Advertisement
E-Paper

খিচুড়ির হরেক অবতার

হাঁড়ি-চাপা দিয়ে দেওয়াল তোলা নয়। ‘এসো, এসো যে হও, সে হও’ আহ্বানেই খিচুড়ির প্রকৃত মন্ত্র। বাংলা তো বটেই, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে,  এমনকি বিদেশেও নানান বর্ণে গন্ধে স্বাদে রসনা মাতিয়েছে সে। নিজেকেও পাল্টেছে বারবার।হাঁড়ি-চাপা দিয়ে দেওয়াল তোলা নয়। ‘এসো, এসো যে হও, সে হও’ আহ্বানেই খিচুড়ির প্রকৃত মন্ত্র। বাংলা তো বটেই, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে,  এমনকি বিদেশেও নানান বর্ণে গন্ধে স্বাদে রসনা মাতিয়েছে সে। নিজেকেও পাল্টেছে বারবার।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৮:০০

বর্ষার দিনে যদি খেতে পাই খিচুড়ি,

তবে আর দরকার নেই কোনও কিছুরি।

বছর ৫০ আগে এই সুমহান পদ্য মিলিয়েছিলেন বটে অন্নদাশঙ্কর রায়! ভাবতে মন্দ লাগে না, এই সতত পরিবর্তনশীল জীবনে কিছু অনুভূতি একই রকম থেকে গিয়েছে। তখন খাদ্য আন্দোলনের স্মৃতি টাটকা। প্রফুল্ল সেনের আমলে চাল কম খান, লাল গম খান বা কাঁচকলা খান-এর ডাক নিয়ে ক্ষোভ! মাগ্‌গিগণ্ডার বাজারে চালডাল, গাওয়া ঘি জুটিয়ে খিচুড়ির আশাপূরণ চাট্টিখানি কথা ছিল না। অন্নদাশঙ্করের খিচুড়ি-স্তবে তাই প্রগাঢ় দীর্ঘশ্বাসও মিশেছে।

বলি বটে, কে না জানে আজকের হালচাল

কোথা পাই গাওয়া ঘি, কোথা পাই চালডাল

...চাইলে কি খেতে পাই, এক থালা খিচুড়ি!

এই বর্ষায় বহু বাঙালিরই মনোগত বাসনা ওটাই— এক থালা খিচুড়ি। সঙ্গে একটু আলুভাজা-বেগুনভাজা থাকলেই রোববারের দুপুর জমে যায়, ইলিশভাজা থাকলে তো সোনায় সোহাগা। সেই খিচুড়ি ট্যালটেলে নরম হবে, না কি ভোগের খিচুড়ির মতো আঁটোসাঁটো, সে নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বাসি খিচুড়ি স্বাদে বাড়ে, এই মতও আছে।

রাজনীতিতেও এখন ‘খিচুড়ি-পুজো’র আলাদা গরিমা। ‘ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া ফুড’ হিসেবে মেলে ধরতে ডাল-চালের খিচুড়ির শরণ নিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। গত বছরের শেষাশেষি তাঁর আহ্বানে, একযোগে ৯১৮ কেজি খিচুড়ি কড়াই-বন্দির দৃশ্য দেখে আসমুদ্র হিমাচল। এ হেন কৃতিত্ব গিনেস বইয়ে ঠাঁই পেয়েছিল। দেশে-দেশে দূতাবাস মারফত খিচুড়িকে জনপ্রিয় করার নির্ঘোষও তখন কানে এসেছে।

শুনে মনে হচ্ছিল, ঠিক এক দশক আগে শাহরুখ থুড়ি কবীর খান অবধি যে কাজটা করতে ফেল মেরেছিলেন, মোদীজি এ বার সেটাই দেখিয়ে ছাড়লেন। ‘চক দে ইন্ডিয়া’ সিনেমাটা বোধ করি অনেকেরই মনে আছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা জাতীয় হকি দলের মেয়েদের ‘এক জাতি, এক প্রাণ’ করে গড়ে তোলার সাধনায় মেতেছিলেন কোচমশাই! কিন্তু তিনিও কোনও সর্বভারতীয় খাবারের তারে সেই টিমকে বাঁধবার পথ খুঁজে পাননি। টিম স্পিরিট তৈরি করতে লাঞ্চে সক্কলকে নিয়ে কবীর খানকে আমেরিকান বার্গারবীর ম্যাকডোনাল্ডস-এর আউটলেটেই যেতে হয়েছিল।

এই খাদ্যের রুচির প্রশ্নে ভারতীয় ঐক্য বার বার ধাক্কা খায়। কাশ্মীরি বা বাঙালি বামুনের সঙ্গে তামিল ব্রাহ্মণের এক টেবিলে বসা প্রাণান্তকর! সেই শেয়াল আর সারসের নেমন্তন্নের মতো, খানা মুখে তোলা দূরে থাক, গন্ধেই প্রাণ বেরোবে। এই পটভূমিতে মোদীর খিচুড়ি-তত্ত্বের প্রয়োগে কেউ কেউ রাজনীতির গন্ধও পেয়েছিলেন। যার মধ্যে নিহিত বার্তা: ‘এক জাতি, এক প্রাণ’-এর ঢঙে ‘এক হাঁড়ি’র আত্মীয়তায় দেশটাকে বাঁধতে পারে নিরামিষ খিচুড়িই। এ হল সুপ্রাচীন খেচরান্ন! আয়ুর্বেদশাস্ত্র চরকসংহিতা অবধি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মাষকলাই, তিল, দুধ ও মুগডালের সঙ্গে অন্ন পাক করাটা বলকারক, তৃপ্তিকর, পুষ্টিকর ও মাংসবিশিষ্ট পলান্ন বা পোলাওয়ের সমতুল্য বলা হয়েছে। খাঁটি নিরিমিষ হয়েও খিচুড়ি মাংসের সমান! আমিষখোর বাঙালির প্রাচীন ছড়াও বলছে,

ডালে আর চালে খিচুড়ি বানায়।

খিচুড়ির স্বাদ পোলায়ে না পায়।।

খিচুড়ি বৈষ্ণব ও পোলাও শাক্ত।

নিরামিষ হিন্দু খিচুড়ির ভক্ত।।

প্রকাণ্ড কড়াইয়ে সুনামির মতো তালতাল চালডালের তরঙ্গ ধেয়ে আসা ছবিটার কথা ভাবলেই এ বার মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, কর্পূর-ধূপ-ধুনোর সুরভিও ভেসে আসছে। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই মনে আর এক খটকা! পুরীর শ্রীমন্দিরের চাতালে সন্ধের মুখে উৎকলদেশীয় দয়িতাপতিদের দাক্ষিণ্যে পরিপাটি করে পাতে নুন-লঙ্কা কচকচিয়ে যে খিচুড়ি খেয়েছিলুম, তার সঙ্গে তিরুপতির মন্দিরের প্রসাদী মিষ্টি-মিষ্টি পোঙ্গল কিংবা বেঙ্গালুরুর আমুরুতাহাল্লিতে বোনের বাড়ির পড়শিরা গণেশপুজোয় যে ‘বিসিবিলি বাথ’ খাওয়ালেন তা কি এক গোত্রের? বন্ধুর কাছে শোনা গল্প, চেন্নাইয়ে এক কর্পোরেট লাঞ্চে ‘বিসিবিলি বাথ’-এর খাঁটিত্ব নিয়ে কন্নড় ও তামিলভাষী দুই সহকর্মীর তুমুল ঝগড়া বেঁধেছিল!

‘বিসিবিলি বাথ’ অবশ্য কর্নাটকেরই খিচুড়িবিশেষ। আনাজবিশিষ্ট চাল-অড়হর ডালের মিশেলে সম্বরের ধাঁচের মশলার তীব্রগন্ধ। কলকাতার এক তামিল গিন্নি দুঃখ করেছিলেন, দুরন্ত বিসিবিলি রেঁধেও এই বেরসিক বাঙালিদের মন পাওয়া কঠিন। আবার পোঙ্গল ও জগন্নাথদেবের ডায়েটের খিচুড়ি দুটোতেই চাল বেশি, ডাল কম! কিন্তু স্বাদে মিল নেই ছিটেফোঁটা।

কৃষ্টে আর খ্রিস্টে ভেদ না-ই থাকতে পারে, এ ভারতভূমির খিচুড়িতে খিচু়ড়িতে অতএব ঘোর প্রভেদ। এমনকি, খিচুড়ির আঁশকাঁটাহীন সাত্ত্বিক চরিত্রটিও আদৌ ধোপে টেকে না। বাদশা জাহাঙ্গির মুখ বদলাতে নিরামিষ গুজরাতি খিচুড়ি লাজ়িজ়ায় নিমগ্ন হতেন বলে শোনা যায়! তবে বিপ্রদাস মুখুজ্যের ‘উনিশ শতকীয় পাক-প্রণালী’তে জাহাঙ্গিরি খিচুড়ির আবশ্যিক উপাদানই হল মাংস। বিপ্রদাসের খিচুড়ি-তালিকার গোড়াতেই মোগলাই খিচুড়ি, যাতে চাল-ডালের থেকে ঢের বেশি মাংস, গাদাখানেক হাঁসের ডিমের গাদাগাদি! ফি-শুক্রবার কলকাতার মুসলিম মহল্লার হোটেলের খিচড়ার সঙ্গে আদলটা খানিক মিলছে। ওয়াজিদ আলি শাহের বাড়ির মেয়ে মনজ়িলাত বেগমের কাছেও শুনেছি, রমজানি হালিমের মতো মসৃণ, থকথকে গোলা না-হলেও খিচড়াতেও প্রধানত নানা কিসিমের ডালের সমাহার।

বিলেতের তারকা শেফ গর্ডন র‌্যামসেকে ইউটিউবে ভাতের সঙ্গে কোয়েলের ডিম, স্যামন মিশিয়ে থাইম-সুরভিত ক্যাডগেরি রাঁধতে দেখলুম, তার প্রেরণাও নাকি ভারত ও খিচুড়ি। ক্যাডগেরিতে অবশ্য ডাল নেই। তবে এই মেছো খিচুড়ি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরাই রপ্ত করেছিলেন, পরে ইউরোপ পাড়ি দিয়েছে। সে দিক দিয়ে স্পেনের পায়েয়া, ইতালির রিসোত্তো, মেক্সিকোর জাম্বালায়া, চিনের কোনজির মতো রকমারি শাকসব্জি, মাছ-মাংসবহুল ভেতো রান্নাও খিচুড়ির দূর সম্পর্কের কুটুম। কলকাতার এক শেফকে দেখেছি তাঁর রেস্তরাঁয় লোক টানতে খিচুড়িকে মেনুতে ‘লেন্টিল রিসোত্তো’ লিখে, চিনে সেজুয়ান সসে মাখা মাছভাজার সঙ্গে পেশ করছেন।

মারওয়াড়ি খিচুড়িতে বাজরার আধিক্য, গুজরাতের সাবুদানার পথ্যি— এত শত কচকচিতে না-ঢুকে খিচুড়ির সঙ্গীদের নিয়েও চমৎকৃত হতে হয়। জগন্নাথধামেই প্রথম দেখেছি, প্রসাদী ভোগের সঙ্গতে মুলো-পটল-নারকোল ভরপুর চমৎকার থকথকে অড়হর ডাল, যার নাম ডালমা। কাশী বোস লেনের মারওয়াড়ি কুলপতি গোবিন্দরাম চৌধুরীদের ঘরে বাজরার খিচুড়িতে দলা-দলা মাখন দিতে দেখে প্রায় হার্ট অ্যাটাক হচ্ছিল। সাইড ডিশ মিষ্টি তেঁতুলগোলা ইমলানা ও দই-বাজরার অভিনব গরম রাবড়ি। বাঙালির লাবড়া বা ইলিশভাজার কথা না-হয় ঊহ্যই থাকল। ঘনিষ্ঠ অসম-কানেকশনসম্পন্ন একটি বাঙালি পরিবারে কাঁকড়ার খিচুড়ির সঙ্গে পাটশাক সেদ্ধ ও টক-টক পেঁয়াজের চাটনি চেখেছি। গুচ্ছের নিরামিষ খিচুড়ি শিখিয়েও ঠাকুরবাড়ির মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী বলেছেন, ‘‘ভুনি খিচুড়ি বিশেষত ডিমের আমলেট, কান্ট্রিকাপ্তেন, ক্রাম দিয়া মাছ ভাজা, শুঁটকি, মেটে ভাজা প্রভৃতি ‘শুকনা শাকনা’ দিয়া খাইতে ভাল!’’

অনেক বাংলা বইয়ের কাঠপুতুল হিরো-হিরোইনের খুঁত ঢাকতে যেমন দক্ষ পার্শ্বচরিত্রের দরকার হয়, খিচুড়িকেও অনেক সময়ে তার আনুষঙ্গিক টুকিটাকি টাকনাই উতরে দেয়। রামকৃষ্ণ মিশনের ইস্কুলে দেখেছি, শুধু দু’মুঠো বোঁদে পেলেই ট্যালটেলে খিচুড়ি এক বালতি নিমেষে সাবড়ে ফেলছেন পুরুলিয়ার প্রান্তিক গ্রামবাসী। কয়েক বছর আগে এক ভিন শহরে চাকরিতে বদলির সূত্রে ট্রেন লেট করে পৌঁছে গাদাগুচ্ছের প্যাকিংবাক্স ওলটপালট দড়িদড়া টানাহ্যাঁচড়া-পর্ব শেষ হলে রাত ১২টায় যে খিচুড়ি বসেছিল, তার প্রাণভোমরা ছিল জলপাইয়ের আচার ও কয়েক মুঠো চিংড়ি।

খিচুড়ির আসল শক্তি এই গ্রহণ করার ক্ষমতায়। দেশকালের সীমান্ত তার কাছে অবান্তর! যথার্থ রসিক জানেন, গাওয়া ঘিয়ের বদলে হ্যামের কুচি, বেক্‌ন অয়েলের স্বাদও খিচুড়িকে মহিমময় করে। দক্ষ শেফের হাতযশে শ্যামদেশের গ্রিন কারি পেস্ট বা গোমাংসের কিমাও খিচুড়ির উত্তরণ ঘটায়। যেমন ‘শক-হুন-দল পাঠান-মোগল, এক দেহে হোলো লীন’! তবে খিচুড়ির নানা রকম জিনিস আলাদা করে চিনতে পারা চাই। লীলা মজুমদার রেসিপি বইয়ে শিখিয়েছেন, ‘জিনিসগুলো একটাও ভেঙে কাদা হলে চলবে না। আবার কোনওটা পটপট করে চেয়ে থাকবে না।’ এ কী শুধু খিচুড়িরই কথা! বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য বলতে যা স্কুল থেকে শিখে আসছি, তা কি এর থেকে আলাদা কিছু?

খিচুড়ির নিরাভরণ নিরামিষ ভারতীয়ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তাই ধোপে টেকার কথা নয়। একঢালা ভারতীয়ত্বের বদলে খিচুড়ির বার্তা হিসেবে শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত, তত পথ’টাই বেশি জুতসই মনে হয়। খিচুড়ির ঢালাও প্রশংসা করেও মহর্ষি চরকেরও সাবধানবাণী: খেচরান্ন গুরুপাক, দুর্জর (সহজপাচ্য নয়)। সাধের খিচুড়ির পরতে পরতে এত বাঁক, রোমাঞ্চ— আজকের শাসকরা হজম করতে পারবেন তো?

Khichdi Khichdi Recipes
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy