বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার এই দিনে, রথযাত্রা উৎসবের এই আবহে, বড়ই স্মরণযোগ্য রবীন্দ্রনাথের ক’টি কথা। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ৫৭তম জন্মদিনে ‘কালের যাত্রা’ বইটি তাঁকে উৎসর্গ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “রথযাত্রার উৎসবে নরনারী সবাই হঠাৎ দেখতে পেলে, মহাকালের রথ অচল। মানব সমাজের সকলের চেয়ে বড় দুর্গতি, কালের এই গতিহীনতা। মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধবন্ধন দেশে দেশে যুগে যুগে প্রসারিত, সেই বন্ধনই এই রথ টানবার রশি। সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানবসম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গেছে, তাই চলছে না রথ। এই সম্বন্ধের অসত্য এতকাল যাদের বিশেষ ভাবে পীড়িত করেছে, অবমানিত করেছে, মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আজ মহাকাল তাদেরই আহ্বান করেছেন তাঁর রথের বাহনরূপে; তাদের অসম্মান ঘুচলে তবেই সম্বন্ধের অসাম্য দূর হয়ে রথ সম্মুখে চলবে।”
সমসাময়িক বিশ্বের রাজনীতি প্রত্যক্ষ করে রূপকের আবরণে রবীন্দ্রনাথ ‘রথের রশি’ নাটিকাটি রচনা করেছিলেন। ইতিহাসের আলোয় তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, নানা স্তরের মানুষের দ্বারাই চালিত হয়ে এসেছে মানবসভ্যতার রথ। সেই রথে চড়েই চলেছে কাল। আর তাই একে চলমান রাখতে না পারলে বিপন্ন হয়ে পড়বে আমাদের অস্তিত্ব। এ রথকে সদাচলমান রাখতে সবচেয়ে জরুরি যে রশিটি, সে-ই তো আসলে মানব-বন্ধন।
সত্যদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের কাল থেকে এখনকার কালেও দেখছি আমরা, মানুষে মানুষে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার প্রয়োজন কতখানি। এ বন্ধনে শৈথিল্য দেখা দিলেই সমাজে নেমে আসে অস্থিরতা, সঙ্কটে পড়ে রাষ্ট্র। মানুষে মানুষে সম্বন্ধ-বন্ধন রশিটিকে এরই প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ কখনও ‘রাক্ষস সাপ’, কখনও ‘যেন বাসুকি মরে উঠলো ফুলে’, কখনও বা ‘যুগান্তের নাড়ী’, ‘ডাকিনীর জটা’, ‘হনুমানের পোড়া লেজ’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেছেন। সভ্যতারূপ রথের চালিকাশক্তির জোর কমে গেলে, যে টলায়মান অবস্থার সৃষ্টি হয়, এ সব তো তারই রূপক! বিভিন্ন সামাজিক ও ঐতিহাসিক ঘটনারই প্রকাশ এই রথচক্রের ঘূর্ণন এবং রথের রশির টানকে প্রতীক হিসেবে রেখে। সকলের সমান সুযোগ, সমান অধিকার থাকবে— এমন একটি নতুন সমাজ গঠনের ধারণাই প্রাধান্য পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’তে। সেখানে সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষও ব্রাত্য নয়। অহঙ্কার আর দম্ভের মত্ততার এই দুঃসময়েও রথযাত্রাকে যদি সেই আলোয় দেখতে পারি আমরা, তা হলে মনুষ্যত্বের অবমাননার অবসানকল্পে তা হয়ে উঠতে পারে মস্ত বড় আয়ুধ।
ওই যে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! আবহমান কাল ধরে যে বিশ্বাসটি আমাদের অনেকের মনেই বদ্ধমূল তা হল, রথের রশিতে টান দেওয়া অতি পুণ্যকর্ম। এ কাজে হাত লাগাতে হয় জাতিধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে মিলেমিশে সবাইকেই। সম্বচ্ছরে রথযাত্রার মতো মাত্র একটি উপলক্ষেই কোনও রকম শর্ত ছাড়াই ভগবান নিজেকে সমর্পণ করে দেন ভক্তদের হাতে। যিনি নিজে বিশ্বরথের সারথি, তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে, তাঁরই রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে ধনী-নির্ধন, সব বয়সের, সব ধরনের মানুষ— এতেই ঈশ্বরের হৃদয় যেন শিশুর মতো আনন্দে ভরে ওঠে। আর এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষ যুগ যুগ ধরে মেনে চলেছে, রথযাত্রার দিন রথে সমাসীন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে দর্শন এবং রথের রশিতে টান দেওয়া অবশ্যকর্তব্য। এতে শুধু পাপক্ষালনই নয়, মহাকালের কর্মযজ্ঞে শামিল হওয়ার আনন্দও মেলে। এই আনন্দ লাভই তো পুণ্যার্জন।
এক দিন আমাদের বিচারব্যবস্থার যে প্রতীকটি তৈরি করা হয়েছিল, পক্ষপাতহীনতা বোঝাতে তার চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল কালো কাপড় দিয়ে। কিন্তু এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যিনি সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ বিচারকর্তা, তাঁকে থাকতে হয় সদাজাগ্রত। মহাপ্রভু জগন্নাথের চোখও তাই আবরণহীন। সব কিছুই তাঁর কাছে দৃশ্যমান। কোনও কিছুই তাঁর অগোচর নয়। আজও তিনি দেখছেন, কখনও কখনও বিভেদের মেঘ ঘনিয়ে তোলার অপপ্রয়াস হলেও, তা ব্যর্থ করে দিতে এগিয়ে আসছে মানুষই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবি দৃশ্যমান আজও কত জায়গায়। এই বাংলারই বাঁকুড়া জেলার খাতড়া মহকুমার কুঁড়েবাকড়া গ্রামেই তো রয়েছে এর দৃষ্টান্ত। খাতড়া থেকে ছ’কিলোমিটার দূরের ছোট এই গ্রামটিতে ৬০টি হিন্দু আর ২০টি মুসলমান পরিবারের বাস। সেখানকার রথযাত্রা উৎসবে প্রতি বছর রথের রশিটি আসে এক মুসলমান পরিবার থেকে।
রথের রশি মনে করিয়ে দেয় কত কথা। পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার অন্তর্গত কুলীনগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৈষ্ণব সংস্কৃতি। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য রচয়িতা মালাধর বসুর জন্মস্থান এটি। তাঁর পৌত্র রামানন্দ ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ সহচর। কুলীনগ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্কীর্তনের একটি দল ছিল। পুরীর রথের আগে আগে গৌরাঙ্গ যখন নাচতে নাচতে যেতেন, এই গ্রামের কীর্তনের দলটিও তাঁর সঙ্গে চলত। জনশ্রুতি, এক বার পুনর্যাত্রার সময় রথের একটি দড়ি ছিঁড়ে যায়। সেই ছেঁড়া দড়িটি শ্রীচৈতন্য রামানন্দের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, “এই পট্টডোরীর তুমি হও যজমান,/ প্রতি বর্ষ আনিবে ডোরী করিয়া নির্মাণ।”
সেই থেকে নাকি কুলীনগ্রামের রজ্জু না পৌঁছনো পর্যন্ত পুরীর রথ টানা শুরু হত না। এ প্রথা বলবৎ ছিল বহু যুগ। অবশ্যই অনেক পুরনো দিনের কথা। এর সত্যাসত্যের বিচার করবেন পণ্ডিতরা, আমাদের বিশ্বাসটুকুই সার। আমরা শুধু জানি, ধর্ম আর ইতিহাসই হল জনশ্রুতির আধার। যা হোক, পরবর্তী কালে অবশ্য নয়াগড়ের দাসপাল্লা থেকে ভঞ্জদের সূত্রধররা এসে পুরীর রথ নির্মাণ করত। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে রশিও তৈরি করত তারা। বর্তমানে এই রশি আসে কেরল থেকে। বলরামের রথের রশির নাম বাসুকী, জগন্নাথের শঙ্খচূড় আর সুভদ্রার রথের রশির নাম স্বর্ণচূড়। রথের মতো তাদের রশির নামেওকত বৈচিত্র।
বৈচিত্র আমাদের ধর্মে, আমাদের কর্মে, আমাদের সংস্কৃতিতে। বৈচিত্রের এই সমাহারেই একসূত্রে গাঁথা হয়ে আছে আমাদের জীবন। সেইখানেই যোগ সবার সঙ্গে সবার। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য নিয়ে যে জীবন আমাদের, তা নিয়ে বিশ্ববাসীর কৌতূহলও অফুরান। রথযাত্রা উৎসবেও দেখি সেই একই ছবি। প্রতি বছর কেবল পুরীতেই নয়, শ্রীরামপুরের মাহেশ কিংবা ইসকনের রথের রশিতেটান দিতে দেখা যায় বিশ্বের কত না দেশের মানুষদের।
এ সব কিছু নিয়েই রথ চলে, রথ চলবে। মহাকালের রথে চড়েই অগ্রগমন হবে সমগ্র মানবজাতির।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)