শিবমোহিনীর জন্ম আন্দাজ ১৮৫২ সালে। পিতার নাম চণ্ডীচরণ দত্ত মুন্সী। নিবাস হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রাম। শৈশবেই মা মারা যান। পিতা আবার বিবাহ করেন। দশ বছর বয়সে বিয়ে হয় শিবমোহিনীর। বারো বছর বয়সেই বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসা। বিমাতা একেবারেই সদয় ছিলেন না তার উপর। ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম তাকে দিয়ে করানো হত। শেমিজ ছাড়া এক কাপড়ে সিঁড়ির তলায় খালি মেঝেতে শুতে হত, পালন করতে হত নির্জলা একাদশী। প্রতিবেশী পরিবারের মেয়ে, সই হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যাবেন বলে তাদের পরিবারের সঙ্গে এক দিন কলকাতা চলে আসেন শিবমোহিনী। তখন কলকাতায় বিদ্যাসাগরের কৃতি বিধবা বিবাহ নিয়ে তুমুল কাণ্ড চলছে। শিবমোহিনী ও বিদ্যাসাগরের এই কাহিনি পাওয়া যায় অধ্যাপিকা ও প্রাবন্ধিক কল্যাণী দত্তর লেখা ‘শিবমোহিনী ও বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধ থেকে। শিবমোহিনী ছিলেন সম্পর্কে কল্যাণী দত্তের পিসিমা, বাবা দাশরথি দত্তের বৈমাত্রেয় দিদি।
কলকাতায় এসে হেমাঙ্গিনী এক দিন শিবমোহিনীকে নিয়ে বিদ্যাসাগরের বাড়ি গেল। তিনি তখন বাজারে গেছেন। অগত্যা তাঁর বাড়ির রোয়াকে বসে অপেক্ষা করতে হল। বিদ্যাসাগর ফিরে ওদের দেখে ভাবলেন, আজ আবার কারা দু’টি মেয়েকে রোয়াকে বসিয়ে দিয়ে গেছে! তাঁকে দেখে শিবমোহিনী কাঁদতে লাগল আর হেমাঙ্গিনী সব ঘটনা খুলে বলল। বিদ্যাসাগর বললেন, ‘দেখ, বিধবাদের আমি বিয়ে দিচ্ছি সত্যি কথা, কিন্তু আমি খুব ব্যস্ত মানুষ। ভালো ঘরে বিয়ে করে ঘরসংসার করতে চাইলে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। বাড়িতে না বলে তুমি এসেছ, ফেরার তো কোনো পথ নেই, আমার বাড়িতে তুমি থাক, পরে দেখা যাবে।’ সেই থেকে শিবমোহিনী বিদ্যাসাগরের বাড়ি থাকতে শুরু করলেন।
১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন প্রচলিত হওয়ার পরে বহু বিধবার বিয়ে হয়েছিল। বহু অর্থব্যয়ে তিনি তাঁদের বিবাহ দিতেন। ফলে এক সময় তাঁর ধার বেড়ে দাঁড়ায় ৫০,০০০ টাকা। কারণ পাত্ররা অনেক সময় ভয় দেখাতেন, যথেষ্ট টাকা না দিলে তাঁরা স্ত্রী-কে পরিত্যাগ করবেন৷ এমন ঘটনাও বিরল ছিল না যে, একাধিক পত্নী থাকা সত্ত্বেও তাঁরা বিদ্যাসাগরকে ঠকিয়ে তাঁর দেওয়া যৌতুক নিয়ে বিধবা বিবাহ করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাই বিদ্যাসাগর অনেক ক্ষেত্রে বিধবা বিবাহে এক টাকার স্ট্যাম্প কাগজে অঙ্গীকারপত্র লিখিয়ে নিতেন... ‘আমি ধর্মপ্রমাণ প্রতিজ্ঞা করিতেছি, আমি প্রকৃতরূপে পতিধর্ম পালন করিব, অর্থাৎ তোমায় যাবজ্জীবন সাধ্যানুসারে সুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে রাখিব তোমার প্রতি কখনও অনাদর প্রদর্শন করিব না, আর ইহাও অঙ্গীকার করিতেছি তোমার জীবদ্দশায় আমি আর বিবাহ করিব না।...’ এবং তাতে সমাজের চার জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর থাকবে। শিবমোহিনীর কথা থেকে পাওয়া যায়, কিছু কাল বিদ্যাসাগরের বাড়িতে কাটাবার পর বিদ্যাসাগর এক দিন তাঁকে ডেকে বলেন, ‘দেখ, বিয়ের সময় আমি অনেক টাকা দিই। অনেক ছোকরা তাই নিয়ে বিয়ের পরই পালিয়ে যায়। তোমার জন্যে ছোকরা পাত্তর খুঁজব না। একটি দোজবরে ভালো পাত্তর আছে। তুমি যদি সংসার করতে চাও, তা হলে তার সঙ্গেই বিয়ে দিতে ইচ্ছে করি।’ শিবমোহিনী সম্মত হলে বিদ্যাসাগরমশাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চণ্ডীচরণ সিংহর সঙ্গে তার বিবাহ দেন। শিবমোহিনীর সঙ্গে চণ্ডীচরণের বিবাহের ব্যাপারে পারিবারিক তথ্য বলছে, কেশবচন্দ্রের অনুগত চণ্ডীচরণের বিবাহে বিদ্যাসাগর তরুণ ব্রাহ্মদের পথের অনুসারী ছিলেন। তাই সে বিবাহ হিন্দুমতে হয়নি এবং বিদ্যাসাগর শিবমোহিনীকে সম্প্রদানও করেননি। কিন্তু বিবাহের সময় কন্যাপ্রতিম ‘শিবু’কে মোটা অমৃতিপাকের বালা ও গলার হার ছাড়াও খাগড়ার সর্বসুন্দরী ঘড়া, কামরাঙা বাটি, ‘যাজপুরী’ কাঁসি, নবাসনের থালা, পানের বাটা, ভাল জাঁতি ও মেদিনীপুরের বেলের গড়নের ক্ষীর খাওয়ার বাটি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘আমার ইচ্ছেমতো তোমায় কিছু জিনিস দিলাম, তুমি যেন ওখানে গিয়ে আমার বাবা এত দিয়েছে, অত দিয়েছে বলে বড়াই কোরো না।’