২০১০ সালে আমাদের এভারেস্ট অভিযানের আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে চার বার এভারেস্ট অভিযান হয়। ১৯৯১ সালে প্রথম অভিযানে দলনেতা ছিলেন প্রাণেশ চক্রবর্তী। তিব্বতের দিক দিয়ে সংঘটিত এই অভিযানটি সফল হয়নি বটে, কিন্তু বাংলার পরবর্তী অভিযানগুলির জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। ১৯৯৩ সালে বাংলার দ্বিতীয় এভারেস্ট অভিযানটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অমূল্য সেন। উত্তর দিক থেকে আয়োজিত এই অভিযানটিও সাফল্যের মুখ না দেখলেও, গ্রেট কুলোঁয়া পথে তাঁরা আসল প্রতিবন্ধকতা জয় করে ৮০০০ মিটারের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছিলেন। ভাগ্যের সহায়তা পেলে বাংলার পর্বতারোহী মহল সে বারই এভারেস্ট জয়ী হতে পারত। এর পরেও ১৯৯৫ ও ২০০১ সালে আরও দুটি অসফল অভিযান হয়, সেগুলোর সঙ্গে অমূল্যদার কোনও যোগ
ছিল না।
ওঁর মাসতুতো ভাই রণদীপ দাশগুপ্ত বলছিলেন, অমূল্যদা ছিলেন পরিবারের সবার প্রিয় ‘কানুদা’। বাবা এ সি সেন তখনকার নামকরা ইংলিশ গ্রামার বইয়ের লেখক। সচ্ছল পরিবার, মুদিয়ালিতে রাস্তার উপরেই বিশাল বাড়ি। রণদীপের ছোটবেলায় সেই বাড়ি ছিল কাছে-দূরের ভাইবোনদের লোভনীয় গন্তব্য। সঙ্গে উপরি পাওনা কানুদাদের গাড়ি চড়া। কানুদার পর আরও তিন ভাই ও দুই বোন। সব ভাইবোনদের বড় তিনিই। খুব রসিক ছিলেন, চিরকাল এক ছেলেমানুষি ছিল তাঁর মধ্যে। আর ছিল সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার এক গুণ। পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী, সে যতটুকু সময়ের জন্যই হোক না কেন।
হিমালয় ছিল ধ্যানজ্ঞান। সময় পেলেই পাহাড়ে ছুটে যাওয়ার নেশা। এমনই নেশার টান যে বিয়ে পর্যন্ত করতে অনীহা। বিয়ের দিনও লগ্ন পার হয় হয়, বাবুর দেখা নেই। কেলেঙ্কারি হয় আর কী। খোঁজাখুঁজি শেষে পাওয়া যায় তাঁকে। কানুদা পেশায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার জনসংযোগ আধিকারিক। স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে সংসার। জীবনের শেষ দশটা বছর অনেক শোক সইতে হয়েছিল তাঁকে। এক ভাই মারা গিয়েছে বহু বছর আগে, আর এক ভাই বছর দশেক। একমাত্র ছেলেও ব্রেন ক্যান্সারে চলে যায় ২০১১ সালে। ছোট ভাইয়েরও মৃত্যু হয় মাস দেড়েক আগে। তবে কাছের মানুষদের চলে যাওয়ার কষ্টও কানুদার প্রাণোচ্ছল স্বভাবকে
পাল্টে দেয়নি।
ভারতবর্ষে পর্বতারোহণ নিয়ে চর্চা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ১৯৫৩ সালে প্রথম এভারেস্ট আরোহণের পর তার ঢেউ এসে পড়ে ভারতবর্ষ তথা বাংলার পর্বতারোহী মহলে। জওহরলাল নেহরুর প্রেরণায়, বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে দার্জিলিঙে স্থাপিত হয় প্রথম পর্বতারোহণের শিক্ষাকেন্দ্র, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট (এইচএমআই)।
১৯৬০ সালে বাংলা থেকে সুকুমার রায়ের নেতৃত্বে প্রথম অভিযান হয় গঢ়বাল হিমালয়ের নন্দাঘুণ্টি শৃঙ্গে। সফল সেই অভিযান বাঙালিদের অভিযানের বাসনা আরও বাড়িয়ে দেয়। এর পরেই হিমালয়ান অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ১৯৬২ সালে নীলগিরি অভিযান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলনেতা হওয়ার জন্য খোঁজ পড়ে পর্বতারোহণে বেসিক ও অ্যাডভান্স কোর্স করা কারও। খুঁজে পাওয়া যায় অমূল্য সেনকে। ইতিমধ্যেই এইচএমআই থেকে ১৯৬০ সালে বেসিক ও পরের বছর ১৯৬১ সালে অ্যাডভান্সড মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করে ফেলেছিলেন তিনি। সেই অভিযানে নিতাই রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ আরও পাঁচ জন সফল আরোহণ করেছিলেন।
এর পর অসংখ্য অভিযানে নেতৃত্ব দেন অমূল্যদা। কারও মতে সংখ্যাটা ৩৪, কারও মতে ৩৭, কারও হিসাবে ৫০। তাঁর যোগ দেওয়া অভিযানগুলোর মধ্যে রয়েছে পঞ্চচুল্লি, রাথোং, চন্দ্র পর্বত, কেদারনাথ, কেদারডোম, সতোপন্থ, সুদর্শন, সিনিয়লচু, কোকথাং ইত্যাদি। ১৯৯৪ সালে ৬২১০ মিটারের এক অনামী শৃঙ্গ অভিযানের নেতৃত্ব দেন তিনি। অবিজিত সেই শৃঙ্গ আরোহণের পর তার নামকরণ হয় ‘রাধানাথ’— প্রখ্যাত রাধানাথ শিকদারের নাম অনুসারে। তার আগের বছরে তিব্বতের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের পর্বতারোহীদের হয়ে তাঁর এভারেস্ট অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তো আগেই বলেছি। সফল হয়নি তা।
দীর্ঘ পর্বতারোহী জীবনে অসংখ্য অভিযানে নেতৃত্ব দিলেও অমূল্য সেনের আরোহণের সংখ্যা কিন্তু খুবই সীমিত। পর্বতারোহণের কুশলতায় সেই হিসেবে সমসাময়িক বাঘা বাঘা বাঙালি পর্বতারোহী, যেমন সুজল মুখোপাধ্যায় কিংবা অমিয় মুখোপাধ্যায়ের তুলনায় বেশ পিছনেই ছিলেন অমূল্যদা। কিন্তু প্রায় ছয় দশক ধরে শৈলারোহণ, পর্বতারোহণের মতো অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন সদা প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি এই মানুষটি। প্রখ্যাত লেখক শঙ্কু মহারাজের ‘সুন্দরের অভিসারে’, ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ বা ‘তমসার তীরে তীরে’ আবর্তিত হয়েছে অমূল্য সেনকে ঘিরে।
১৯৯৮ সালে পেয়েছেন ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার অ্যাওয়ার্ড, যা পরবর্তী কালে হয়েছে তেনজিং নোরগে-র নামে— তেনজিং নোরগে ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার অ্যাওয়ার্ড। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে পেয়েছেন তেনজিং অ্যাওয়ার্ড, এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা থেকে লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড। তাঁর কৃতি ঠাঁই পেয়েছে এইচএমআই-এর ফটো গ্যালারিতে। দীর্ঘ জীবনে বিভিন্ন সাম্মানিক দায়িত্বও পেয়েছেন। হয়েছেন ইয়ুথ হস্টেল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া-র ভাইস প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন-এর সাম্মানিক সদস্য, গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার এক্সপ্লোরেশন কমিটি-র আজীবন সদস্য, ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন (আইএমএফ)-এর ইস্ট জ়োন কমিটির সচিব, আইএমএফ-এর গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য, এইচএমআই-এর এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য। এ রাজ্যের মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন-এর উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। পর্বতারোহণ ছাড়াও ঝোঁক ছিল রোয়িংয়ের উপর। ফুটবল খুব ভালবাসতেন, টান ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতিও।
‘সেন’ পদবি নিয়ে খুব গর্ব ছিল। বলতেন, আমি সেনবংশের ছেলে। সান ইয়াৎ সেন, বল্লাল সেন, প্রফুল্ল সেন, সুচিত্রা সেন— তাঁদের উত্তরসূরি আমি। আদি বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের বরিশালে। বরিশালের লোক পেলেই জমিয়ে গল্প করতেন। মাছ খেতে ভালবাসতেন খুব।
পর্বতারোহণে সাম্প্রতিক কালে এত দুর্ঘটনা, সেই নিয়ে এক আলোচনায় কিছু দিন আগে বলেছিলেন, ‘সেফ রিটার্ন ইজ় দ্য বেস্ট রিটার্ন।’ ঠিক কথা। পর্বতারোহণের ক্ষেত্রে ‘ক্লাইম্বিং’-এর সামগ্রিক অর্থ ‘ক্লাইম্বিং আপ অ্যান্ড ক্লাইম্বিং ডাউন’। অর্থাৎ যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেখানেই ফিরে আসতে হবে। মোদ্দা কথা, ঘরের ছেলে অভিযান শেষে ঘরে ফিরে এলে তবেই বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয়। আরোহণ সেখানে গৌণ, মুখ্য হল সুস্থ ভাবে ফেরা।
পর্বতারোহণের নেশায় আরোহী এই প্রাথমিক পাঠটাই ভুলে যায়। তাই তো আজ পর্বতারোহণের পথে এত মৃত্যু। এ বছরই শুধু মে মাসে নেপালের বিভিন্ন শৃঙ্গে মৃত্যু হয়েছে মোট একুশ জন আরোহীর। বেশির ভাগ মৃত্যুর পিছনে এই সর্বনাশা নেশাই দায়ী। অমূল্যদার কথাই আজ সমস্ত আরোহীর মূলমন্ত্র হওয়া উচিত। দীর্ঘ ষাট বছর ধরে পর্বতারোহণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলার পর্বতারোহণকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম এক কান্ডারি অমূল্য সেন— এটা না মেনে উপায় নেই।