাতে চেয়েছিলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৪৭ বছর।

সেমেলভাইসের মৃত্যুর পরও তাঁর তত্ত্ব দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত রয়ে যায়। এর পর পরই বিজ্ঞানীরা ব্যাক্টিরিয়া ও সংক্রমণের প্রকৃত কারণ আবিষ্কার করতে শুরু করেন। লুই পাস্তুর-এর ‘জার্ম থিয়োরি’ এবং জোসেফ লিস্টার-এর অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতি ধীরে ধীরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন যুগের সূচনা করে। বিশ্ব তখন বুঝতে পারে— সেমেলভাইস ঠিক সমস্যাটিই শনাক্ত করেছিলেন। যদিও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে তিনি তা প্রমাণ করতে পারেননি, তাঁর আবিষ্কার ছিল নির্ভুল, বাস্তব ও কার্যকর।

আজ, ইগনাজ় সেমেলভাইসের নাম ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে ‘সেভিয়ার অব মাদারস’ নামে।

কোভিড-১৯ অতিমারির সময় যখন বিশ্ব জুড়ে মানুষ হাত ধোওয়ার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করল, তখনও হয়তো অজ্ঞাতসারেই আমরা তাঁরই শিক্ষা অনুসরণ করছিলাম। হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার হোক বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র— সবার আগে থাকে হাত ধোওয়ার নির্দেশ। এটি আজ চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল ভিত্তির অংশ। সেমেলভাইস যে সত্যটা বুঝেছিলেন, তা অনেক আগেই চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এগিয়ে দিতে পারত, যদি সমকালীন সমাজ তাঁর কথা শুনত। কিন্তু ইতিহাস বার বার প্রমাণ করেছে— যখন কেউ সময়ের আগে চলেন, তাঁকে সবার আগে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। সেমেলভাইস তবুও থেমে যাননি। আজকের অসংখ্য সুস্থ প্রসূতি বা সংক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের পিছনে আছেন সেই মানুষ, যিনি একা লড়ে গিয়েছিলেন গোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তিনি ইগনাজ় সেমেলভাইস— এক সাহসী, নিঃসঙ্গ চিকিৎসক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hungary

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy