E-Paper

স্বপ্নের সত্যি আর সত্যির স্বপ্নে একাকার তাঁর স্বাধীনতার কল্পনা

তাঁর ভাঙা, ঘুপচি ঘরেই পেরিস্তান বানাত চাঁদ, নীল সমুদ্রের গল্প জমাত বিশে আর সিংহ, নোনা-ধরা দোতলায় রোদের গন্ধ-লাগা কম্বল মুড়ি দিয়ে নাতিকে ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’-এর গল্প শোনাত দিদিমা। আজও সে বাক্সের জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মোরগের ডিমের মতো পান্না, পায়রার ডিমের মতো চুনি আর হিরে-জহরতের রোশনাই অন্ধকারের ভয় কাটিয়ে দেয় এক নিমেষে। ছোটদের এই আশ্চর্য দুনিয়ার রূপকারের নাম লীলা মজুমদার। আগামী বুধবার তাঁর ১১৭তম জন্মদিন।

প্রমিতি চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:০৪
শিশুসাহিত্যিক: পাঠকদের এক অন্য রকম দুনিয়ার সন্ধান দিয়েছিলেন লীলা মজুমদার।

শিশুসাহিত্যিক: পাঠকদের এক অন্য রকম দুনিয়ার সন্ধান দিয়েছিলেন লীলা মজুমদার।

পাহাড়ে সন্ধে হয় বড় তাড়াতাড়ি। মুখশুদ্ধির এলাচ-মৌরির মিষ্টি রেশ মুখ থেকে মিলিয়েছে কি মেলায়নি, তত ক্ষণে সূর্য তালগাছের গুঁড়ির কাছে নেমে গেছে, ছায়াগুলো লম্বা হয়ে বিশ্রী সরু-সরু হয়ে গেছে, গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে শোঁ-শোঁ করে বাতাস বইছে, আর সেই বাতাসে পণ্ডিতমশাইয়ের বৌয়ের মাথার ঘোমটা যেই না সরে গেছে, রুমু-বোগি তো দেখে থ! চকমকি পাথরের মতো বৌয়ের সোনালি আর সবুজে নকশাকাটা চোখ, ঝিনুকের মতো পাতলা কান, উপরের দিকটা আবার খোঁচামতন! রুমু-বোগি নিশ্চিত। বৌ পুরো মানুষ নয়, শেয়াল কুকুর হয়ে বনে-বাদাড়ে ঘুরত, তার পর হলদে পাখি খেয়ে মানুষ হয়ে গেল— ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করে বসে রুমু-বোগি যখন ঝগড়ুর কাছে সে সব গল্প শুনত, দিদিমা রাগ করত। চাকরবাকরের সঙ্গে ভদ্দরলোকের ছেলেপুলের অত মেলামেশা কেন বাপু! জাত-বেজাত বলে তো একটা ব্যাপার আছে! ঝগড়ুর বৌও তাদের বলত, “সবসময় আমাদের পাশে বসনি, দিদিমা রাগ করবে!” কিন্তু দিদিমার গোকুলপিঠে আর দুধপুলির সোয়াদ বাদে এ সব বাজে কথা কে-ই বা মনে রাখে!

শিশুসাহিত্যের সবচেয়ে দুঃসাহসের বিষয়টি হল, তাতে ইচ্ছেমতো সত্যি-মিথ্যে গুলিয়ে দেওয়া যায়। আর বড়রাও বেশি দূর না ভেবে, শুধুমাত্র ছোটরাই পড়বে এই অজুহাতে তার দাবি আর দ্রোহ, দুটোকেই অস্বীকার করে ভাবে— ছোটরা তো আর প্রশ্ন করবে না, কল্পনার জটিল সীমানা বিশ্লেষণও করবে না! অথচ ছোটদের কোনও রকম জোরজবরদস্তি না করে, অহেতুক জ্ঞানবৃদ্ধি না ঘটিয়ে, অপূর্ব সম্ভাবনাময় জীবনদর্শনের সন্ধান দিতে লীলা মজুমদার ষাটের দশকে যে হলদে পাখির গল্প শোনালেন, তাতে কল্পনার উচ্ছলতার গভীরে সামাজিক সংবাদের গম্ভীর অনুভূতিটুকুকে বড়রা কি আর মিথ্যে বলতে পারে? হ্যাঁ, বলতে পারে, সে অনুভূতির সিংহভাগই তাঁর পাহাড়ি ছোটবেলার দিনগুলোর থেকে নেওয়া। হাই-উইন্ডোজ়ের মস্ত বাংলো-বাড়িতে মায়ের আদরের ওমে বেড়ে ওঠা আট ভাইবোনের জীবনের রূপকথা থেকে নেওয়া, যে বাড়ির দেওয়াল ছিল বেজায় মজবুত। সেখানে বছরের পাঁচ মাস বৃষ্টি পড়ত, আর সেই বৃষ্টিতে জীবনের দুঃখ-কষ্ট, জাতপাতের কড়াকড়ি আর নিয়মকানুন ধুয়েমুছে ছোট ছোট নদী তৈরি করে নীচের উপত্যকায় নেমে যেত। মেঘলা বিকেলে মস্ত মস্ত লোহার আংটায় আগুন জ্বেলে কাপড় শুকোত পাহাড়ি ধাইমারা। কেউ তাদের ভাইবোনদের থেকে সরে বসতে বলত না। সারা দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা অজস্র গল্প বলত, আর পাহাড়ি কুয়াশায় তাদের গল্পের অশরীরী রূপকথায় শরীর দিতে একটা-দুটো করে আলো জ্বলে উঠত নীচের উপত্যকায়। ঝিঁঝিঁ ডাকত, গা শিরশির করত, আর শীতার্ত কুকুরের ডাকে স্বপ্ন আর সত্যিতে মিলেমিশে তৈরি হত ভয়-দুঃখ-ভাল লাগায় মোড়া একটা অন্য জগৎ। ঘুমে চোখ যত বন্ধ হয়ে আসত, মনের চোখ খুলে যেত, নিঃসঙ্কোচ আলো এসে পড়ত সেই জগতে। সেই আলোয় স্বাধীন আর সাবালক হয়ে ওঠার পথটিও দিব্যি চিনে নেওয়া যেত!

‘পাকদণ্ডী’, ‘আর কোনোখানে’ আর ‘খেরোর খাতা’য় বড় হওয়ার রোজনামচা লিখতে বসে এই সাবালক হওয়ার স্বপ্নের কথাই বার বার শুনিয়েছেন লীলা মজুমদার। বলেছেন, ছোটবেলার কথা ভুলে গেলে ছোটদের জন্য লেখা হয় না। ছোটদের জগৎ বড় বেদনার, সে জগতে ভালবাসার তীব্রতা যেমন বেশি, সহানুভূতির অভিঘাতও তত প্রবল। তাই বড় হওয়ার এবড়োখেবড়ো দিনগুলোয় ছোটবেলার সেই স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে তবেই সে দ্বিতীয় জগতের খোঁজ মেলে, লেখার রসদ তৈরি হয়। সে জগৎ চলতি সামাজিকতার বিপরীতে নিজের মতো করে নিজে বেড়ে ওঠার পথটি চিনিয়ে দেয়, আর নিত্যদিনের পরাধীন পৃথিবীটার মধ্যে দাঁড়িয়েও তার কাছাকাছি থাকা নিটোল মুক্তোর মতো আর একটা অমলিন পৃথিবীর সন্ধান দেয়, যেখানে মানুষ মুক্ত। কিন্তু এই স্বাধীনতা ব্যাপারটা ভূগোলের নিয়মনিষ্ঠ নয়, আবার ঔপনিবেশিক শক্তির বিপরীতে নিজের অবস্থান জিতে নেওয়ার লড়াইও নয়। এই স্বাধীনতা মানুষের নিজের মনের মতো হয়ে ওঠার লড়াই, সংজ্ঞাবিহীন, কল্পনা-নির্ভর খাপছাড়া আত্মদর্শন! পাহাড়ি নদীর মতো উপচে পড়ে তার এলোমেলো স্রোত, নিজের মতো করে দেদার ডালপালা মেলে। শুধু ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করে সে স্বাধীনতার আঁক মেলে না। “আরে, কাঁধ থেকে ভূত ঝাড়বার মত করে ইংরেজ তাড়ানো হলে, গরম বক্তৃতা করলে আর পুলিশের লাঠি খেলেই কি স্বাধীন হওয়া যায়?” স্বাধীনতার পৃথিবীটার অর্ধেকটা সত্যিকারের মাটি, জল, হাওয়া দিয়ে গড়া হলেও, তার বাকি অর্ধেকটা তো মনগড়া! আর সেই মনগড়া পৃথিবীর নাগাল পেতে গেলে মন-গড়ার সুলুকসন্ধানটুকু তো পেতে হয়!

লীলা মজুমদারের কলম জুড়ে তাই কেবলই সেই ‘মন-গড়া’র গল্পকথা! তখন সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিয়ে কাটাকুটিও হয়েছে বিস্তর। সত্যিই তো, মধ্য-চল্লিশের ধ্বস্ত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, বেলাগাম চুরিচামারি, সন্দেহ, খিদের জ্বালা, যুদ্ধ, দাঙ্গা আর বোমার ভয়ের সীমানায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সংবেদন আর মন-গড়ার রসদ আদৌ বাঙালি-শরীরে আর অবশিষ্ট ছিল কি? বিগত অর্ধশতক জুড়ে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত জীবনের নিদারুণ আত্মহীনতার গ্লানি শুধুমাত্র কি রাজনীতিক পালাবদলের নিয়মেই মুছে ফেলা সম্ভব ছিল? নাকি যুদ্ধ আর বিভেদের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হতে হতে যুদ্ধ করাটাই তত দিনে তার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিল? লেখিকা বলতেন, “কই, স্বাধীন হয়ে কেউ তো আর স্বাধীনতার গান লেখে না, প্রশংসাও করে না।” বরং সমাজে ছোটয়-বড়য়, জাতে-বেজাতে, ভদ্দরলোকে-ছোটলোকে, বড়লোকে-গরিবে, নিদেনপক্ষে বাড়ির গুটিকয়েক শরিকের ঊনকোটি-চৌষট্টির আচার-বিচারে দিবারাত্র যেন যুদ্ধের ঘনঘটা! স্নেহ, ভালবাসা, অনুভূতি এই গুণগুলো যে কেবল দেশের লড়াইয়েই কাজে লাগে না, সাধারণ জীবনেও যে তাদের প্রয়োজন পড়ে, এ কথা কি লোকে শেষে ভুলেই গেল?

হতে পারে, সেই অনুভূতির নাগাল পেতেই ১৯৫০-৬০’এর দশক জুড়ে লীলা মজুমদার লিখলেন সেই বাড়িগুলোর গল্প, যেখানে ভাঙার শব্দ ছিল বড় প্রকট। যুদ্ধের বাজারে টাকা জোটেনি, তাই বাড়িগুলোর ছাদ খসে পড়েছিল, দেওয়ালে চিড় ধরেছিল। আর যুদ্ধ থামার পরেও তাদের কেউ যত্ন করেনি, ভিতরের মানুষগুলোর রুজিরোজগারে টান পড়েছিল, রেশনের চাল বাড়ন্ত হয়েছিল, সকলেই ‘আড়চোখে সকলকে দেখত’, আর তাদের নিন্দেমন্দ-ফন্দিফিকিরের জ্বালায় দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নামত বড় তাড়াতাড়ি। এ ভারী মজার কথা, যখন বাংলা সাহিত্যে গৃহ-বহির্মুখী সুরটি দিব্যি দানা বাঁধছে ছেলেপুলের গল্পে ১৯৩০ কি ৪০-এর দশকে, তার পর পরই তিনি কেবলই লিখেছেন বাড়ির গল্প, ‘লাল টিনের ছাদের বাড়ি’, ‘তেপান্তরের পারের বাড়ি’, ‘উলুবেড়ের ভূতের বাড়ি’, ‘আহিরিটোলার বাড়ি’, ‘পাশের বাড়ি’— সবই বেজায় ভাঙা, চিলেকোঠার ফাটলে অশ্বত্থের চারা। কিন্তু কোনও অশরীরী নিয়মে সেই ভাঙা বাড়িগুলোও বড্ড মায়াকাড়া! সে বাড়ির বড়রা, সে জ্যান্ত হোক বা বিগত, ছোটদের পাহারা দেয়, পেনসিল-কাটা ছুরি আর কলম কিনে আনে, মাস্টার খুঁজে আনে, এমনকি তাদের সুখদুঃখের সঙ্গী হবে বলে গোলাপি বাতাসা কি চিনির নাড়ুর আশায় কাটিয়েও দেয় দিনের পর দিন। রুক্ষ, বন্ধ্যা সময়ে মানবিকতার অসামান্য উদ্বৃত্ত নিয়ে লেখিকার ‘ভাঙা’ বাড়ির মানুষ আর না-মানুষেরা পাঠকদের যে পূর্ণতার ঐশ্বর্য চিনিয়েছিল, তাতে প্রচলিত সমাজ-মননের প্রতিবাদ তো ছিলই, তার পরেও ভাঙনের যন্ত্রণা পেরিয়ে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত নির্মল যে রসটি ঝরে পড়ত, তাতে দৈন্যের অন্ধকার জমত না। তাই ভাঙা, ঘুপচি ঘরেই পেরিস্তান বানাত চাঁদ, নীল সমুদ্রের গল্প জমাত বিশে আর সিংহ, নোনা-ধরা, ক্যাঁচকেচে দোতলায় রোদের গন্ধলাগা কম্বল মুড়ি দিয়ে নাতিকে ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’-র গল্প শোনাত দিদিমা। রাত বাড়ত, আধো ঘুমে, আধো স্বপ্নে নাতি নিজের মনের মধ্যেই খুঁজে পেত হারিয়ে যাওয়া লাল টুকটুকে হাঙরের নকশা-আঁকা বাক্সটা, যার জন্যে কত না বিবাদ, কত সন্দেহ, কত মান-অভিমান! আজও সে বাক্সের জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যেত! মোরগের ডিমের মতো পান্না ঝলমল করত, পায়রার ডিমের মতো চুনিতে রক্ত ফেটে পড়ত, হিরে-জহরতের রোশনাই অন্ধকারের ভয় কাটিয়ে দিত এক নিমেষে!

হোক না সে প্রতিবাদ কল্পনার, কিন্তু তার সারটি যে বড় বাস্তব। হোক না সে কল্পনা ছোটদের, তার অনুরণন যে সর্বজনীন। সাধে কি আর তাঁর দুষ্টু ছেলেরা প্রশ্ন করেছিল, “এমন সুন্দর দিনে কেউ ইশকুলে যায়?” সত্যি তো, কচি কলাপাতার মতো এমন নিটোল একটা দিনে, যখন গাছের পাতায় রোদ আঁকিবুঁকি কাটে, মেঘের ছানারা উত্তরমেরুর দিকে রওনা দেয়, বাতাসে পেঙ্গুইনদের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে, তখন স্বাধীনতাবিহীন, নিরানন্দ প্রাত্যহিক শিক্ষানবিশির জাঁতাকলে কে সময় নষ্ট করে? মনে পড়ে লেখিকার অস্থির জিজ্ঞাসা, “যদি জানই একই পড়া, একই কথা আর একই নিয়ম, তবে ইশকুলে যাও কেন?” আরও মনে পড়ে ১৯৩০-এর দশকে শান্তিনিকেতনে পড়ানোর সময়কার যে ক’টি গল্প পরে সবিস্তারে লিখেছিলেন তিনি, তাদের মধ্যে একটি ছিল সেই অবাধ্য ছেলেটির গল্প, যে ইংরেজি গ্রামারের ক্লাসে গল্পের বই পড়ছিল। এক দিকে ক্লাসে পড়া চলছে, আর অন্য দিকে দিদিমণি খেয়াল করছেন, দারুণ উত্তেজনায় সে ছেলের চোয়াল ঝোলা, চোখ বড়-বড়, চুল খাড়া! বকাঝকার বদলে বইটি নিয়ে পড়ে ফেলাই অবশ্য স্থির করলেন তিনি! মনে মনে বোধহয় খুশিও হলেন, কারণ রাত জেগে রোমহর্ষক ‘তিব্বতি গুহার ভয়ঙ্কর’ পড়াও হল, আর ‘বাজে’ ছাত্রের মন-গড়ার অমূল্য রসদটিও চেনা হল। অবিশ্যি ভেতরে ভেতরে তিনিও মানতেন যে, ভাল ছেলে হওয়াটা বেশ বাজে ব্যাপার। তারা ক্লাসে ফার্স্ট হয়, মাস্টারমশাইদের কথা শোনে, কিন্তু নিজে কী ভাববে, তার হদিসটাই ঠিকমতো পেয়ে ওঠে না! জীবনভোর শেখানো বুলি আউড়ে শেষমেশ ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ খেয়ে ধেড়ে বাঁদর হওয়া ছাড়া তাদের কী-ই বা গতি হয়? আরে, স্বাধীন দেশের ছেলেপুলে সব, তাদের সাবালক, বলিষ্ঠ একখানা মন থাকবে না? স্বাতন্ত্র্য আর স্বকীয়তার দাবি থাকবে না? নাকি তাদের স্বাতন্ত্র্যের নানা রকমগুলোকে কেটেছেঁটে একুশে আইন চাপিয়ে দিলেই ইশকুল, মাস্টার আর দেশের ভারী উন্নতি হবে? এই যেমন ‘গুণকরা’ গল্পের ফাগু মানে না ইশকুলের মাহাত্ম্য। ফাগু বড়লোকের বাড়িতে কাজ করে, বিনিময়ে খেতে ও থাকতে পায়। কিন্তু চলতি স্রোতের বিপরীতে তার বিশ্বাসটুকু বাঁচিয়ে রাখতে সে তো ভয় পায় না। কড়া যুক্তি দিয়ে বলে, “ইশকুলে পড়ে ছেলেপুলেরা কেতাবি বুলি আওড়ায় ঠিক, কিন্তু তেঁতুলপাতায় মন্ত্র পড়ে বাঘ বানাতে শেখে কি?” নিদুলি মন্তরের জোরে তেঁতুলপাতাও যে বাঘ হয়ে ওঠে, এ তাদের জঙ্গলের পুরনো বিশ্বাস! একই ভাবে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে এসে সাঁওতাল ছেলেটিও সাহসী বিশ্বাসে বলে যে, জিলিপি-শিঙাড়া খেতে ভাল বটে, কিন্তু ও সব শহুরে খাবারের চেয়েও মেঠো ইঁদুরের মাংস ঢের বেশি মন কাড়ে!

কথায় বলে, স্বাধীনতার অর্থ বড় ভারী, বড় ব্যাপক। তার নাগাল পেতে পরিবার, জীবন আর দেশের বাইরেও অনেকখানি বড় যে পৃথিবী, তার স্বপ্ন দেখতে হয়। সে পৃথিবীর ইতিহাস নেই, ভূগোল নেই, যখন খুশি, যেখানে খুশি তার সীমানা বাড়িয়ে নিলেই হল, সেখানে শিশিরকুচির উপর সূর্যের আলো পড়ে রামধনু রং ঠিকরোয়, খোলা আকাশে লাল-নীল পাখিরা খেলা করে! রোদ্দুর ওঠে, বৃষ্টি পড়ে, কাঠের গায়ে ব্যাঙের ছাতা বেড়ে ওঠে আপনাআপনিই। কেউ তাদের ইচ্ছেয় বাঁধ দেয় না, ভাগাভাগির অঙ্ক কষে না! তা হলে সত্যিকারের পৃথিবীতে কেন তার উলটপুরাণ? সে ক্ষোভ বার বার উঠে এসেছে লেখিকার কলমে, “কেন এই ব্যবধান? কিসের এত ভাগাভাগি?”

তিনি ভেবেছেন হয়তো কল্পনাশক্তির অভাবই এর কারণ, ভেবেছেন, সরসতা আর সরলতার ছবি সামনে না ধরলে স্বাধীন মন-গড়া হবে কী করে? তাই বার বার তাঁর লেখায় স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে এসেছে কলু, পানু, নেড়ুরা; এসেছে ভালবাসা-স্নেহ-সহানুভূতিতে উজ্জ্বল না-মানুষেরা। চেনা জীবনের একঘেয়ে বিন্যাসের বুনটকে রোমাঞ্চ, কল্পনা আর ইচ্ছেপূরণের দাবি দিয়ে ভেঙেচুরে দিয়েও আবার সে ভাঙা দিব্যি জুড়ে দিয়েছেন কল্পনার সাত রঙে। আর কল্পনার সে বিকল্প রং আশপাশেই খুঁজে নিয়েছেন অনায়াসে। লেখিকার ‘বিকল্পতা’র ধারণায় বাঙ্ময় হয়েছে ভিন্ন জীবনবোধের অনুভূতিরা, যারা স্বাধীন, সভ্য শহরের পরিশীলিত পরিভাষায় ‘প্রান্তিক’ হিসেবে পরিত্যক্ত হয়েছে। তাঁর বিদ্রোহ প্রাণ পেয়েছে তাঁর কল্পনার বিস্তারে, যে কল্পনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিক্ষিত বাঙালির শালীনতার পাঠও লজ্জা পেয়েছে। শিশুর স্বপ্নযাপনের নিয়ন্তা হয়েছে প্রান্তিক মানুষ, পাখি বা পশুরা। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত, অনাবিল মিলমিশে বিভেদের ব্যাকরণও গুলিয়ে গিয়ে বেবাক চুপ হয়ে গেছে। শুধু কি তা-ই? বড়লোকের কেতাদুরস্ত ঘরে গাদাগাদি করে শুয়েছে গোটা-পঁচিশেক শুয়োরছানা, বিখ্যাত গোয়েন্দা পাহাড়তলির ছোট্ট শহরে গিয়ে মোচার ঘণ্ট আর শুক্তুনি রেঁধে রাতারাতি আরও বিখ্যাত হয়ে গেছে, রাম-ভিতু নিমাইখুড়ো শেষে কিনা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্ধর্ষ ডাকাতসর্দার! লীলা মজুমদারের স্বপ্নজগৎ খুদে পাঠকদের ইচ্ছেপূরণের দোসর সেই স্বাধীন সমাজটাই চিনিয়েছে, যে সমাজে বৈচিত্র আছে, স্বাতন্ত্র্য আছে, স্বাতন্ত্র্য পালনের স্বাধীনতাও আছে, কিন্তু ব্যবধান নেই, বৈরিতা নেই। সে জগতে এক সঙ্গে থাকে কলু, পানু, ঘোঁতন, থাকে কুচকুচ্চে কালো, কোমরে রুপোর ঘুনসি পরা ভূতের ছানা, থাকে খোঁড়া কাঠের ঘোড়া, পাখা-ভাঙা হাঁসেরা, খ্যাংরাকাঠির মতো গোঁফ আর দাড়িতে কাদার ছিটেওয়ালা ঝগড়ু, আর থাকে রহস্যময় এক হলদে পাখি, যার পাখায় অনুভূতির তীব্র আনন্দ প্রাণ পায়, সত্যির স্বপ্নে আর স্বপ্নের সত্যিতে একাকার হয়ে যায় স্বাধীন দেশের মানবভূমি!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Literature

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy